ইনসাইড বাংলাদেশ

বাঙালির সংস্কৃতিকে হুমকি, মঙ্গল শোভাযাত্রা ঘিরে সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র!


প্রকাশ: 12/04/2023


Thumbnail

বাংলা নববর্ষ ১৪৩০ উদযাপন উপলক্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজ শিরকের। এখানে এসে ক্ষতি করো না তোমাদের। হামলা হতে পারে এনি টাইম- ঐদিনের দাজ্জালি বাহিনী পাবেনা টের মোদের।’- লেখা একটি চিরকুট দিয়ে এই হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র। সূত্র বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের আবতাহী রহমান (২৫) নামে এক শিক্ষার্থীর কাছে এই চিরকুট পাঠানো হয়েছে। বুধবার (১২ এপ্রিল) এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থী শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ। ওই শিক্ষার্থী আবতাহী রহমান (২৫) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন কমিটির অর্থ ও নিরাপত্তাবিষয়ক সদস্য।

জানা গেছে, মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাত পৌনে ১০টার দিকে চারুকলা অনুষদ পশ্চিম পাশের দেওয়ালে রঙের কাজে তদারকি করার সময় প্লাস্টিক চেয়ারের ওপর সাদা কাগজে পঞ্চাশ টাকার নোট পাওয়া। ওই কাগজে লেখা দেখতে পাওয়া যায়- ‘শোভা যাত্রা কাজটা শিরকের এখানে এসে ক্ষতি করোনো তোমাদের। হামলা হতে পারে এনি টাইম ঐদিনের দাজ্জালি বাহিনী পাবেনা টের মোদের।’

সূত্র জানায়, ২০০১ সালে রাজধানীর রমনার বটমূলে ছায়ানটের বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। ওই হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে আঘাত হানতে মৌলবাদী গোষ্ঠী সেই হামলা চালিয়েছিল বলে পরে তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল। এর পর থেকেই প্রতিটি বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। 

একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা এবং ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গাথা। ২০২২ সালের ১৪ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) এই দুটি হামলা মামলার একটিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং অপরটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি শফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। মুফতি শফিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সূত্র জানায়, ২০০১ সালে পহেলা বৈশাখের দিন ভোরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলে দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয় এবং পরে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে তা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি এবং ১০-১৫ মিনিট পর আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। ঘটনাস্থলে সাত ব্যক্তি প্রাণ হারান। পরে আরও তিনজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র চন্দ ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। এতে ১৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। 

এ ঘটনায় করা দুই মামলার মধ্যে হত্যা মামলার রায় হয় ২০১৪ সালের ২৩ জুন। রায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ দেন আদালত। কারাগারে থাকা অপর ৯ আসামি হলেন- মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলাল উদ্দিন, শাহাদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ ও হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া। এ ছাড়া শীর্ষ জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সীর ফাঁসি কার্যকর হয় অপর এক মামলায়। ফলে এই মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

আসামিদের মধ্যে পলাতক ৪ আসামি হলেন- সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুল ইসলাম ও মুফতি আবদুল হাই। তাদের মধ্যে  ১৪ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) মুফতি শফিকুল ইসলামকে ভৈরব থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

এদিকে গত ৯ এপ্রিল (রোববার) মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অসাংবিধানিক, বেআইনি ও কৃত্রিম উদ্ভাবিত দাবি করে পহেলা বৈশাখ এটা বন্ধে সরকারের মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি লিগ্যাল (আইনি) নোটিশ পাঠানো হয়। রেজিস্ট্রি ডাকযোগে সংশ্লিষ্টদের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান। লিগ্যাল নোটিশে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিনকে বিবাদী করা হয়। 

আইনী নোটিশে বলা হয়েছে, পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাজার বছর ধরে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাঙালি জনগণ একে অপরের ধর্মকে সম্মান করে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে এক ধরনের কৃত্রিম কার্যকলাপ বাঙালি সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত, এই কৃত্রিম উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ১৯৮৯ সালে পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা নামে এক ধরনের পদযাত্রা শুরু হয়। পরে এই আনন্দ শোভাযাত্রাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নামকরণ করা হয়।

নোটিশে আরও বলা হয়, ‘মঙ্গল’ শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘মঙ্গল’ প্রার্থনা করেন। এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-ক এর সরাসরি লঙ্ঘন।

এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে অপমান করা হচ্ছে, যা দণ্ডবিধির ২৯৫-ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে এখনও সাম্প্রদায়িক শক্তির একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তারা দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রখর নজরদারির কারণে এই ষড়যন্ত্র ফলপ্রসু হয়ে ওঠে না। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালায় এই চক্রটি। যে হামলায় ২৪ জন নিহত হন এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০জন লোক আহত হয়েছিলেন। ওই চক্রটি এখনও সরকার বিরোধী নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা জঙ্গি হামলা থেকে শুরু করে নানামুখী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফলকাম হতে পারেনি। 

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, ২০০১ সালে পহেলা বৈশাখের দিনেও তারা বোমা হামলা চালিয়েছিল- যা বাঙালির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার একটা ষড়যন্ত্র ছিল। ওই হামলায় ১০ জন নিহত হন। কিন্তু বাংলার মানুষ জীবন বিসর্জন দিলেও বাংলার সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেয়নি। এখনও রমনার বটমূলে বর্ষ বরণ উৎসব হয়। এখনও বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। এখন কেবলই দেখার বিষয় এসব সাম্প্রদায়িক শক্তি এ ধরনের ষড়যন্ত্র করে বাঙালিকে রুখে দিতে পারে কি না? 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭