ইনসাইড থট

বিত্তবানের শখ বনাম এক বিত্তহীনের ক্যান্সার হাসপাতালের স্বপ্ন


প্রকাশ: 07/04/2023


Thumbnail

সম্প্রতি পত্রিকান্তরে জানা গেল রাজধানীর ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে বিক্রি হচ্ছে বিশেষ ধরনের সোনার প্রলেপ দেওয়া জিলাপি। প্রতি কেজি জিলাপির দাম ২০ হাজার টাকা! বিশেষ এই জিলাপি ২৪ ক্যারেটের সোনা দিয়ে মোড়ানো। সেকারণেই এত দাম। রমজান উপলক্ষে এই জিলাপি তৈরি করেছে ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল কর্তৃপক্ষ।

সাধারণ গ্রাহকদের জন্য প্রতি কেজি জিলাপিতে ২৪ ক্যারেটের খাবার উপযোগী সোনার ২০ থেকে ২২টি লিফ বা পাতলা পাত থাকবে। একজন গ্রাহক ন্যূনতম ২৫০ গ্রাম জিলাপি কিনতে পারবেন। সেক্ষেত্রে দাম পড়বে পাঁচ হাজার টাকা।

বিত্তবানদের জন্যে এই মিষ্টি খাবারের সংবাদে আমাদের বিচলিত হবার কিছু নেই বটে, কিন্তু একই সংবাদে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে যেসব বিষয় নিয়ে আমাদের বোধোদয় হওয়া দরকার। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকার মহাব্যবস্থাপক অশ্বিনী নায়ার ওই পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, খাদ্য ও পানীয় এখন আর শুধু খাওয়ার বিষয় নয়। মানুষ এখন আর শুধু নামেই বিলাসিতা পেতে চায়না। তারা বিলাসী পণ্যের অনন্য স্বাদ ও অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে চায়। ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল এ ধরনের অভিজ্ঞতা দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশি গ্রাহকদের সেই বিলাসিতা উপভোগের সুযোগ দিতে চায়। সেজন্যই বিশেষ এ জিলাপি বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’বাংলাদেশি গ্রাহকদের এই বিলাসিতা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কারণ অবশ্যই আছে কারণ এই বিলাসিতা বাস্তব না হলে সেই হোটেলে এই বস্তু তৈরি হতোনা বা বিক্রি হতোনা। একই সংবাদে উল্লেখ আছে, ‘গত বছরের জুলাই মাসে দেশে সোনায় মোড়ানো আইসক্রিম বিক্রির খবর বেশ সাড়া ফেলেছিল। রাজধানীর বনানীর পাঁচ তারকা হোটেল সারিনা তাদের ১৯তম বর্ষপূর্তিতে বিশেষ ওই আইসক্রিম বিক্রি করে। ২৪ ক্যারেটের খাওয়ার যোগ্য সোনা দিয়ে তৈরি ওই আইসক্রিমের দাম ছিল ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকা।সেসময় মাত্র ২৪ ঘণ্টায় অভাবনীয় সাড়া পায় সারিনা হোটেল কর্তৃপক্ষ। অনেক ফরমাশ আসতে থাকায় তারা এক পর্যায়ে সেই লাখটাকার সোনার আইসক্রিম বিক্রির অর্ডার নেওয়া বন্ধ রাখে”।

আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ফলে ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে একথা যেমন সত্যি কিন্তু বিপরীত চিত্রটি কি? এই সমাজ ব্যবস্থায় এই বিষময় বৈষম্য কেমন করে তৈরি হলো? এই বিলাসিতা আমাদের কখন মানায়? আমাদের কি সেই যোগ্যতা আদৌ তৈরি হয়েছে? সাংস্কৃতিক ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ নিয়ে আমরা এখন বিতর্ক করছি কিন্তু কুড়ি হাজার টাকায় সোনার জিলাপি কেনা আমাদের আর একটি ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কারণ কোন খাবার আমাদের রুচিতে‘বিলাসিতা’শব্দটি যুক্ত করে দেবেনা সেটা বুঝবার‘সাংস্কৃতিক শিক্ষা’আমাদের নেই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বিত্তবান সমাজের কাছে আহবান করেন যেন তাঁরা সমাজের নানা উপকারে এগিয়ে আসেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবায় যেন তাঁরা সহযোগিতা করেন। সতেরো কোটি মানুষের এই দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার একটি মাত্র সরকারী হাসপাতাল আছে তা-ও ঢাকায়। সারাদেশ থেকে সরকারী সুবিধায় চিকিৎসা সেবা পেতে রোগীদের ঢাকায় ছুটে আসতে হয়। আর যে কয়েকটি বেসরকারী হাসপাতাল আছে সেগুলোর খরচ সাধারণের আওতার বাইরে। সরকার এখন চেষ্টা করছে প্রতিটি বিভাগে একটি করে ক্যান্সার ইউনিট প্রতিষ্ঠা করার। কিন্তু সবই কি সরকার করবে?

আজ থেকে সাত বছর আগে, তাঁরও আগের সাত বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে রামপালের গ্রামে ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবার আয়োজন শুরু করি। পরে সরকার আমাদের ৮০ভাগ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে কিন্তু মাত্র ২০ ভাগ টাকা আমরা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি।  দেশের যারা বিত্তবান বলে পরিচিত এমন কোন নামিদামি মানুষ/প্রতিষ্ঠান নেই যাদের কাছে হাত পাতিনি, এমন একটি কঠিন উদ্যোগের জন্যে শুধু বাহবা পাই, কিন্তু একটি টাকা দিয়ে কেউ সাহায্য করেনা। কিন্তু তারা কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে এক কেজি জিলাপি কিনে খেতে বা এক লাখ টাকা দিয়ে সোনার আইসক্রিম কিনে খেতে সামান্য লজ্জাবোধ করেন না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহসী উদ্যোগে এই দেশের মানুষ পদ্মাসেতু উপহার পেয়েছে, মুজিববর্ষে ২,৩৭,৮৩১জন ভূমিহীন, গৃহহীন পরিবার নিজেদের ঘর ও জমির মালিকানা-সহ ঠিকানা পেয়েছে, ২১১ টি উপজেলা শতভাগ ভূমিহীন-গৃহহীন পুনর্বাসন নিশ্চিত হয়েছে কিন্তু আমরা শুনিনি কোন বিত্তবান তার বিলাসী টাকার সামান্য অর্থ পদ্মাসেতুর নির্মাণে বা আশ্রয়ণের প্রকল্পে খরচের জন্যে দান করেছেন। সবই হয়েছে সরকারের নিজস্ব উদ্যোগ, বুদ্ধি ও উপায়ে। এমনকি পদ্মা সেতুর অর্থসংগ্রহের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে কোন সারচার্জ পর্যন্ত জনগণের প্রতি আরোপ করা হয়নি। কিন্তু ওই ২১১ উপজেলার যারা বিত্তবান, দেশে-বিদেশে ‘বিলাসী’ জীবনযাপন করেন তাদের কেউ কোন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যারা দিনরাত অবিরাম পরিশ্রম করে এই সাফল্য এনে দিয়েছেন বা ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প যারা বাস্তবায়ন করেছেন কাউকে একলাইন চিঠি লিখে ধন্যবাদ দিয়েছেন এমন কোন সংবাদ আমরা পাইনি। ওইসব বিত্তবানদের প্রত্যেকের গ্রাম আছে, ফেলে আসা স্কুল আছে তাঁরা তাঁদের ওই গ্রামের স্কুলে মেয়েদের জন্যে টয়লেট আছে কী না সেই খবরটুকু পর্যন্ত রাখেননা। তাঁদের প্রত্যেকে যদি মাসে ১০০টাকা করেও উপজেলা পরিষদে দান করেন সেই টাকায় কত মানুষের উপকার হতে পারে সেটা বুঝবার ‘যোগ্যতার সংস্কৃতি’ তাঁদের নেই বা সেটা তাঁরা অর্জন করতে পারেননি।

সেই যোগ্যতা অর্জন না করে ‘বিলাসিতার জিলাপি’ খাওয়া অপরাধের সামিল। অনেক বিত্তবানের গ্রামে অনেক মানুষ আছেন যারা তাঁদের বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের জটিল চিকিৎসার খরচ যোগান দিতে পারেননা। কোন বিত্তবান এইসব পরিবারের পাশে না দাঁড়িয়ে লাখ টাকা আইসক্রিমের দোকানে লাইন দিয়ে দাঁড়ান, এটা যে মানা যায়না বা ধিক্কারজনক সেটা তাদের বুঝতে হবে। আমাদের কাছে পরিবার, সমাজ বা নিজ গ্রামের জন্যে যথা কর্তব্য পালননা করবার ও এরকম দায়িত্বহীন আচরণের বহু উদাহরণ আছে যা উপ্সথাপন করলে ‘বিত্তবানেরা’ এই দেশে মুখ দেখাতে পারবেন না।

সব কাজ সরকারকেই করে দিতে হবে সে অবিবেচক চিন্তা ও ভুল প্রত্যাশা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। নাহয় কুড়ি হাজার টাকার জিলাপি নিয়ে আমাদের একদিন প্রহসন করবে এই সমাজই, তখন আমরা উন্নয়ন ও পরিবর্তনের মূল্য অনুধাবন করতে পারবোনা বা সে সক্ষমতা হারিয়ে ফেলবো। অনেক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এইরকম ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের মানুষকে সেসব সূত্র থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘আমি নিজের সমাজের জন্যে কী করেছি’ তার প্রমাণ দিতে হবে। নাহয় আমাদের জাগ্রত বিবেকের দংশনে আমরা ক্রমশঃ ভ্রষ্টজীবনের দিকে যেতে থাকবো।

রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম
ই-মেইল: rezasalimag@gmail.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭