বলা হয়ে থাকে, জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল যখনই বাড়বে বা রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবে, বুঝতে হবে তখনই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অনেক। কিন্তু বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে দশম সংসদে জাতীয় পার্টি দেখিয়েছে, কী করে 'বিরোধী দল' হতে হয়। একাদশ জাতীয় সংসদেও জাতীয় পার্টি কাগজে-কলমে বিরোধী দলের অবস্থানে রয়েছে। সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং উপনেতা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
এদিকে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেও ফের আলোচনায় আসছে জাতীয় পার্টি। এখন প্রশ্ন ওঠেছে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ফের কি বিরোধী দল হচ্ছে জাতীয় পার্টি? কেননা জাতীয় পার্টির এই দুই শীর্ষ নেতা রওশন এরশাদ এবং জি এম কাদের এবার তাঁদের দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মদিন উদযাপন করেছেন পৃথক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। রমজানেও তাঁরা ইফতার অনুষ্ঠান আলাদাভাবে আয়োজন করছেন বলে জানিয়েছে সূত্র।
সূত্র বলছে, এই পৃথক অনুষ্ঠান ইঙ্গিত দিচ্ছে যে জ্যেষ্ঠ নেতা রওশন এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে ঘিরে জাপায় বিভাজনটা রয়েই গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিভাজন আরও দানা বাঁধতে পারে। তবে রাজনীতিতে সরব রয়েছেন পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
সূত্র জানায়, এর আগে জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল শুরু হয়েছিল সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ইস্যুকে কেন্দ্র করে। সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ। কিন্তু এই চেয়ারে বসতে চান তার দেবর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের সংক্ষেপে জিএম কাদের। এই নিয়েই অভ্যন্তরীণ কোন্দল দিন দিন ঘণীভূত হচ্ছে। ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর জাপা থেকে বহিষ্কৃত জিয়াউল হক মৃধা জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে এক মামলা করেন। বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের যাবতীয় দলীয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞার অস্থায়ী আদেশ দেন।
পরে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা কেটে যায় গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের। নিম্ন আদালতের রায় স্থগিত করে হাইকোর্ট। বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ নিম্ন আদালতের রায় স্থগিত করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পথ প্রসস্থ করেন। সেই সঙ্গে নিম্ন আদালতের এই রায় কেন চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হবেনা, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেন হাইকোর্ট। এরপর থেকেই জাতয়ি পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দরীয় বিভিন্ন কার্যক্রমে সরব রয়েছেন জিএম কাদের। অন্যদিকে রওশন এরশাদকে কোনো দলীয় মিছিল-মিটিংয়ের সরব ভুমিকায় দেখা যায় যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, এবার প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মদিন উপলক্ষে চারটি অনুষ্ঠান করেছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। এর একটিতেও রওশন এরশাদ ছিলেন না। তিনি আলাদা অনুষ্ঠান করেন তাঁর গুলশানের বাসায়। জাপার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, রওশন ও ছেলে সাদ এরশাদকে পৃথক অনুষ্ঠান না করে জন্মদিনের দলীয় আয়োজনে অংশ নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা যাননি। যদিও এ মুহূর্তে দুজনের সম্পর্ক এতটা খারাপ নয়। আবার খুব যে ভালো, তা–ও নয়। রওশন চুপচাপ আছেন। জি এম কাদেরও খড়্গ কাটিয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রওশন এরশাদ দীর্ঘ সময় বিদেশে চিকিৎসা শেষ গত বছরের নভেম্বরে দেশে ফেরেন। এরপর তাঁর সঙ্গে জি এম কাদেরের কয়েকবার দেখা হয়। তাঁদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। এখন আবার দলের প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিন পালন এবং ইফতার অনুষ্ঠান তাঁরা আলাদাভাবে আয়োজন করছেন। এটি তাঁদের ঐক্যে ফাটল ধরার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন।
এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতার ভাগ-দখল নিয়েই সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলোতে বিভাজন, কলহ-কোন্দল দেখা দেয়। যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে আসবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে, সেহেতু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচেনের আগে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। এখন বিষয়টি এই পর্যায়ে গিয়েছে যে, দেবর-ভাবীর ক্ষমতা ভাগ-ভাটোয়ারার বিষয়। এই সম্পর্কের ফাঁটল এটা নতুন কিছু নয়, ভাগ-ভাটোয়ারা ঠিক-ঠাক হলেই এ সমস্যা মিটে যাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, তবে এখন দেখার বিষয় হচ্ছে কোন কোন দাবি-দাওয়া পূরণ করা হলে রওশন-কাদের সম্পর্ক আবারও মধুর হবে।