ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

মুক্ত গণতন্ত্রের তালিকায় নেই ভারত?


প্রকাশ: 29/03/2023


Thumbnail

(পর্ব-১)

একটা সময়ে ধরে নেয়া হতো যে, শুধুমাত্র পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। কিন্তু তা ভুল প্রমানিত হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গনতন্ত্র প্রতিষ্টা হয়েছে। এর বড় উদহারন ভারত। কিন্তু সেই ভারতে এখন গনতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে।

ঔপনিবেসিক শাসন থেকে বের ভারত যখন ৫০ এর দশকে একটু একটু করে গনতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করে তখন ভারতের অবস্থাও এমন হতাশাব্যাঞ্জকই ছিল। অসংখ্য ভাষা, ধর্ম ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বসসাস করে যে দেশে সেখানে গনতন্ত্রের সফল বাস্তবায়ন কেউ আশাও করেনি। কিন্তু পরবর্তী কয়েক যুগে ভারত এ আশংকাকে মিথ্যা প্রমাণ করে বিশ্বের বৃহত্তম গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। ভারতে একটি সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকারও নিশ্চিত করা হয়।

অর্থনৈতিকভাবেও ভারত বিশ্বে অনেকের নজর কেড়েছিল। তবে, নবীন এ গনতন্ত্রের দেশটিতে যেমন কিছু ইতিবাচক দিক ছিল তেমনি অনেক বড়ো আকারের দুর্বলতাও দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২১ সালে জাতিসংঘে ভাষণে বলেছিলেন, ভারত ‘গণতন্ত্রের জননী’। তাঁর এ দাবির মধ্যে অসারতা থাকলেও এই সেদিনও বিশ্ববাসী গর্ব করতেন, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ভারতের গণতন্ত্র ছিল আদর্শস্থানীয়। তবে এখন সারাবিশ্ব, এমনকি মোদির অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীও বুক চাপড়ান, হিন্দু জাতীয়তাবাদী এই নেতার শাসনে ভারতের সেই গর্ব দ্রুত অপস্রিয়মাণ। সর্বশেষ, দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীকে রাজনৈতিক বক্তৃতার জন্য আদালতে দণ্ড দেওয়া এবং তড়িঘড়ি করে তাঁকে সংসদ ও নির্বাচনে অযোগ্য করায় সমালোচকদের সেই কথাই শক্ত ভিত্তি পেয়েছে।

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য দুর্বল হতে থাকে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের তুষ্ট করার রাজনীতি দিয়ে মোদি অনন্য জনপ্রিয়তায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে দেশটির বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম ও নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেন। এই ধারা দিন দিনই শক্তিশালী হচ্ছে।

গণতন্ত্র কি?

গণতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে নীতিনির্ধারণে বা প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সকল সদস্য বা নাগরিকের সমান অধিকার থাকে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সদস্য বা নাগরিকদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকে। নাগরিক বা সদস্যদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ আইন প্রস্তাবনা, তৈরী এবং প্রণয়নের কাজ করে থাকেন।

গণতন্ত্র শব্দটি যদিও সাধারণভাবে কোন রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা বা রাজনৈতিক পরিমন্ডলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তবুও সংস্থা কিংবা নানা ধরনের সংগঠনের ক্ষেত্রেও গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রযোজ্য হতে পারে।

ভারতের আইন বিভাগ

গণতন্ত্রের কাঠামোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো; সাংবিধানিক কাঠামোগুলোর ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বিস্তার করা, রাজনীতির মূল খেলোয়াড়গুলোকে অকার্যকর বানিয়ে সাইড লাইনে বসিয়ে রাখা এবং রাজনীতির নিয়ম কানুনকে দুর্বল করে দেয়া। এর মধ্যে জনগনের জন্য সংবিধান মোতাবেক প্রয়োজনীয় আইন প্রনয়ন করাই এই বিভাগের প্রধান কাজ। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ সংবিধানের মূল কাঠামোর উপর নির্ভর করেই আইন প্রণয়ন করে থাকেন। আইন দিয়ে গণতন্ত্রকে অকার্যকর করার ধারণাটি এ শতকে এসে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। বরং এখন গনতন্ত্রকে অনেক বেশি দুর্বল ও নাজুক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে গনতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলোকে সুকৌশলে ধ্বংস করে দেয়ার মাধ্যমে। আগে সামরিক অভ্যুত্থান বা অন্যন্য বেআইনী পন্থায় গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হতো। আর এখন গনতন্ত্রের সিস্টেম লস দিয়েই গনতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করে দেয়া হয়েছে।

এভাবে কাজ করে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, পেরুর প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমুরি এবং হাঙ্গেরীর প্রেসিডেন্ট ভিকটর ওরবান সফলতাও পেয়েছেন।

নিজ দেশে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে তারা নিজেদের অবস্থানকে ভালোভাবেই সংহত করতে পেরেছেন। এ তালিকায় নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদির একনায়কোচিত মনোভাবের কারণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন অনেকক্ষেত্রেই খর্ব হতে শুরু করেছে। বেশ কিছু ঘটনাও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটেছে যা ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো ধরনের সমালোচনার জন্য ভারতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে এবং ভিন্নমত দমন করার জন্য আইন ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রীর পরাজয়ের আহ্বান জানিয়ে দিল্লিতে কয়েকটি পোস্টার লাগানোর কারণে মাত্র কয়েক দিন আগে কয়েক ডজন এফআইআর দায়ের এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সমালোচনাকে সামগ্রিকভাবে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবে দেখানো হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ভক্সের এক নিবন্ধে বলা হয়, বছরের পর বছর ধরে মোদি তাঁর দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আক্রমণ করেছেন। তাঁর সরকার মুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার পদদলিত করেছে, সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের জেলে দিয়েছে এবং মুক্ত সংবাদমাধ্যমে লাগাম পরিয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভি-ডেমের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত গণতন্ত্র হিসেবে যোগ্যতা অর্জনের জন্য ন্যূনতম মানও পূরণ করেনি। তারা ভারতকে নির্বাচনী স্বৈরাচারী দেশে নামিয়ে দিয়েছে। ভারতের গণতন্ত্রের পতনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং মানহানি আইনের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছে ভি-ডেম।

নানামুখী টানাপোড়েনের মধ্যে যখন ভারতে ইন্টারনেট পরিসেবা ও অন্যন্য তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লো তখন অনেকেই আশা করেছিল যে, এর মাধ্যমে ভারতের গণতন্ত্র আরো সংহত হবে। স্বাধীনতা নতুন মাত্রা পাবে। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। বরং নতুন নতুন সব জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের ডিজিটাল সমৃদ্ধি ভারতকে মুক্ত করতে পারেনি, বরং নতুন নতুন জালিয়াতি ও কারসাজির পথ উম্মুক্ত করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজ এক বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে - যার বিষয় ছিল বৈশ্বিক রাজনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতা।

এতে ভারতকে 'মুক্ত গণতন্ত্রের' তালিকা থেকে নামিয়ে দিয়ে 'আংশিক মুক্ত গণতন্ত্রের' তালিকায় স্থান দেয়া হয়।

সুইডেন ভিত্তিক ভি-ডেম ইনস্টিটিউট গণতন্ত্র বিষয়ে তাদের সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ভারত একটি 'নির্বাচন-ভিত্তিক স্বৈরতন্ত্রে' পরিণত হয়েছে। আরেকটি রিপোর্টে ভারতকে বর্ণনা করা হয় 'ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র' হিসেবে এবং গণতান্ত্রিক সূচকে দুই ধাপ নিচে নেমে দেশটির স্থান হয় ৫৩ নম্বরে। এই রিপোর্টটি প্রকাশ করে ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭