ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

কোয়াড-চীন বিতর্কে বাংলাদেশের দরকার ভারসাম্য রক্ষা করা


প্রকাশ: 11/04/2023


Thumbnail

যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের প্রধান শক্তিধর দেশগুলোর নজর এখন ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে। ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় এ অঞ্চলে বাংলাদেশের যথেষ্ট কদর রয়েছে। শুরু থেকেই ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর কৌশল (আইপিএস) নিয়ে অনেক দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করছে। একইসঙ্গে রয়েছে কিছু উদ্বেগও।

বাংলাদেশের আশঙ্কা, আইপিএসে যোগ দিলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। কারণ ২০১৮ সালে মার্কিন নেতৃত্বে গঠিত আইপিএসকে দেখা হচ্ছে চীনবিরোধী শক্তি হিসেবে। আবার যুক্তরাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন অংশীদার ও বৃহত্তম বিনিয়োগকারী। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করবে? কারণ, সময় এখন যে কোনো একটি বলয়কে বেছে নেয়ার দিকেই এগোচ্ছে।

এখন পর্যন্ত দেশ ও জোট মিলিয়ে ২০টি আইপিএস সদস্য রয়েছে। ২০০৭ সালে প্রথম আইপিএসের ধারণা নিয়ে আসেন জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। এর কয়েক বছর পর অস্ট্রেলিয়াও এ ধারণার গুরুত্ব বুঝতে পারে। এরপর ২০১৩ সালে আইপিএস হিসেবে চীনও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প চালু করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রও তার কৌশল ঠিক করে নেয়।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইপিএস নিয়ে বলেছিলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় কৌশল কোনো সামরিক জোট নয়। এটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক অঞ্চলের প্রতিযোগিতারও বিষয় নয়। আমরা ইন্দো-প্যাসিফিককে স্বতন্ত্র অঞ্চল হিসেবেই দেখি। তবে ফ্রান্স ও জার্মানি আইপিএসের ব্যাপারে স্পষ্ট করে জানিয়েছে, আইপিএসের মাধ্যমে চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য ঠেকানো এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেয়া হবে।

অনেকে আবার চীনকে বাংলাদেশের ‘সব আবহাওয়ার বন্ধু’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কও ঈর্ষণীয়। ভারতের অবজারভার ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ সবচেয়ে কম সংবেদনশীল প্রতিবেশীদের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের মোট আমদানি বাণিজ্যের ২৫ শতাংশই আসে চীন থেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের পণ্য।

শুধু আইপিএস নয়, চীনকে ঠেকাতে ২০০৭ সালে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত সামরিক জোট গঠন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কোয়াড নামেও এই জোটও বেশ আলোচিত। কোয়াডের পর যুক্তরাষ্ট্র গঠন করে অকাস, আর এখন আলোচনা কোয়াড প্লাস নিয়ে। সবকটি জোট গঠনের লক্ষ্য স্পষ্ট যে, সেগুলো চীনবিরোধী জোট।’

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনো সামরিক জোটে যুক্ত হয়নি। চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বাংলাদেশকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যদি চীনবিরোধী জোটে যুক্ত হয়, তাহলে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হবে।’ এদিকে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জানান, আইপিএস ইতিবাচক ও সম্মিলিত একটি রূপকল্প করতে চায়। এর আওতায় বাংলাদেশ, চীন, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ উন্নতি করতে পারবে। কৌশলটির অন্যতম মূলনীতি হলো, প্রতিটি দেশ কোনো চাপ বা জবরদস্তি ছাড়াই এতে যোগ দিতে পারবে।

শান্তি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ভূ-রাজনৈতিক কৌশল যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের এসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আইপিএস নিয়ে বাংলাদেশ যদি কোনো কৌশল ঠিক করে, তাতে ভারসাম্য থাকতে হবে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সাফল্য দেখিয়ে আসছে। চীনের বিআরআই, যুক্তরাষ্ট্রের কোয়াড-- উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ সতর্ক অবস্থায় ছিল। 

ডেভিড ব্রুস্টারের মতে, বিশ্বে ভূ-রাজনৈতিক যে পরিবর্তন তাতে বাংলাদেশের পছন্দ হোক বা না হোক, এর প্রভাব পড়বেই। এ অঞ্চলে শুধু বঙ্গোপসাগর নয়, মিয়ানমার, রোহিঙ্গা, জলবায়ু পরিবর্তন ও উগ্রপন্থার মতো ঝুঁকিও রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কীভাবে কৌশলগত পরিবর্তনে খাপ খাবে। এক্ষেত্রে কৌশলগত পরিবেশ নির্ধারণে জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের সঙ্গে কাজ করতে পারে ঢাকা।

কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ কোনো পক্ষে যাওয়ার অবস্থানে নেই। বাংলাদেশের কোনোভাবেই সামরিক ও কৌশলগত জোটে ঢুকে পড়া ঠিক হবে না। কারণ এতে বাংলাদেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হ‌বে এবং তা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার জন্য সুখকর হবে না।

বাংলাদেশের করণীয় কী?

এই উভয় সংকট মোকাবিলা করতে এই মুহূর্তে কোয়াডে যোগ দেয়া উচিত না৷ চাপ যতই থাকুক না কেন৷ তাদের বলতে হবে যে, আমাদের বিকল্প তোমরা দাও, তাহলে আমরা যোগ দিতে পারি৷’’

চীনের বিকল্প কোয়াড নয়। আমাদের চীনের কাছে যে প্রয়োজন  সেটা  ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র পারবে না৷ ফলে তাদেরকে বোঝাতে হবে। দেশের এমন একটা পরিস্থিতির জন্য গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবকে দায়ী করে বিশ্লেষ্করা বলছেন, ভারসাম্য রক্ষা করাটা এখন জরুরি৷

তাদের মতে, ‘‘যেকোনো সময়ের চেয়ে আমাদের জন্য এই সংকটটা খুব গভীর৷ এক্ষেত্রে প্রফেশনালিজমকে যদি অনেক গুরুত্ব দিয়ে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে স্বাধীনতা দেয়া হয়, তাহলে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়াটা তাদের জন্য সহজ হবে৷ ফলে রাষ্ট্র কিংবা সরকারের এই পরিস্থিতিটা অনুধাবন করা জরুরি৷’’

কোয়াড-চীন বিতর্ককে সংকট হিসেবে নয়, বরং সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন৷ তার দাবি, এমন অবস্থা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়৷

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ কখনো এমন অবস্থায় পড়েনি, বিষয়টি এমন নয়৷ এ ধরনের সিচুয়েশন কোল্ড ওয়ার পিরিয়ডে কিছুটা শুরু থেকে ছিল৷ বাংলাদেশের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল, বাংলাদেশের সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল৷ এর চেয়ে বড় বাস্তবতা তো হতেই পারে না৷ তখন থেকে বাংলাদেশে নন অ্যালায়েন্স নীতি নিয়ে, দুই পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিষয় ছিল৷’’

বিশ্বের দুই পরাশক্তি বলয় বাংলাদেশ নিয়ে যে টানাটানি শুরু করেছে সেটাকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখছেন এই বিশ্লেষক৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের জিও-পলিটিক্যাল অবস্থানটা আমাদের শক্তিকে আরও বৃদ্ধি করছে৷ আমাদের বার্গেনিং পাওয়ারকে আরও বাড়াচ্ছে৷ দুটি বড় পরাশক্তি আমাদের পাশে আছে সেটা আমাদের জন্য একটা বিশাল অ্যাডভান্টেজ৷’’



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭