ইনসাইড থট

রোহিঙ্গা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ: আমাদের কি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?


প্রকাশ: 15/04/2023


Thumbnail

ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি: তার সাম্প্রতিক সফরের পর রাশিয়া ছেড়ে যাওয়ার সময়, বিদায় মুহুর্তে চীনা শীর্ষ নেতা শি জিংপিং রাষ্ট্রপতি পুতিনকে বলেছিলেন "একত্রে আমাদের উচিত এই পরিবর্তনগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যা গত ১০০ বছর ধরে ঘটেনি"। এই পরিবর্তনটা কি? তারা কি তাদের গোপন পরামর্শের সময় ডলার এবং পশ্চিমা মুদ্রার আধিপত্য, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য কমানোর বিষয়ে আলোচনা করেছিল? ১০০ বছরের আধিপত্য বদলানোর লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা কি একটি কৌশল নিয়ে আলোচনা করে সম্মত হয়েছিল? আমরা সেটা জানি না তবে শি জিংপিংয়ের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, আর সেই পরিবর্তন নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর কি প্রভাব ঘটাবে, আমাদের সকলের তা গভীর বিশ্লেষণ এবং বোঝার প্রয়োজন। চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠেছে এবং ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি শীঘ্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম বা ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে রাশিয়া এখনও পরমাণু অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডারের পরাশক্তি। এশিয়া, আফ্রিকা (যেখানে ফরাসিদের আধিপত্য কমছে), ল্যাটিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে রাসিয়া আর চীনের প্রভাব বাড়ছে। ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ক্রমবর্ধমানভাবে ভূ-রাজনীতিতে তার শক্ত পদচিহ্ন রাখছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলি ভারতকে তাদের স্বার্থ এবং আগ্রহ নিয়ে কথা বলার জন্য দুর্বার চাপ দিচ্ছে। উন্নত বাজার আর ১.৪ বিলিয়ন জনগনের ভারতের সমর্থন তাদের অনেক প্রয়োজন (ভারতের টাটা ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি মূল্যের ৪৫০টির বেশি বোয়িং এবং এয়ারবাস বিমানের অর্ডার দেওয়ার পরে, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বাইডেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সুনাক ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিস্টার মুদির সাথে ফোনে কথা বলে তাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন)। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গা, ওয়ারশ চুক্তি এবং ১২০টি দেশের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (NAM) বিলুপ্ত হবার পর থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী পুলিশ ম্যান হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে একক সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন দেশে তাদের ইচ্ছামতো আক্রমণ করে এবং প্রয়োজনে শাসক আর শাসন পরিবর্তন করছে। সামরিক শক্তির চেয়ে বেশি, পেট্রো ডলার আর ডলার বিশ্বের একমাত্র রিজার্ভ কারেন্সি হয়ে উঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশাল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে।

নতুন বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের আর জাপানের বেশিরভাগ শিল্প, অবকাঠামো, আর্থিক সক্ষমতা আর সামরিক আধিপত্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকায় পার্ল হারবার বন্দর ছাড়া আর কোনো ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি। আমেরিকার শিল্প ও অর্থনীতি অক্ষত ছিল। পুনর্গঠনের জন্য ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের (অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ন্যাটো আক্রমণে মার্কিনকে সমর্থন করেছিল) কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না। এই দেশগুলি তাদের অস্ত্র এবং পুনর্গঠনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিয়েছিল, যা তাদের ফেরত দিতে হয়েছে বা এখনও ফেরত দিতে হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে যুক্তরাজ্যকে ৪.৩৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রসারিত করেছিল, যার ফলে যুক্তরাজ্য তার প্রায় সমস্ত সম্পদ অর্ধ দশক ধরে যুদ্ধে নিয়োজিত করার পর দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা পায়। আজকের টাকায় ১১৯ বিলিয়ন পাউন্ডের সমতুল্য এই ঋণটি সেই সময়ে ব্রিটিশ অর্থনীতির দ্বিগুণ ছিল। সে সময় কানাডা যুক্তরাজ্যকে ১.২৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। ১৯৫০ সাল থেকে ব্রিটেন ঋণের অর্থ পরিশোধ করছে আর ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্য তার ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে।

এই ভাবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তির ঘর আর সামরিক শক্তির দেশে পরিণত হয়। ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন ডলার বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অন্যান্য ৪৪টি পশ্চিমা দেশ বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ তৈরি করে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় শেয়ার হোল্ডার এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মালিক হয়ে উঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখন স্বর্ণের রিজার্ভ অনুযায়ী জাতীয় মুদ্রার মান পরিমাপ করা হতো। ১৯৭০ এর দশকে পেট্রো ডলারের (ডলারে পেট্রোল বিক্রি এবং কেনা) উত্থান মার্কিন অর্থনৈতিক আধিপত্যকে আরও সুসংহত করেছিল। ১৯৭১ সালে আমেরিকা একতরফাভাবে মার্কিন ডলারের স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্যতা বন্ধ করে দেয় - ব্রেটন উডস চুক্তির সমাপ্তি হয়। ১৯৭৩ সালে, ১৫টি দেশের ২৩৯টি ব্যাংক একত্রে ক্রস বর্ডার পেমেন্টের সুবিধার্থে SWIFT তৈরি করে। সদর দপ্তর হয় বেলজিয়ামে। যদিও সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর অনেক নিয়ন্ত্রণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকে। ডলারের আধিপত্যের কারণে আমেরিকা প্রয়োজনে তার মিত্রসহ যেকোনো দেশের ওপর যে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার শক্তি অর্জন করে। তাই আজ তাদের অর্থনীতি ও নাগরিকদের সমৃদ্ধি রক্ষায় বিশ্বের কোনো দেশই আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পায় না।

এখন ভূ-রাজনৈতিক ও আর্থিক আধিপত্যের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। কিছু দেশে পারমাণবিক অস্ত্রের পাশাপাশি অন্যান্য বড় দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের একক সামরিক শক্তির আধিপত্য কমছে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং প্রভাব বজায় রাখতে অর্থনৈতিক আধিপত্য, ডলারের আধিপত্য ধরে রাখতে হবে - যা আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তার উদ্বেগের কারন। আমি আশা করি সবার ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের (গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল একটা অজুহাত) পেট্রোলের মূল্য ডলারে নয়, ইউরোতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল পাপ আর এর পরিণতির কথা মনে আছে। একই ভুল লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি এবং ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ করেছিলেন। এই তিনটি দেশকে কোনো করুণা ছাড়াই তার সিদ্ধান্তের জন্য ভুগতে হচ্ছে। অন্যদিকে চীন একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া কিছুটা সমস্যায় পড়েছে। কিন্তু যুদ্ধের কারনে ইউক্রেন এবং এর জনগণ ব্যাপক ধ্বংস, প্রাণহানি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলি ইউরোপীয় অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপক ভাবে বাড়ছে। ইউরোপের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আবার সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।


আমি জানি এটি আমার একান্ত নিজস্ব, আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক এবং জ্ঞান দ্বারা ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি খুব সরল ওভারভিউ। তবে আমি আশা করি আমার সরল বর্ণনা চিন্তা এবং আরও বিশ্লেষণের জন্য কিছু তথ্য সরবরাহ করবে।

বর্তমান পরিস্থিতি: সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গা এবং জার্মানির একীকরণের পর ন্যাটো রাশিয়ার দোরগোড়ায় প্রসারিত হয়। কিছু ন্যাটো দেশ পারমাণবিক অস্ত্রাগার সহ, বিমান ও সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী হয়ে উঠে। ইউক্রেন যুদ্ধ আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোকে রাশিয়াকে কিছুটা হলেও দমন করার সুযোগ দিয়েছে। তাই আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর মূল লক্ষ্য এখন চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫০টি বিদেশী সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সম্প্রতি তারা আবার ফিলিপাইনে ঘাঁটি খুলেছে। নতুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, তথাকথিত "চতুর্ভুজ" গঠন হয়েছে। ফ্রান্সের সাথে চুক্তি বাতিল করে অস্ট্রেলিয়া পারমাণবিক সাবমেরিন কেনার জন্য এবং তার রক্ষণাবেক্ষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সাথে সম্মত হয়েছে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আরও বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। তাইওয়ান একটি গরম ইস্যু হয়ে উঠছে। সুতরাং, চীন ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দ্বারা বেষ্টিত হচ্ছে।

অন্যদিকে, চীন আজ আর ব্রিটিশ ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের দেশ নয়, অবাধ বাণিজ্য এবং নৌ চলাচলের স্বাধীনতার নামে আফিম ব্যবসার একটি অতি দরিদ্রের দেশ নয়, যে দেশকে ধ্বংসাত্মক প্রথম এবং দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। চীনা জনগণ তাদের অতীত ইতিহাস ও নিপীড়নকে কখনো ভুলতে পারবে না। চীন আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ধীরে ধীরে সুদূরপ্রসারী পারমাণবিক সক্ষমতা সহ তার সামরিক, বিমান ও নৌ বাহিনী গড়ে তুলছে। চীনের এখন চীনের বাইরে আটটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ভারত আর ভিয়েতনামের সাথে সীমান্ত বিরোধে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ ছাড়া, চীন কোন দেশ আক্রমণ করেনি। চীনকে এখন রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং অন্যান্য ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সীমান্ত (সমুদ্র সীমানার দাবি ছাড়া) নিয়ে বেশী মাথা ঘামাতে হচ্ছে না। ভারতের সাথে এখনও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ এবং সীমান্ত বিরোধ চলছে। তবুও ভারত ব্রিকস (BRICS) জটে চীনের সাথে যোগ দিয়েছে। চীনের সাথে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা এবং সামরিক সরকারের সাথে চীনের সুসম্পর্ক এবং প্রভাব রয়েছে।ঐতিহাসিক কারণে জাপান মিয়ানমারের সাথে তার সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন বজায় রেখেছে। যদিও চীন সামরিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তবে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে এবং আমেরিকার জন্য এখন বড় হুমকির কারন নয়। চীন সক্রিয়ভাবে ডলারের পরিবর্তে নতুন রিজার্ভ কারেন্সি ব্যবহার সক্রিয়ভাবে প্রচার আর প্রসারিত করছে এবং নিজের বিশাল সোনার রিজার্ভ তৈরি করছে। চীন এশিয়ান, আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে। উপরন্তু, ঋণ খেলাপি হওয়া থেকে অনেক দেশকে রক্ষা করার জন্য একটি বিকল্প আইএমএফের মত ঋণ দিচ্ছে। চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য বিশাল হয়ে উঠছে। চীন এসব দেশেও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে। ১.৪ বিলিয়ন লোকের দেশ চীনের জনগণের ক্রয় ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশগুলির তাদের নিজস্ব অর্থনীতির জন্য চীনের সাথে বাণিজ্য করার ছাড়া অল্প কিছু বিকল্পের পথ দেখতে পারছে। সুতরাং, সামরিকভাবে নয়, চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক আধিপত্যের কারনে চীন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য আর নিরাপত্তার হুমকি হয়ে উঠছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা শক্তিগুলির আন্তর্জাতিক নিয়ম এবং জাতিসংঘের সনদকে সম্মান না করে সামরিক শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, রিজার্ভ মুদ্রার অস্ত্রায়ন, সুইফট এবং ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলি এবং সামরিক শক্তিগুলি ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে এবং এই প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে এবং একটি বহুমুখী বিশ্ব গড়তে চাইছে। ব্রিকস (BRICS) দেশ এবং জোটে যোগদান করার জন্য ক্রমবর্ধমান অন্যান্য দেশেও আবেদন করছে। ব্রিকস তার নিজস্ব ব্যাংক চালু করেছে। ব্রিকস একটি পাওয়ার হাউসে পরিণত হচ্ছে। আমেরিকান রিজার্ভ ব্যাঙ্কে রক্ষিত আফগানিস্তানের ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেয়াপ্ত করা, আর ইউক্রেন যুদ্ধের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর রাশিয়ার ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশী অর্থ বাজেয়াপ্ত করার কারনে চীন সহ অনেক দেশের, যাদের বিপুল পরিমান অর্থ মার্কিন রিজার্ভ ব্যাঙ্কে রয়েছে, তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা আরও বাড়ছে, এবং তারা SWIFT এর বিপরিত ভিন্ন ক্রস-ফাইনান্সিয়াল পেমেন্ট সিস্টেমের পাশাপাশি ডলারের পরিবর্তে বিভিন্ন রিজার্ভ মুদ্রার বিভিন্ন প্রক্রিয়া খুঁজছে। চীন এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে তাই চীন মার্কিন আধিপত্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এটি বন্ধ করতে, এমনকি এর মিত্রদের ভোগান্তির মূল্যে হলেও যুক্তরাষ্ট্র সব কিছু করছে এবং করবে।

এবার রোহিঙ্গা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে ফিরে আসা যাক: মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতা দখল করার পর মিয়ানমারের জনগণ অবস্থার পরিবর্তনের সন্ধান খুঁচছে এবং সংগ্রাম করছে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের অধিকাংশই মুসলিম এবং তাদের মধ্যে কিছু জঙ্গি, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর পাশাপাশি কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী দলও রয়েছে। আগেই বলেছি জাপানের মিয়ানমারে থাকার ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। যদিও চীন ও ভারতের নিজস্ব দ্বন্দ্ব রয়েছে, তবুও চীনের পাশাপাশি ভারত, উভয় দেশ ভূ-রাজনৈতিক কারণে মিয়ানমার নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী, চিন্তিত এবং জড়িত। মিয়ানমারে আমেরিকার স্বার্থ কী হবে? চীনকে ঠেকাতে যেমনটি আমি বর্ণনা করেছি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় উপস্থিতি রয়েছে (প্রায় ৪০০ ঘাঁটি, প্রায় ৩০০,০০০ সৈন্য এবং ৬০% মার্কিন নৌবাহিনীর নৌবহর শুধুমাত্র প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় আছে)। পাকিস্তানেও, বিশেষ করে সেনা জেনারেলদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় প্রভাব রয়েছে। কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে বিবেচিত হলেও গত বছর ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর, ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়ানোর প্রচেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্র লাওসের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়ন করছে। মঙ্গোলিয়া এবং উত্তর কোরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি প্রভাব নাও থাকতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধ, ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা এবং রিজার্ভ তহবিল বাজেয়াপ্ত করার কারনে রাশিয়া ও চীন অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তারের এবং ন্যাটো সম্প্রসারণের মতো চীনকে আরও ঘেরাও করতে সেখানে হয়তো একটি সেনা ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করবে। মার্কিন সমর্থনে মিয়ানমারে সামরিক সরকার বা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনই হবে তা অর্জনের সর্বোত্তম উপায়।

আমরা জানি আফগানিস্তানে রাশিয়াকে পরাজিত করতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ব্যবহার করে সেখানে থাকা শত শত আফগান শরণার্থীর মধ্যে থেকে তালেবান তৈরি করেছে এবং আল কায়েদা উপাদানের জন্ম দিয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহ করেছে। কেন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ধর্মান্ধ মুসলিম গোষ্ঠীকে বেছে নিয়েছিল? কারণ তারা জানে মুসলিম ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দলগুলো কমিউনিস্টদের (অবিশ্বাসী) ঘৃণা করে এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের জীবন দিতে দ্বিধা করবে না – সেটা রাশিয়া হোক বা চীন। মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমানে কিছু গ্রুপ ইতিমধ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের প্রয়োজন। কিছু বিভিন্ন উৎস থেকে তারা এখন তাদের অস্ত্র পাচ্ছে। কমিউনিস্ট বিরধি মুসলিম ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর মধ্য থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জান্তাকে পরাজিত করার লক্ষে তালিবানের মত রোহিঙ্গাদের নিয়োগ করা কঠিন কাজ হবে না। তবে তাদের প্রশিক্ষণে সমর্থন করতে বা দিতে এবং তাদের অস্ত্র সরবরাহ করতে পাকিস্তানের মতো একটি দেশের দরকার। এমন কাজে ভারতের সহায়তা প্রশ্নের বাইরে। যদিও বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে চিত্তাকর্ষকভাবে এগিয়েছে, তবুও এটি এখনও অনেক ক্ষেএে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশে এখনো যথেষ্ট সংখ্যক লোক আছে যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না এবং মোস্তাকের মত বিপুল সংখ্যক মানুষ, নেতা, ব্যবসায়ী মানুষ, সংবাদ মিডিয়া আর বুদ্ধিজীবীদের এখনো কেনা সহজ। তাই পাকিস্তানের মত তাদের লক্ষ্য সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশে চাপ সৃষ্টি করা বা দেওয়া সহজ হতে পারে। প্রয়োজনে শাসন পরিবর্তনের জন্য সমর্থন প্রদান করা। সর্বপরি একটা সহযোগিতামূলক এবং আনুগত্যকারী সরকারের সাথে তাদের ইচ্ছা আর স্বার্থ অর্জন করা অনেক সহজ হবে। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে দশটি ট্রাক পূর্ণ অস্ত্র বাংলাদেশের সাহায্যে স্থানান্তরের চেষ্টা করা হয়েছিল।

আমাদের প্রশ্ন করা দরকার, কেন হঠাৎ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা বা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বা দুর্নীতি নিয়ে এত সোচ্চার হয়ে উঠছেন? ১৯৭৫ সালের মতো মার্কিন দূতাবাসে অবস্থানরত অজানা সিআইএ প্রধান কী ভাবছেন বা করছেন? কেন একের পর এক উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তারা তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বাংলাদেশে আসছেন? কেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের জন্য আমন্ত্রণ জানাননি (উদাহরণস্বরূপ মিশর এবং পাকিস্তানকে আমন্ত্রণ জানানো বিবেচনা করলে বলা যা, এটি গণতন্ত্রের কোন বিষয়ে নয়)? কেন এই বছর আমেরিকান তৈরি মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশকে খারাপভাবে প্রতিফলিত করা হল, এত বছর পর ২০১৮ সালের নির্বাচন উত্থাপিত হল? প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে নির্বাচনের কথা বললেন কেন? কেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রে তার মার্কিন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে হলো? কেন আমরা দেখছি বাংলাদেশে এবং বাইরের কিছু গোষ্ঠী সহ সংবাদ মাধ্যম হঠাৎ করেই মিথ্যা এবং ভুয়া খবর প্রচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে (মনে রাখবেন ১৯৭৪/৭৫ সালে কী ঘটেছিল, কি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল এবং জাতির পিতাকে হত্যা করে শাসন পরিবর্তনের ঘটনার কথা)। উদাহরণ স্বরূপ মিশর, পাকিস্তান, কয়েকটি আরব দেশ এবং ইজরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থনের দিকে তাকালে মনে হয় কি তারা সত্যিই মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা বা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাস করে? এটা কি আসলেই গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা বা মানবাধিকার নিয়ে, নাকি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো প্রশিক্ষণ বা অস্ত্রের ঘাঁটিতে পরিণত করতে বর্তমান সরকারকে রাজি করাতে বাধ্য করার জন্য একটা সাজানো ভয়ঙ্কর খেলা চালানো হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বেশি স্বাধীন বা দৃঢ়চেতা হয়ে উঠছে। যদিও আমরা জানি না পর্দার আড়ালে কী ঘটছে। যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন হুকুম না মানেন, তাহলে এটা কি শাসন পরিবর্তনের করে, তাদের কথা মানার শাসককে বসানার পরিকল্পনা বা হুমকি?

ভারত বাংলাদেশকে বিদ্রোহের ঘাঁটিতে পরিণত করার জন্য দুইবার চিন্তা করবে, কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদে নিজের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠতে পারে। মিয়ানমারের স্বৈরশাসকরাও অলসভাবে বসে থাকবেন না। চীনও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে এবং পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় বাংলাদেশ যদি কখনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করে তাহলে চীন নিশ্চয় মিয়ানমারকে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে। সে অবস্থায় মিয়ানমারের সঙ্গে সংঘর্ষ, বিমান, নৌ ও কামান বিনিময় হলে বাংলাদেশ কি পারবে দেশের অনেক বছরে কঠোর প্রচেষ্টার দেশের অবকাঠামো ও শিল্প-কারখানার ব্যাপক ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে? বন্ধ করতে পারবে আরো শরণার্থী বাংলাদেশে আসার এবং সকল অর্জন ধ্বংস হয়ে যাবার? বাংলাদেশ পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো, একটি ব্যর্থ দেশে পরিণত না হবার? কিছু দল, বুদ্ধিজীবী এবং সংবাদ মিডিয়া সহ আমাদের নিজেদের কিছু বাংলাদেশিদের সক্রিয় মিথ্যা, নোংরামির খেলা দেখে আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন। মনে রাখতে হবে মিরজাফররা বারবার বাংলার মাটিতেই জন্মেছে।

এটি কেবলমাত্র আমার সীমিত ছোট মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ, যা সত্য নাও হতে পারে তবে আমাদের অবশ্যই বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে এবং আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমি আশা করি, বাংলাদেশের জনগণও ভাববে, যদি আমরা ভুলভাবে দেশি-বিদেশি উপাদান দ্বারা ভুলভাবে প্রভাবিত হই তাহলে বাংলাদেশের কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা আরও উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি চায় কি না, নিজের এবং তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত তৈরি করতে চায় নাকি অনিশ্চয়তা ও দারিদ্রের মধ্যে এবং কোনো আশা ছাড়াই বাস করতে চায়। আসন্ন মাস এবং বছর আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা যখন ভোট কেন্দ্রে যাবো এবং আসন্ন নির্বাচনে ভোট দেব তখন আমাদের সাবধানে চিন্তা করতে হবে। আমরা কি গর্বিত ও স্বাধীন হতে চাই নাকি বিদেশী সরকারের অধীন হতে চাই? বাংলাদেশে আপামর জনগন গত কয়েক দশক বিশ্বকে দেখিয়েছে যে তারা একটি উদাহরণ/পার্থক্য সহ, দেশের উন্নয়ন করতে পারে এবং মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভবিষ্যত প্রজন্মের অনেক লাভ বা ক্ষতি করার সুযোগ আছে, যদি তারা সঠিক বা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। আসুন আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং অহংকার রক্ষা করতে একসাথে থাকি, যাতে কেউ বা কোন শক্তি যেন আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কেড়ে নিতে না পারে। হয়ত সবচেয়ে খারাপের মধ্য থেকে আমাদের সার্বভৌমত্বের সমর্থক কম খারাপ/সেরাদের বেছে নিতে হবে। আমি মনে করি আমাদের কাছে এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় বিকল্প নেই। আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য, একটি গর্বিত জাতি হতে, আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমাদের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আরো বেশি প্রয়োজন।

Prof Dr Quazi Monirul Islam, MBBS, MPH, FRCOG
Epidemiology Department, Prince of Songkla University, Hat Yai, Thailand
Senior Specialist, International Centre for Migration, Health and Development
Former Senior Specialist (Maternal and Newborn), Liverpool School of Tropical Medicine, UK
Former WHO Director and Country Representative to Thailand and Namibia



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭