প্রেস ইনসাইড

কী হতে পারে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের?


প্রকাশ: 02/04/2023


Thumbnail

রাজধানীর রমনা থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রধান আসামি দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। রোববার বেলা সাড়ে ৩ টার দিকে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ জামিনের এ আদেশ দেন। সেই সঙ্গে আদালত বলেছেন, প্রথম আলোর বিষয়টি আরেকটি বাসন্তী কাহিনী। দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে এটা করা ঠিক হয়েছে কিনা- সেই প্রশ্নও করেন আদালত। 

রোববার (২ এপ্রিল) বিকেলে হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো.আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ জামিন আবেদনের ওপর শুনানি করেন। শুনানি শেষে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে আগাম জামিন দেওয়া হয়। শুনানিতে ‘বিষয়টি আরেকটি বাসন্তী কাহিনী’ -এমন মন্তব্য করেন আদালত।  

শুনানিতে আদালতে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। স্বাধীনতা দিবসে সংবাদ প্রকাশের জেরে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও সাভারে কর্মরত প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসের নামে ২৯ মার্চ মধ্যরাতে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা করেন আবদুল মালেক নামের আইনজীবী। এ মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক, প্রতিবেদক ছাড়াও সহযোগী একজন ক্যামেরাম্যান ও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। এর আগে একই ঘটনায় তেজগাঁও থানার করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রতিবেদক শামসের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা হয়। তিনি এখন কারাগারে আছেন।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই মামলায় অপরাধী সাব্যস্ত হলে কি হতে পারে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের? কেন প্রথম আলো সম্পাদক ও প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মামলা? এই মামলায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা কি বলছে?  

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ২৫ ধারার এক উপধারার (খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, - তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

এই আইনে, এ ধরণের অপরাধের ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে।

জানা গেছে, দৈনিক প্রথম আলোর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে ভাইরাল হওয়া খবরের ছবি ছিলো, ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে একটি শিশু। প্রথম আলোর ভাষ্যমতে, শিশুটির নাম জাকির হোসেন। শিশুটির উদ্ধৃতি ছিলো এমন- ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কি করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো’। কিন্তু পরে জানা গেছে, প্রথম আলোর এই প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ ভুয়া। শিশুটির নাম সবুজ এবং সে প্রথম শ্রেণির একজন ছাত্র। সে মোটেও দিনমজুর নয়। বরং সে পরিবারকে সাহায্য করার জন্য স্কুল শেষ করে বিকেল বেলায় মায়ের সাথে ফুল বিক্রি করে থাকে। এ ঘটনায় রাজধানীর তেজগাঁও ও রমনা থানায় পর পর দুইটি মামলা হয়। 

সংবাদ মাধ্যম সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ মহল বলছেন, সাংবাদিকতার সর্বশেষ ধারণা হলো ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট জার্নালিজম’ বা জনস্বার্থ সাংবাদিকতা। এর মৌলিক অবস্থান হলো ‘জনস্বার্থ’—কেবল জন-আগ্রহ প্রশমন নয়। এবং এখানে স্বার্থ মানে কেবল ব্যক্তিস্বার্থ নয়—যে স্বার্থ মূলত নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সমাজের বৃহত্তর মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে তা-ই জনস্বার্থ। এই যে জনস্বার্থ রক্ষা করার ধারণা এটিই সাংবাদিকতার লক্ষ্য এবং ধারণা। একে ‘জনস্বার্থ সাংবাদিকতা’ নাম দেওয়া হলেও আদি ধারণাতেও তাই আছে! যার আরও খুঁটি শব্দ—রেসপন্সিবিলিটি বা দায়িত্বশীলতা।

ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো স্বাধীনতার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো প্রশ্ন কেউ তুলতে চাইলে সেটি তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু এই প্রশ্নে উৎসাহিত হয়ে এবং স্বাধীনতার মর্যাদায় আঘাত তুলে কোনো সংবাদ প্রকাশের সুযোগ অন্তত আইন অনুযায়ী নেই! নতুন করে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ পরিবর্তন হলে সেটি নতুন বাস্তবতা! কোনো জাতীয় স্বীকৃত আচরণবিধি ছাড়াও কেবল স্বাধীন সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হিসেবে যার যার সম্পাদকীয় নীতি দিয়ে পরিচালিত হতে পারে। কিন্তু সেটি আরেকটি স্বতন্ত্র ধারা! কিন্তু দিনশেষে সব গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের মৌলিক কিছু আচরণবিধি অনুসরণ করতেই হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রথম আলো যে কাজটি করেছে- সেটি জনস্বার্থ সাংবাদিকতা, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এখানে বিশাল স্বাধীন জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে কটাক্ষ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দিনমজুর জাকির হোসেনের নাম দিয়ে শিশু সবুজের ছবি প্রকাশ করে একটি মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কাজেই উল্লেখিত আইনে এটি অপরাধ।  

এই ঘটনায় গত ২৯ মার্চ রাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা থানায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেন আইনজীবী আবদুল মালেক। এ মামলায় পত্রিকাটির সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস ও ক্যামেরাম্যানসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে দৈনিক প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে একটি ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ করা হয়। একইসঙ্গে সংবাদটি দৈনিক প্রথম আলো তাদের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে শেয়ার করে। সংবাদটিতে দেখা যায়, একটি শিশু ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবেদকের দাবি, ওই শিশুটির নাম জাকির হোসেন। পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শিশু জাকির হোসেন বলে- ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো।’

পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদটি ভাইরাল হয়ে যায়। সংবাদটি দেশ ও বিদেশে অবস্থানরত হাজার হাজার মানুষ তাদের ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ক্রিনশটসহ শেয়ার করেন। এ ঘটনায় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের সোনালি গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণসহ বহির্বিশ্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। মহান স্বাধীনতা দিবসের দিনে এ সংবাদ প্রকাশ করায় বিশ্বব্যাপী দেশের ভাবমূর্তি ও স্বাধীনতার অর্জন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, পরবর্তীতে একাত্তর টিভিতে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, প্রথম আলো পত্রিকা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিথ্যা পরিচয় ও মিথ্যা উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদটি পরিবেশন করেছে। যে শিশুটির কথা প্রথম আলোর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তার সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। নাম-পরিচয় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পত্রিকায় বলা হয় শিশুটির নাম জাকির হোসেন। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায় ওই শিশুর নাম সবুজ আহমেদ। তার বাড়ি সাভার থানার কুরগাঁও পাড়ায়। তার বাবা একজন রাজমিস্ত্রি। মা মুন্নী বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে মেজো সন্তান সবুজ। প্রথম আলোর তথ্যে বলা হয়েছে, সে দিনমজুর। কিন্তু সাত বছরের শিশু সবুজ আহমেদ প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে এবং স্কুল শেষে মাঝে মধ্যে ফুল বিক্রি করে।

মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, শামসুজ্জামানের প্রস্তুত করা প্রথম আলোর ওই সংবাদে বলা হয়েছে, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো’। প্রকৃতপক্ষে ওই শিশুটি এ ধরনের কোনো কথা বলেনি। শিশুটি জানিয়েছে, প্রথম আলোর সাংবাদিক শিশুর হাতে ১০ টাকা দিয়ে এ ছবি তুলেছে। এতে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার হীন উদ্দেশ্যে একটি অশুভ চক্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এ মিথ্যা সংবাদ তৈরি ও পরিবেশন করে অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

এর আগে, বুধবার (২৯ মার্চ) সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া নামের একজন বাদী হয়ে ডিএমপির তেজগাঁও থানায় সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭