ইনসাইড আর্টিকেল

ইন্দোনেশিয়াতে পবিত্র রমজান পালনের ঐতিহ্য ও রীতিনীতি


প্রকাশ: 10/04/2023


Thumbnail

পবিত্র মাস রমজান। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সমগ্র বিশ্বের মুসলিমরা সিয়াম সাধনা শুরু করেছেন। রোজা পালনের মূল বিষয়গুলো সারা বিশ্বে এক হলেও রমজানকে কেন্দ্র করে একেক দেশের মানুষ মাসটি স্বাগত জানান ও উদযাপন করেন একেকভাবে। রমজান মাস উদযাপনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশের রয়েছে নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য ও রীতিনীতি। মনুষ্য বসতির ইতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো দেশ ইন্দোনেশিয়া। তিনশ’র বেশি জাতি-গোত্র আর সাড়ে সাতশ’র মতো ভাষা রয়েছে দেশটিতে। 

রমজান মাস শুরুর আগের দিন ইন্দোনেশিয়ায় মুসলিমরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিজেদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। মধ্য এবং পূর্ব জাভার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ নিজেদের শরীর শুদ্ধ করার প্রথা ‘পাডুসান’ পালন করেন। পাডুসান অর্থ গোসল করা। জাভানিজ মুসলিমরা ঝর্ণার পানিতে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীর ডুবিয়ে রেখে এটি পালন করেন। অথবা পুকুর বা জলাশয়ে, লেক বা সুইমিং পুলে গোসল করে শুদ্ধি প্রথা পালন করেন অনেকেই। 

ইন্দোনেশিয়ার ধর্ম এবং সংস্কৃতিতে পাডুসান হলো- শুদ্ধি প্রথা। জাভার সংস্কৃতিতে ঝর্ণার গভীর আধ্যাত্মিক গুরুত্ব রয়েছে এবং এগুলো পবিত্র মাসের জন্য শুদ্ধতা অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মনে করা হয়, ওয়ালি সঙ্গো এর প্রচলন শুরু করেন। ওয়ালি সঙ্গো হলো বিশিষ্ট ধর্মপ্রচারকের দল, যারা জাভাতে প্রথম ইসলাম প্রচার করেছিলেন।

আগে স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ ও ধর্মীয় নেতারা পাডুসানের জন্য কোনো পবিত্র ঝর্ণা নির্ধারণ করে দিতেন। কিন্তু এখন অনেকেই নিকটস্থ লেক অথবা সুইমিং পুলে গিয়ে অথবা বাড়িতেই নিজেদের শরীর শুদ্ধির এই প্রথা পালন করেন। কোভিড-১৯ এর মহামারির কারণে এবার পাডুসান প্রথা পালন নিষেধ করা হয়। তার পরও অনেক স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনেকে তা পালন করেছেন।

ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে ‘শরীর ও মনকে পরিশুদ্ধ’ করার এই রীতি প্রচলিত আছে। আর তা করা হয় নদী, পুকুর বা সমুদ্রে গোসল করার মাধ্যমে। ইসলাম ধর্মে ‘পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়’।   এই বিশ্বাস থেকেই ইন্দোনেশিয়ার বাসিন্দারা এ উৎসব পালন করে থাকেন। ক্লাটেন, বোয়োলাটি, সালাতিগা ও ইয়োগিয়াকার্তার বাসিন্দারা ‘পাডুসান’ উৎসব পালন করে থাকেন। রমজান শুরুর আগে এসব অঞ্চলের বাসিন্দারা নদী অথবা পুকুরে গোসল করে ও সাঁতার কেটে ‘পাডুসান’ পালন করেন।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করেন ইন্দোনেশিয়ায়। প্রায় ২৭ কোটিরও বেশি জনঅধ্যুষিত এই দেশের ৯০ ভাগই মুসলমান। তবে সরকারিভাবে ইন্দোনেশিয়া কোনো মুসলিম রাষ্ট্র নয়; ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে রয়েছে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ভিন্নতা। আরবীয়, ভারতীয়, চীনা, মালয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিশেল রয়েছে জীবনাচরণে। 


ইন্দোনেশিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম সাধনা করা হয়। দেশটিতে রমজান মাস শুরু হয় উৎসবের মধ্য দিয়ে। রহমতের মাসের চাঁদ ওঠার সংবাদ প্রচার হওয়ার পর তাদের মাঝে ব্যাপক উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদের পাশে কোনো খোলা জায়গায় বিশাল ড্রাম বাজিয়ে সবাই পরস্পরকে অভিনন্দন জানায়।

এ ছাড়াও স্থানীয় ঐতিহ্যের পরশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতেও দেখা যায় বৈচিত্র্য। এ কারণেই এ দেশে পবিত্র রমজান উদযাপনে পার্থক্য দেখা যায়। ইন্দোনেশিয়ার মধ্য জাভার সেমারাং শহরের বাসিন্দারা হাজার বছর ধরে ‘দুগদেরান’ নামের এক উৎসব পালন করে থাকেন। রমজান মাস শুরুর সংকেত হিসেবে প্রতি বছরই দেশটির মসজিদগুলোতে ঢাক পেটানো হয়। ‘দুগ’ শব্দটি এসেছে মসজিদের ওই ঢাকের শব্দ থেকে। এর পাশাপাশি মসজিদের কামান থেকে গোলাবারুদ ছোঁড়া হয়। ‘দার’ শব্দটি এসেছে কামানের ওই আওয়াজ থেকে। সাধারণত রমজান শুরুর দুই সপ্তাহ আগে থেকে সেমারাং শহরের বাসিন্দারা এ উৎসব পালন করে থাকেন। উৎসবে বাসিন্দারা রং বেরঙের পোশাক পরেন, শোভাযাত্রায় অংশ নেন।

অন্যদিকে পশু জবাই করার মধ্য দিয়ে পালিত হয় ‘মিউগানা’। এর আরেকটি নাম ‘মাকমিউগানা’। রমজান শুরুর দিন দুয়েক আগে পালন করা হয় এই রীতি। রমজান মাস শুরুর একদিন আগে সুদানিসির নৃগোষ্ঠী এ উৎসব পালন করে থাকে ‘মুংগাহান’। ‘মুংগাহান’র উৎপত্তি ‘উনগাহ’ শব্দ থেকে। যার অর্থ সামনের দিকে এগিয়ে চলা। রোজাদার যেন আগেরবারের চেয়ে আরও বেশি সংযমের সঙ্গে এবারের রোজা পালন করতে পারে, এ উদ্দেশ্যেই ‘মুংগাহান’ উৎসব পালন করা হয়।

বিভিন্নভাবে ‘মুংগাহান’ পালন করা হয়। যেমন, পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে খাবার খাওয়া, প্রতিবেশিদের সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত করা। অর্থাৎ এমন কিছু করা যেখানে পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়।

ইন্দোনেশিয়ায় ইফতারকে বলা হয় ‘বুকা’, যার অর্থ শুরু করা। ইফতার আয়োজনে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হলো ‘আবহাম’ নামের পানীয় এবং খেজুর। খেজুরের সঙ্গে ‘কোলাক’ নামে এক প্রকার মিষ্টান্নও পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া তারা রাতের খাবারে ভাত, সবজি, মুরগি ও গরুর গোশত খেতে পছন্দ করেন। তবে সেহেরিতে খাবার খায় খুবই সামান্য।  

দেশটির সুরাবায়া শহরে রমজানের শুরুতে ‘আপেম’ নামীয় একটি খাবার না হলে চলেই না। রমজানে তাদের প্রতিদিনকার খাবার এটি। তবে খাবারের চেয়ে এর উদ্দেশ্যটা বেশি চমৎকার। ধারণা করা হয়, ‘আপেম’-এর উদ্ভব আরবি ‘আফওয়ান’ শব্দ থেকে। যার অর্থ ‘দুঃখিত’। খাবারটিকে ‘ক্ষমা’র প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। তাই পরিবার-পরিজন সবাই একসঙ্গে ‘আপেম’ খাওয়ার পর একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আগের সব ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চান। ‘আপেম’ দেখতে চিতই পিঠার মতো। নারকেল ও চালের গুড়া দিয়ে এই স্ন্যাকসটি তৈরি করা হয়।

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় ‘নিওরোজ’ নামের উৎসব পালন করা হয়। ‘নিওরোজ’ শব্দের অর্থ পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করা। তাই রমজানের আগে বাবা-মা, দাদা-দাদী, শ্বশুরবাড়ির লোকজনসহ অন্যান্য স্বজনদের বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য পাঠানোর মাধ্যমে ‘নিওরোজ’ পালিত হয়। সাধারণত এই খাদ্যদ্রব্যের তালিকায় থাকে গোস্ত, কফি, দুধ, চিনি, মিষ্টি রসসহ অন্যান্য পণ্য। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে রমজান মাসের শুরুতে এ উৎসব পালন করা হয়।


ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা যথেষ্ট ধর্মপরায়ণ। তারা ধর্মীয় জীবনযাপন এবং সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। রমজানে তাদের ধর্মীয় এই স্পৃহা আরও বৃদ্ধি পায়। পুরুষের মতো নারীরাও মসজিদে তারাবির জামাতে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়।

রমজান মাসে ইবাদত, বন্দেগি ও কল্যাণমূলক কাজে ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের প্রতিযোগিতা চোখে পড়ার মতো। বড় বড় শহরে বসবাসকারী মুসলিমরা প্রায়শই রমজান মাসে, বিশেষ করে শেষের দিকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যায়। রমজান মাসের শেষে শ্রমিকদের দেওয়া হয় এক মাসের বেতনের সমান বিশেষ বোনাসের টাকা। ইন্দোনেশীয়রা একে ‘তের নম্বর মাসের’ বোনাস বলে থাকেন। ধনী থেকে মধ্যবিত্ত অনেকেই এ মাসে জাকাতের পাশাপাশি বাড়তি দান-খয়রাতের হাত বাড়িয়ে দেন।

বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মতো ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে আশ্রিত মুসলিম অভিবাসীরাও রোজা রাখেন। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় কুয়ালালাঙসা শহরের এই শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের শতাধিক নাগরিককে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার পক্ষ থেকে এসব মানুষের জন্য ইফতার ও সেহেরির আয়োজন করা হয়।

সমাজ থেকে অনাচার ও পাপাচার দূরীকরণে দেশটির সরকারের উদ্যোগ বেশ প্রশংসনীয়। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া থেকে সমস্ত যৌনপল্লী উচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে সে দেশটির সরকার। দেশটির ৭০টি জেলায় যৌনপল্লী উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখনও প্রায় শতাধিক যৌনপল্লী রয়েছে বিভিন্ন জেলায়। ২০১৯ সালের মধ্যে এগুলো উচ্ছেদ শেষ হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এভাবেই হয়তো এক সময় সামাজিক অবক্ষয় রোধে ব্যভিচার ও ব্যভিচারে উৎসাহী আনুসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়াবলিতে দেশটি ইসলামি অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করবে। আর সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে অপরাপর দেশগুলো ইসলামি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। প্রয়োগ করবে নিজ দেশে।

ইন্দোনেশীয়রা ঈদুল ফিতরকে ‘লেবারান’ বলে থাকে। রমজান মাসের শেষ দিনে সন্ধ্যা মেলানো মাত্র ঢোল বাজানো, নাচ, গান, নামাজ আর বয়ানের ভেতর দিয়ে উৎসব শুরু হয়ে যায়। বহু ইন্দোনেশীয় ঈদের নামাজের পর ঘরে ফেরার পথে পড়শি বা বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে যায়। প্রায়ই সংক্ষিপ্ত এইসব সফরে তাদের বিরুদ্ধে অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপার জড়িত থাকে। সত্যিই আাগের বছর আহত বা কষ্ট দেওয়া হয়েছিল এমন আত্মীয় ও বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাওয়া এই ছুটির দিনের বৈশিষ্ট্য।

ইন্দোনেশিয়ায় প্রচলিত লেবারান সম্ভাষণ হচ্ছে ‘সালামাত ঈদুল ফিতরি লাহির বাতিন’ যার অর্থ হচ্ছে ‘শুভ ঈদুল ফিতর, আমাদের সব পাপের জন্য ক্ষমা করো। ’ ঈদের দিন বেশিরভাগ ইন্দোনেশীয় বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে দিন শুরু করে, তারপর বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করে।

রিয়াও প্রদেশে ঈদ উৎসব পালন করা হয় একটু ভিন্নভাবে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে প্রদেশের বাসিন্দারা ঐতিহ্যবাহী নৌকাগুলো নিয়ে নৌকাবাইচের আয়োজন করে। যা ‘জালুর পাসু’ নামে পরিচিত। এ নৌকাবাইচের সময় শত শত মানুষ নদীর দুইপাড়ে ভীড় জমায়। তবে উৎসবটি নৌকাবাইচ দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় ‘বালিমা কাসাই’ দিয়ে অর্থাৎ নদীতে গোসল শরীর ও মনকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে। অনেকেই বলেন, এই গোসলের মধ্য দিয়ে তারা আত্মাকে পবিত্র করে নেয়। যেন পরের দিনগুলোতে আরও ভালোভাবে চলতে পারে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭