ইনসাইড আর্টিকেল

‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’: বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন - ২৩ মার্চ ১৯৭১


প্রকাশ: 23/03/2023


Thumbnail

একাত্তরের ২৩ মার্চ বাংলাদেশে পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। এদিন সারা বাংলায় উড়ছিল মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা। ন্যাপ (ভাসানী) সেই দিনটি ‘স্বাধীন পূর্ববঙ্গ দিবস’ হিসেবে পালন করে। আর এর মধ্যে দিয়ে যেন মুছে দেওয়া হয় ‘পাকিস্তান দিবস’ এর কথা। ঢাকা সেদিন পরিণত হয় পতাকার নগরীতে। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে জানা যায়, কড়া পাহারায় প্রেসিডেন্ট ভবন, গভর্নর হাউস, সেনানিবাস ও বিমানবন্দর ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি। ওই সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছিলেন পিপিপি প্রধান ভুট্টো। ওই হোটেলেও সেদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে।

বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের মাস মার্চ। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক নতুন একটি মানচিত্র সৃষ্টি হয় এই মাসেই। এই মার্চ মাসেই মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ে জাতির পিতা বঙ্গুবন্ধুর হাতে। উত্তাল এই মার্চেই জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র ত্রয়োবিংশ পর্বে থাকছে ২৩ই মার্চের ঘটনাপ্রবাহ।

একাত্তরের এদিনে প্রথমবারের মতো সারাদেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা ও চলমান আন্দোলনে নিহত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমণ্ডির বাসভবনে নিজ হাতে পতাকা উত্তোলন করেন। সেখানে তখন লাখো জনতা সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি। এসময় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ উদ্যোগে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাধীন বাংলার পতাকা বিতরণ করা হয়।

ঢাকার সেক্রেটারিয়েট, প্রধান বিচারপতি ভবন, হাইকোর্ট, ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতর, ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মুখ্য সচিবের বাসভবনসহ সব সরকারি-বেসরকারি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাধা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ জানায় ছাত্র-জনতা। প্রতিবাদের মুখে সেনাবাহিনী পিছু হটলে ইন্টারকন্টিনেন্টালে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।

ঢাকার নেপাল, ইরান, ইন্দোনেশিয়া ও চীনা দূতাবাসে প্রথমে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করা হলেও পরে তা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। সোভিয়েত কনস্যুলেট ও ব্রিটিশ হাইকমিশনেও এদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলার পর প্রভাতফেরি বের করে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। তবে স্বাধীন বাংলা বা পাকিস্তান কোনো দেশের পতাকাই তোলা হয়নি ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে।

১৯৭১ সালের আজকের দিনে প্রেসিডেন্ট ভবন ও সেনা সদর দফতর ছাড়া দেশের কোথাও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ওড়েনি। লাঠি ও বন্দুকের মাথায় স্বাধীন বাংলার পতাকা বেঁধে মিছিল বের করা হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে।

শহীদ জননী জাহানা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আজ প্রতিরোধ দিবস। খুব সকালে বাড়িসুদ্ধ সবাই মিলে ছাদে গিয়ে কালো পতাকার পাশে আরেকটা বাঁশে ওড়ালাম স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন পতাকা। বুকের মধ্যে শিরশির করে উঠল।’

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এদিন সাধারণ ছুটি পালিত হয়। পল্টন ময়দানে জাতীয় পতাকা ওড়ায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তখনকার ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী এই দিনের স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘স্পষ্ট মনে আছে, বিউগল আর ড্রাম বাজিয়ে সুরের মূর্ছনায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানের সুর পল্টনে উপস্থিত সব মানুষের চিত্তকে উদ্বেলিত করছিল।’

তিনি লিছেন, ‘সত্যিকারের স্বাধীনতার আস্বাদন পাচ্ছিল বাংলার দুর্জয় ও অকুতোভয় জনতা। মোস্তফা মহসীন মন্টু, খসরু, হাসানুল হক ইনু, মহানগর ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সম্মিলিতভাবে আস্তে আস্তে পতাকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন। এ সময় সামরিক কায়দায় মঞ্চে দণ্ডায়মান স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতাকে অভিবাদন প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে আমরা অভিবাদন গ্রহণ করি।’

 নূরে আলম সিদ্দিকী আরও লিখেছেন, ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেক ব্রিগেড সাজানো হয়েছিল। একটির পর একটি ব্রিগেড অভিবাদন জানিয়ে মঞ্চ অতিক্রম করে পাশে অবস্থান নিচ্ছে, আরেকটি ব্রিগেড মঞ্চের দিকে মাথা বাঁকিয়ে অভিবাদন দিয়ে প্যারেড করে এগিয়ে যাচ্ছে। শেষ ব্রিগেডটি অভিবাদন জানানোর পর আমরা মঞ্চ থেকে নেমে পল্টনের গেটে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে গেলাম। সেখান থেকে ব্যান্ড বাজিয়ে বিউগলে জাতীয় সংগীতের সুর তুলে মিছিল করে দৃপ্ত পদভারে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে চললাম।’

এদিন সাধারণ ছুটি থাকায় জনতার ঢল নামে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে। সবার হাতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা।

বাঁ হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে ধরে ডান হাত জনতার উদ্দেশে বাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই তারা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনবে।’

পরদিন এই প্রতিরোধ দিবসের খবরে ব্যানার শিরোনাম করে দৈনিক ইত্তেফাক। রবীন্দ্রনাথের গান থেকে উদ্ধৃত করে ওই শিরোনাম ছিল, ‘আমরা শুনেছি ঐ, মাভৈ: মাভৈ: মাভৈ:’।

ঢাকা টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা এদিন অভূতপূর্ব এক কাজ করেন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান এদিন মধ্যরাত পেরিয়ে আরও ৯ মিনিট চলে। বাজেনি পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত। পর্দায় পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি।

জাহানারা ইমাম লিখেছেন, ‘টেলিভিশনের অনুষ্ঠান যে আজকে শেষই হয় না। অন্যদিন সাড়ে ৯টার মধ্যে সব সুনসান। আজ দেখি মহোৎসব চলছে তো চলছেই। সুকান্তর কবিতার উপর চমত্কার দুটো অনুষ্ঠান হল। একটা ‘ছাড়পত্র’ - মোস্তফা মনোয়ারের প্রযোজনা। ড. নওয়াজেশ আহমেদের ফটোগ্রাফির সঙ্গে কবিতার আবৃত্তি। ‘আরেকটা দেশলাই’- বেলাল বেগের প্রযোজনা। সুকান্তর দেশলাই কবিতার আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে টিভি পর্দায় দেখা গেল অসংখ্য দেশলাইয়ের কাঠি একটার পর একটা জ্বলে উঠছে। একটা কাঠি থেকে আরেকটাতে আগুন ধরতে ধরতে সবগুলো মশালের মত জ্বলতে লাগল পুরো টিভি পর্দা জুড়ে।’

তিনি লিখেছেন, ‘এরপর শুরু হল আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটক ‘আবার আসিব ফিরে’। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ একটি ছেলের বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতি আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে একাত্তরের গণআন্দোলনে। নাটক ২৩ মার্চের রাত পৌনে ১১টায় শুরু হয়ে শেষ হয় ২৪ মার্চের প্রথম প্রহরে। টেলিভিশনে ঘোষক সরকার ফিরোজ উদ্দিন সমাপনী ঘোষণায় বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা বেজে ৯ মিনিট - আজ ২৪শে মার্চ, বুধবার। আমাদের অধিবেশনের এখানেই সমাপ্তি’। এরপর পাকিস্তানি ফ্ল্যাগের সঙ্গে ‘পাক সারজমিন শাদবাদের’ বাজনা বেজে উঠল। এতক্ষণে রহস্য বোঝা গেল। ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবসে বীর বাঙালিরা টেলিভিশন পর্দায় পাকিস্তানি পতাকা দেখাতে দেয়নি।’

এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হয়নি। তবে দুজনের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে দুই দফা বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠক দুপুর ১২টা থেকে একঘণ্টা এবং দ্বিতীয় বৈঠক সন্ধ্যা ৬টা থেকে দুঘণ্টা চলে। এতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন। ইয়াহিয়ার পক্ষে ছিলেন বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা, এম এম আহমদ ও কর্নেল হাসান।

এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘পাকিস্তান দিবস’ (২৩ মার্চ)  এর বাণীতে মিথ্যাচার অব্যাহত রাখেন। তার বাণীতে লেখা ছিল, ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মিলেমিশে একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান এখন এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের পথে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। তবে আমরা যদি আমাদের লক্ষ্যে অবিচল থাকি তাহলে কোনো কিছুই আমরা হারাব না।’

(সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ‘একাত্তরের দিনগুলি’-জাহানারা ইমাম, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ‘৭১ এর দশ মাস’)।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭