ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

মুক্ত গণতন্ত্রের তালিকায় নেই ভারত?


প্রকাশ: 30/03/2023


Thumbnail

(পর্ব ২)

ভারতের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো চলছে না। ভারতের মিডিয়াও গত কয়েক বছরে অনেকটা নগ্নভাবেই সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা সরকারের চাপে রীতিমতো কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বে সংবাদ স্বাধীনতার পরিসংখ্যানে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত এখন ১৪২ নম্বরে অবস্থান করছে। সাংবাদিক নিপীড়ন এবং একের পর এক সাংবাদিককে কারাগারে নিক্ষেপ করায় ভারত এ তালিকায় ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে।

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য দুর্বল হতে থাকে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের তুষ্ট করার রাজনীতি দিয়ে মোদি অনন্য জনপ্রিয়তায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে দেশটির বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম ও নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেন। এই ধারা দিন দিনই শক্তিশালী হচ্ছে। আজকের পর্বে  আমরা গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন স্তম্ভ গণমাধ্যম ও ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করবো।

ভারতে গণমাধ্যম কতটা মুক্ত তাঁর জানতে সাম্প্রতিক বিবিসি কান্ডই যথেষ্ট। নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে একটি ‘বিতর্কিত’ তথ্যচিত্র নির্মাণ এবং তা প্রদর্শনের পর ভারতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির দুইটি কার্যালয়ে আয়কর কর্মকর্তাদের অভিযানের পর দেশটিতে সংবাদমাধ্যম এবং সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের আয়কর বিভাগ ও পুলিশ রাজধানী দিল্লি  ও মুম্বাইয়ে বিবিসির কার্যালয়ে উপস্থিত হন। আয়কর বিভাগ থেকে অবশ্য একে অভিযান নয় বরং ‘জরিপ’ নাম দেওয়া হয়। তাদের ব্যাখ্যা ছিল, বারবার অনুরোধ করার পরও বিবিসি কর্তৃপক্ষ ভারতে তাদের আয়-ব্যয় এবং কর সংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে তাদের কাছে উপস্থাপন করছিল না।

বিবিসির কার্যালয়ে অভিযানের তিন সপ্তাহ আগে ২০০২ সালে ভারতের গুজরাটে হিন্দ-মুসলিম দাঙ্গা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র যুক্তরাজ্যে প্রদর্শন করা হয়। বিবিসির তৈরি ওই তথ্যচিত্রে গুজরাট দাঙ্গায় মোদীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ওই সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদী।

‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোশ্চেন’ নামের তথ্যচিত্রটিকে বিতর্কিত কাহিনী ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বানানো ‘অপপ্রচার’ বলে অ্যাখ্যা দিয়ে ভারতে সেটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটি দেখানো ও শেয়ার করায় উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত সরকার। ওই তথ্যচিত্রের প্রদর্শন নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অঙ্গনও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।

২০১৪ সালে ভারতে প্রধানমন্ত্রী হন মোদী। তারপর ভারত ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’ এ ১৪০তম অবস্থান থেকে নিচে নামতে শুরু করে। এছাড়া, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এর তালিকায় গত বছর দেশটির অবস্থান ছিল ১৫২তম। তালিকায় এত নিচে আগে কখনো নামেনি দেশটি।

ভারত সরকার থেকে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স এর ওই তালিকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সংস্থাটির মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বলেছে, ভারতে একটি প্রাণবন্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যম ব্যবস্থা রয়েছে।

‘দ্য এডিটরস গিল্ড অফ ইন্ডিয়া’ থেকে বলা হয়, ‘‘সংবাদ সংস্থাকে ভয় দেখানো এবং হয়রানি করার জন্য সরকারি সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করার যে প্রবণতা ভারতে রয়েছে, বিবিসির কার্যালয়ে অভিযান তারই অংশ।’’

২০২১ সালে সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আয়কর কর্মকর্তাদের এরকম আরো চারটি অভিযানের কথা তারা উল্লেখ করেন।

২০২১ সালের জুলাই মাসে ‘দৈনিক ভাস্কর’ এর কার্যালয়ে অভিযান চালান কর কর্মকর্তারা। অভিযোগ ছিল, সার্কুলেশনের দিকে দিয়ে ভারতের সর্ববৃহৎ এই পত্রিকাটি তাদের ৭০০ কোটি রুপি আয়ের উপর কর ফাঁকি দিয়েছে। ‘দৈনিক ভাস্কর’ কর্তৃপক্ষ কর কর্মকর্তাদের ওই অভিযোগের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্ত হন এবং মামলাটি এখনো চলছে।

ডিবি কর্পোরেশনের অংশ ওই পত্রিকাটিতে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং এই মহামারীতে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করা নিয়ে ধারাবাহিক খবর প্রকাশ পায়। সরকার থেকে অব্যবস্থাপনা এবং মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।

পত্রিকা অফিসে আয়কর অধিদপ্তর থেকে অভিযানই নয় বরং কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের পত্রিকায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ছয়টি রাজ্য থেকে সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ২০২২ সালের অগাস্ট মাস পর্যন্ত যা অব্যাহত ছিল। এবং এ কারণে পত্রিকাটিকে ১০০ কোটি রুপির বেশি লোকসান গুণতে হয়েছে।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স থেকে বলা হয়, ভারতে বহু মানুষ এখনো পত্রিকা পড়েন। কিন্তু তারপরও দেশটির অনকে সংবাদ সংস্থা ঠিকঠাকমত সরকারি বিজ্ঞাপন না পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে চাপে রয়েছে।

এছাড়া, মোদী ঘনিষ্ঠ ধনকুবেরদের কিছু মিডিয়া গ্রুপ অধিগ্রহণ করার ঘটনাকে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স থেকে ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে নিরব করে দেওয়ার প্রচেষ্টাও বলা হয়েছে।

ভারতের পার্লামেন্টে সরকারের পক্ষ থেকে গত বছর দেওয়া এক বিবৃতিতে জানানো হয়, দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাপা পত্রিকা ও ইলেক্ট্রোনিক সংবাদমাধ্যমকে সাড়ে ছয় হাজার কোটি রুপির বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার বিজ্ঞাপন ব্যয় কমিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে সরকার ব্যয় কমায়নি বলে দাবি করেন কাঞ্চন গুপ্তা।

বলেন, ‘‘গণমাধ্যমকে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। আমরা এমন কোনো সংবাদমাধ্যম চাই না যারা আমাদের কাছ থেকে অর্থ পেতে আমাদের প্রতি অনুগত থাকে বা আমাদের পক্ষে খবর প্রচার করেন।”

খবর প্রকাশের কারণে শুধু সংবাদমাধ্যমকে নয় বরং সাংবাদিকদেরও হয়রানি ও গ্রেপ্তার হতে হয়।

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) এর তথ্যানুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে অন্তত সাত জন সাংবাদিককে তাদের প্রকাশিত খবরের কারণে কারাগারে যেতে হয়। যা দেশটিতে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭