ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

এশিয়ায় চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ কি ব্যর্থ হচ্ছে?


প্রকাশ: 12/04/2023


Thumbnail

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর আরেকটি জয়! গত মাসের শেষের দিকে বিদেশি পাঠকদের লক্ষ্য করে চীনা গণমাধ্যমে এমনই একটি খবর প্রচার করা হয়েছিল। খবরে বলা হয়, একটি চীনা কোম্পানি ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা ও বান্দুংয়ের মধ্যে উচ্চগতির রেলপথ স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করেছে।

২০১৫ সালে এই রেলপথ স্থাপনের কাজ পেয়েছিল চীন। সেসময় চীনা গণমাধ্যমে এটিকে একটি ‘অনুকরণীয় প্রকল্প’ বলে প্রচার করা হয়। পাশাপাশি, প্রকল্পটির বিরুদ্ধে সব সমালোচনাকে ‘পশ্চিমা অপবাদ’ বলে খারিজ করে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশে দেশে চীনা প্রকল্পগুলো ঘিরে বিভিন্ন সময়ে যে সন্দেহ ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটিরই চিত্রায়ন করেছে রেলপথটি।

এশিয়া ও ইউরোপকে সংযুক্ত করে অবকাঠামো নির্মাণে চীনা বিনিয়োগের লক্ষ্যে এক দশক আগে চালু হয়েছিল বিআরআই। এরপর সেটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সোমালিয়া থেকে পোল্যান্ড পর্যন্ত প্রায় ১৫০টি দেশের নাম জড়িয়েছে এ প্রকল্পে। গত মাসে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম এটিকে ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন প্রকল্প’ বলে অভিহিত করেছেন।

বিআরআই’র আগে অন্য এশীয় দেশগুলোতে চীনা বিনিয়োগ ব্যাপক দুর্নীতি, পরিবেশ ধ্বংস ও জাতীয় রাজনীতিকে বিকৃত করার মতো নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল। এমন প্রেক্ষাপটে চীনের অপরিহার্য দানশীলতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে সামনে আনা হয় বিআরআই। কিন্তু সেদিক থেকে এটি যথাযথভাবে কাজ করেনি।

চীনা নেতারা প্রকল্পটিকে সবসময় ‘উইন-উইন’ চরিত্রায়নের চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব এখনো সর্বজনীনভাবে স্বাগত নয়।

১৪২ কিলোমিটার জাকার্তা-বান্দুং রেলপথটি ভ্রমণকাল তিন ঘণ্টা থেকে মাত্র ৪০ মিনিটে নামিয়ে আনবে এবং জাকার্তার ভয়ংকর যানজট কমিয়ে দেবে। কিন্তু এ প্রকল্পটি চীনা অর্থায়নের কিছু সমস্যার চিত্রও তুলে ধরে। একটি হলো- যদিও চীনের আর্থিক শর্তাবলী অপেক্ষাকৃত সহজ মনে হয় এবং দক্ষ বাস্তবায়নের জন্য তাদের খ্যাতি রয়েছে, তবে চীনা প্রকল্পগুলো বিলম্ব ও সমস্যাপ্রবণ।

জাকার্তা-বান্দুং রেলপথের ক্ষেত্রে প্রথম সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল জাপানিরা। তবে জাপান ইন্দোনেশীয় সরকারের কাছ থেকে ৫০ শতাংশ অর্থায়নের গ্যারান্টি দাবি করেছিল। বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের প্রস্তাবের কোনো গ্যারান্টির প্রয়োজন ছিল না এবং তুলনামূলক সাশ্রয়ী বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু আগামী জুলাই মাসে রেলপথটি যখন চালু হবে, তখন এটি বাজেটের চেয়ে কয়েকশ’ কোটি ডলার বেশি খরুচে এবং নির্ধারিত সময়ের চেয়ে চার বছর পিছিয়ে থাকবে।

প্রকল্পটির ৬০ শতাংশ মালিকানা ইন্দোনেশিয়ার। প্রাথমিকভাবে এতে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নিয়ে অর্থায়ন করা হয়েছিল। সহজ শর্তের এই ঋণে সুদের হার মাত্র দুই শতাংশ এবং পরিশোধের সময়কাল ৪০ বছর। এ কারণে এটি কোনো ‘ঋণের ফাঁদ’ কৌশলের অংশ, তা মানতে নারাজ চীন।

কিন্তু সমালোচকদের দাবি, চীন প্রথমে তার অংশীদারদের অস্থিতিশীল ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলে, এরপর খুশিমনে দখল করে নেয়।

২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তারা ২২টি দেশকে ২৪ হাজার কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। তবে এর প্রায় পুরোটাই গেছে বিআরআই প্রকল্পে জড়িত দেশগুলোতে। এছাড়া, চীন কখনো কখনো আন্তর্জাতিক সার্বভৌম ঋণ ছাড় প্রচেষ্টায় বাধাও সৃষ্টি করেছে, যা তার ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।

চীনের ‘ঋণের ফাঁদ কূটনীতির’ আরেকটি উদাহরণ হলো শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় চীনা অর্থায়নে তৈরি বন্দর। ২০১০ সালে বন্দরটি চালু করা হয়। কিন্তু লঙ্কান সরকার দ্রুতই চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে এবং বন্দরটি গ্রহণ করতে চীনকে অনুরোধ জানায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ৯৯ বছরের জন্য হাম্বানটোটা বন্দর ইজারা নেয় একটি চীনা প্রতিষ্ঠান।

এই ঘটনাটি শ্রীলঙ্কার জাতীয় আত্মসম্মানের ওপর বড় আঘাত ছিল এবং এটি সাধারণ শ্রীলঙ্কানদের ক্ষুব্ধ করে। ঘটনাটি চীনা প্রকল্পগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্যকে চিত্রিত করে- স্থানীয় অসন্তোষ সৃষ্টি।

চীন তার অর্থনৈতিক শক্তির অপব্যবহার করছে, এমন ধারণা গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে বিস্তৃত। সিঙ্গাপুরভিত্তিক থিংক-ট্যাংক আইসিস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের আসিয়ান স্টাডিজ সেন্টার এ অঞ্চলের ১ হাজার ৩০০’র বেশি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ীসহ অন্যান্যদের মতামতের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত সেই জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, যারা চীনকে এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী কৌশলগত শক্তি মনে করেন, তাদের ৭০ শতাংশই দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে উদ্বেগের সঙ্গে দেখেন। সুতরাং, চীনের ‘উইন-ইউন’ অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য এই মুহূর্তে আরও ভালো প্রচারণার বিকল্প নেই।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭