ইনসাইড থট

বাসন্তী থেকে সবুজ: এ কেমন অবুঝ সাংবাদিকতা!


প্রকাশ: 01/04/2023


Thumbnail

৪৮ বছর আগের কথা। সবে মাধ্যমিক পাশ করেছি, খণ্ডকালীন কাজ শুরু একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রুফরিডার হিসেবে,সপ্তাহে দু ঘন্টার কাজ, ১০ টাকা আয়, সময়টা খারাপ যাচ্ছিলো না, একদিন কাকডাকা ভোরে সম্পাদকের তলব, বেশ রাগত স্বরে জানালেন কি কাজ করেছি, এ বলে গত রাতে প্রকাশিত পত্রিকা ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো বড়ো ভুল হয়েছে কিনা, জানালেন এ এক কপি ছাড়া সব পত্রিকা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে কোনো এক সুহৃদ পাঠকের অনুসন্ধানী ফোনকল এর রিপোর্টের ভিত্তিতে। অভিযোগ মারাত্মক। আমার শহরতলীর এক মাদ্রাসাতে ওয়াজ মাহফিলের একটা সংবাদ তাদের অনুরোধে ছাপা হয়েছে।নিচের লাইনে লেখা থাকার কথা, " উক্ত ওয়াজ মাহফিলে দেশের বিশিষ্ট আলেমগণ ওয়াজ নসিহত করেন।" পত্রিকার কম্পোজার আর মেশিনম্যান এক হিন্দু ব্রাহ্মণ, কম্পোজ করতে গিয়ে ওই লাইন এ আলেমগণের পরিবর্তে ছাপা হলো, " উক্ত ওয়াজ মাহফিলে দেশের বিশিষ্ট জালেমগণ ওয়াজ নসিহত করেন।" এই দেখে তো আমাদের সবাই ভয় পেয়ে গেছি, নিয়ম অনুযায়ী পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল, সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্ট সবার জেলে থাকার কথা।

গণতন্ত্রের নতুন ভাষ্যে তিনিই সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক,যিনি প্রতি দিন শাসক দলের নেতাদের হাঁটু ছুঁয়ে সম্মান জানান। যদি কেউ দাসত্ব স্বীকার করে নিতে পারেন,তা হলে তিনিই শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক; নানা অভিযোগে কণ্টকিত হয়েও সরকারের শীর্ষব্যক্তিত্বের গুডবুকে থাকতে পারবেন। এটাই গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের ‘নিউ নর্মাল’। কিন্তু সে তুলনায় প্রথম আলো পত্রিকাটি বেশ ব্যতিক্রম। একসময় মতি ভাই (সম্পাদক মতিউর রহমান) কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, একতা নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে হাতে খড়ি, সালটা হবে ১৯৭৮, দেশে সামরিক শাসন চলছে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এ ভাসমান সম্পাদক হাতে পেলেন আলাদিনের চেরাগ, সাবের হোসেন চৌধুরী পত্রিকা বের করবেন, নাম দেয়া হলো ভোরের কাগজ। ঐ সময়ে সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শাহেদ আহমেদ দৈনিক আজকের কাগজ নামের একটা পত্রিকা চালাতেন, নতুন ধারার পত্রিকা, ঐ পত্রিকা সহ আরো সব টগ বগে তরুণ সাংবাদিককে নিয়ে জড়ো করা হলো, চালু হলো মতিউর রহমান সম্পাদিত ভোরের কাগজ। বেশ নাম করেছিল ঐ পত্রিকা। একদিন মতি ভাই সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন, ট্রান্সকম গ্রুপ এর মালিক লতিফুর রহমান কিনে নিলেন, ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি ষ্টার, সম্পাদক হলেন মাহফুজ আনাম, প্রফেসর এস এম আলীর মতো সম্পাদককে হটিয়ে দিয়ে, আমি অনেকবার ঐ অফিসে লেখা জমা দিতে গেছি, ধানমন্ডির ৪ নাম্বার সড়কে ছিল অফিস। কিছুদিন পর লতিফ সাহেবের টাকার খেলায় চালু হলো প্রথম আলো, মতিউর রহমানকে করা হলো সম্পাদক।

২০০০ সালের গোড়ার দিকে ফেনীর সন্ত্রাস নিয়ে টিপু সুলতান বলে এক ফেনী প্রতিনিধি তৎকালীন ফেনীর গডফাদার জয়নাল হাজারীকে নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করলো,গডফাদার এর আদেশে টিপুর উপর চালানো হলো অমানবিক শারীরিক নির্যাতন, তা নিয়ে দেশে বিদেশে হৈ চৈ পড়ে গেলো, প্রথম আলো তখন অন্য সব পত্রিকাকে ছাপিয়ে হয়ে উঠলো এক নাম্বার সংবাদপত্র। নির্যাতিত টিপু আমেরিকার প্রেস ফ্রিডম পুরস্কার পেলো।সময়ের আবর্তনে প্রথম আলো আরো বেশি লাইম লাইট -এ এলো ২০০৭ সালের সামরিক শাসনের আমলে, মাইনাস টু ফর্মুলার প্রবক্তা হয়ে। প্রচার সংখ্যা কয়েক লক্ষ, কর্মীর সংখ্যাও হাজারের উপর।সরকারি বিজ্ঞাপন না হলেও চলার ক্ষমতা রাখে প্রথম আলো।অনেক ভালো ভালো সংবাদ সাহস করে ছাপিয়ে পাঠকের মন জয় করে চলছিল।

এবার আসি গেলো কয়েকদিনে প্রথম আলো পত্রিকাকে নিয়ে বিভিন্ন তর্ক বিতর্ক নিয়ে। মহান স্বাধীনতা দিবসে একজন দিনমজুরের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রথম আলো যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেটি মিথ্যা ও ‘পলিটিক্যালি মোটিভেটেড’।একটা বাচ্চার হাতে ১০ টাকা দিয়ে স্বাধীনতা নিয়ে তার মন্তব্য নেওয়া হয়েছে।ছেলের নাম সবুজ।তাকে বানানো হয়েছে জাকির হোসেন।ছেলে স্কুলের ছাত্র, তাকে বানানো হয়েছে দিনমজুর। এটি কোন সাংবাদিকতা? এত বড় মিথ্যাচার, মিথ্যা রিপোর্ট করা, সরি বললেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? এটা একটা সংগঠিত অপরাধ।দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করার দায় প্রথম আলো-কে নিতে হবে। ২০১৩ সালে রানা প্নাজা ধসে হাজার হাজার মানুষ যে দিন নিহত হয়, সে দিন সন্ধ্যায় প্রথম আলো-মেরিল পুরস্কারে নাচ-গান করা, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ছাত্রকে নিকটবর্তী উন্নত হাসপাতালে ভর্তি না করে দূরের এক হাসপাতালে ভর্তি করা ও তার মৃত্যু ঘটা এবং এখন স্বাধীনতা দিবসে শিশুর নাম দিয়ে মিথ্যা লিখে স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা -এ সবের কি বিচার? স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতাকে এভাবে কটাক্ষ করে যে সংবাদ প্রচার করা এবং একটা শিশুকে ১০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেটি বলানোর চেষ্টা করা সে না বললেও সেটিকে ছাপানো- এটি কি সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার পরিপন্থি নয়? সে জন্যই এটার প্রচন্ড সমালোচনা হয়েছে, এটি ঠিক নয় বিধায় আপলোড হওয়ার পরে সেটি তারা সরিয়েও ফেলেছিলো। কিন্তু সেটির ‘স্ক্রিনশট’ তো বিভিন্ন জায়গায় ছিলো, অনেকে শেয়ার করেছে, সেগুলো রয়েও গেছে।সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়িয়েছে, ঘুরছে। এতদপ্রেক্ষিতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা মামলা করেছে, মামলার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।পুলিশের তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে এবং আইনের গতিতে আইন চলবে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগে বাসন্তীর গায়ে জাল পরিয়ে ছবি তুলে সেটি প্রকাশ করা হয়েছিল। তখন জালের দাম কিন্তু কাপড়ের দামের চেয়ে বেশি ছিলো, এখনো জালের অনেক দাম।কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে বাসন্তীর গায়ে জাল পরিয়ে ছবি তুলে প্রকাশ করা হয়েছিল। অনেকে বলছে, ২৬ মার্চে প্রথম আলোর এ ঘটনাটি বাসন্তীকে জাল পরানোর মতোই। রাষ্ট্র, সমাজ, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এ ধরণের অসত্য পরিবেশন সর্বমহলের মতে একটি অপরাধ, ডিজিটাল অপরাধ। অপরাধ আর সাংবাদিকতা এক জিনিস নয়, কোনো সাংবাদিক যদি অপরাধ করে তার কি শাস্তি হবে না? কেউ যদি অপসাংবাদিকতা করে, স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করে এবং একটি ছেলের হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তার নামে অসত্য লেখে, চাইল্ড এক্সপ্লয়টেশন করে, সেটার কি বিচার হবে না? আমরা কি কেউ বিচারের উর্ধ্বে, আইনের উর্ধ্বে? তা তো নয়। বিশ্বের দেশে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদাহরণ আছে, এ ধরনের আইন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়েছে। যুক্তরাজ্যে সাইবার সিকিউরিটি ল’জ এন্ড রেগুলেশন ২০২২, যুক্তরাষ্ট্রে সাইবার ল’ এন্ড পানিশমেন্ট এবং এ ধরণের আইন বিশ্বের বহু দেশে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরণের অপরাধের শাস্তি হচ্ছে ২০ বছর কারাদন্ড এবং ডিজিটাল মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর কারণে যদি কারো মৃত্যু হয়, তবে সেই ডিজিটাল অপরাধের শাস্তি হচ্ছে যাবজ্জীবন কারাদন্ড।আমাদের দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য অনেক দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনেক বেশি কঠিন।

*(ছবিতে ১৯৭৪ সালে বাসন্তীকে মাছধরার জাল পরিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক যে ছবি ছাপিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছিলো, সে ছবি আর ২০১৭ সালের সে বাসন্তী (বয়স ৭৫)*



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭