ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

মুক্ত গণতন্ত্রের তালিকায় নেই ভারত?


প্রকাশ: 08/04/2023


Thumbnail

(পর্ব )

ভারতের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো চলছে না। ভারতের মিডিয়াও গত কয়েক বছরে অনেকটা নগ্নভাবেই সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা সরকারের চাপে রীতিমতো কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বে সংবাদ স্বাধীনতার পরিসংখ্যানে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত এখন ১৪২ নম্বরে অবস্থান করছে। সাংবাদিক নিপীড়ন এবং একের পর এক সাংবাদিককে কারাগারে নিক্ষেপ করায় ভারত তালিকায় ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে।

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য দুর্বল হতে থাকে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের তুষ্ট করার রাজনীতি দিয়ে মোদি অনন্য জনপ্রিয়তায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে দেশটির বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেন। এই ধারা দিন দিনই শক্তিশালী হচ্ছে। আজকের পর্বে আমরা গণতন্ত্র ভারতে নির্বাচন বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করবো।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২১ সালে জাতিসংঘে ভাষণে বলেছিলেন, ভারতগণতন্ত্রের জননী তাঁর দাবির মধ্যে অসারতা থাকলেও এই সেদিনও বিশ্ববাসী গর্ব করতেন, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ভারতের গণতন্ত্র ছিল আদর্শস্থানীয়।

তবে এখন সারাবিশ্ব, এমনকি মোদির অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীও বুক চাপড়ান, হিন্দু জাতীয়তাবাদী এই নেতার শাসনে ভারতের সেই গর্ব দ্রুত অপস্রিয়মাণ। সর্বশেষ, দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীকে রাজনৈতিক বক্তৃতার জন্য আদালতে দণ্ড দেওয়া এবং তড়িঘড়ি করে তাঁকে সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য করায় সমালোচকদের সেই কথাই শক্ত ভিত্তি পেয়েছে।

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য দুর্বল হতে থাকে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের তুষ্ট করার রাজনীতি দিয়ে মোদি অনন্য জনপ্রিয়তায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে দেশটির বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেন। এই ধারা দিন দিনই শক্তিশালী হচ্ছে।

ভারতে খুব সুন্দরভাবে বিকেন্দ্রীকৃত একটি প্রশাসনিক কাঠামো রয়েছে। এই কাঠামো অনুযায়ী একেকটি রাজ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত যে দল বা জোট রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জন করে, সেই দল বা জোটের নেতা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্য শাসন করেন। এর পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যে একজন করে রাজ্যপাল বা গভর্নর থাকেন। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগ দেওয়া এটি একটি আনুষ্ঠানিক, নিরপেক্ষ সাংবিধানিক পদ। রাজ্যসভার নির্বাচনের পর সবচেয়ে বেশি আসন জেতা দল বা জোটকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান রাজ্যপাল।

সাংবিধানিকভাবে নিরপেক্ষ পদ বলা হলেও এই পদকে প্রায় প্রতিটি সরকারই নিজ স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে   ধরনের একটি চেষ্টা রাজ্যপালের কার্যালয়ের নিরপেক্ষতাকে স্পষ্টতই ক্ষুণ্ন করেছে। সেখানে বিজেপিবিরোধী জোট বেশি আসন জিতেছে। সেখানকার রাজ্যপাল (যিনি মোদির পুরোনো সহযোদ্ধা ছিলেন) বজুভাই ভালা বিজেপিবিরোধী জোটকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানাতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু তিনি তা না করে মোদির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে কম আসন পাওয়া বিজেপিকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলেন। গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে শেষ পর্যন্ত ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করা জোটকে দিয়ে সরকার গঠনের আদেশ দেন। এরপর বিরোধী জোট সরকার গঠনের সুযোগ পায়।

পার্লামেন্টেও ঠিক একই ধরনেরক্ষয়দেখা যাচ্ছে। কয়েক দশক ধরে বিরোধী দলের জন্য সরকারের সমালোচনার ভেন্যু হিসেবে পার্লামেন্ট ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মাস কয়েক আগে বিরোধী নেতারা বেশ কয়েকবার সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আহ্বানের চেষ্টা করেছেন। পার্লামেন্টের অন্য সব কাজের তুলনায় অনাস্থা ভোটের প্রস্তাবকে সব সময় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু লোকসভার বিজেপি মনোনীত স্পিকার এক মাসের বেশি সময় ধরে বিরোধী নেতাদের অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছেন। পার্লামেন্টে বিজেপির জোরালো সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে এবং তার জন্য অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব কোনো হুমকিও নয়। শুধু অধিবেশন চলাকালে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে যখন বিরোধী নেতাদের মোদির অর্থনৈতিক কৌশলের ভুলত্রুটি তুলে ধরতে দেখা যায়, তখন সরকার একটু অস্বস্তিতে পড়ে।

মোদি সরকার স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের আজ্ঞাবহ করার যে অভিলাষ চরিতার্থ করছে, তার ছোঁয়া সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। সেখানে প্রধান বিচারপতির ঠিক করে দেওয়া বিচারপতিরা নির্দিষ্ট বিষয়ে রায় দিচ্ছেন। গত জানুয়ারিতে চারজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি প্রায় নজিরবিহীন একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তাঁরা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে রায় প্রভাবিত করতে নির্দিষ্ট বিচারকদের নির্দিষ্ট মামলার বিচার করতে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।

ভারতের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী মোদি সরকারের কড়া সমালোচক প্রশান্ত ভূষণ এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা ব্যাখ্যা করেছেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক স্পর্শকাতর মামলাগুলো বেছে বেছে এমন বেঞ্চে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে কোনো জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নেই। সরকারের পক্ষে যাতে রায় যায়, সে জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতি পরিষ্কারভাবে সরকারের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছেন। প্রশান্ত ভূষণের অভিযোগ, সরকার ক্ষমতাসীন দল প্রধান বিচারপতিকে ঘুষের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে একের পর এক ব্ল্যাকমেল করে যাচ্ছে।

এমনকি স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে নির্বাচন কমিশন এত দিন সবার শ্রদ্ধার জায়গা ছিল, তার বিরুদ্ধেও মোদির স্বার্থ রক্ষার্থে ভোটের তারিখ এগোনো-পেছানোর অভিযোগ উঠেছে। এটি মোটেও এখন আর চমকানোর মতো খবর নয় যে মোদির গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে এক সহযোগী সরকারি আমলা গত বছর পর্যন্ত ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই মুহূর্তে ভারতের হাতে গোনা দু-একটি ছাড়া সব সংবাদমাধ্যম মোদি আর তাঁর রাজনীতিরচিয়ারলিডারেপরিণত হয়েছে। তারা সরকারের সমালোচনামূলক রিপোর্টিং শুধু এড়িয়েই যায় না, বরং সরকারের পক্ষে ইনিয়ে-বিনিয়ে রিপোর্ট করতে থাকে। সমাজের একটি বিরাট অংশ মোদির এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পক্ষে হাততালি দিচ্ছে। বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠানে এভাবে রাজনীতি দলীয় আনুগত্য ঢুকে পড়ায় ভারতের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েই দেখা দিয়েছে সংশয়-সন্দেহ।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭