এডিটর’স মাইন্ড

‘তাজউদ্দীন’রা কেন উপেক্ষিত


প্রকাশ: 17/04/2023


Thumbnail

১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। ’৭১ সালের এই দিনে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয়। সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলায় এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম মন্ত্রিসভা দায়িত্ব গ্রহণ করে। বৈধ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মুজিবনগর’। ইতিহাসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এ সরকারকে ‘মুজিবনগর সরকার’ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। আমার বিবেচনায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১০ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল সময়কালটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএমএ এবং এমপিরা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম নির্বাচিত হন উপরাষ্ট্রপতি। আর তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিশ্চিত করতে তিনি এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের পর তাজউদ্দীন আহমদই তার (বঙ্গবন্ধুর) দেখানো পথে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যান। স্বাধীন বাংলাদেশকে বাস্তবতায় রূপ দেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তাজউদ্দীন আহমদ অমর হয়ে থাকবেন চিরকাল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর প্রধান এ সেনাপতি ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। একসময় তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েন। অনেকের সঙ্গে আমিও একমত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসতই। জাতির পিতা সেভাবেই বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে সংগঠিত করেছেন। ’৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা অনেকটাই পূরণ করেছিলেন। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ’৭১-এর পর থেকেই আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি কুচক্রী মহল বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদের তুলনা করার অর্বাচীন ও অপ্রয়োজনীয় চেষ্টা করে। ফলে, তাজউদ্দীন আহমদের কৃতিত্ব বড় করলে বঙ্গবন্ধুর অবদান খাটো করা হবে এরকম একটি ভ্রান্ত এবং বিভ্রান্তিকর ধারণা আওয়ামী লীগের মধ্যে পেয়ে বসে। এ কারণেই স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে উপেক্ষিত হতে থাকেন তাজউদ্দীন আহমদ, মুজিবনগর সরকার। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার ৯ মাসে বহুমাত্রিক যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধ। মুজিবনগর সরকারে খুনি মোশতাক চক্রের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধ। মুজিব বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব। এসব প্রতিকূলতা জয় করে এগোতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারকে। অনেক ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ কঠোর ছিলেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি আপস করেননি। কোনো ছাড় দেননি। এ জন্যই বাংলাদেশ বিজয় লাভের পর তাজউদ্দীন আহমদের বিরোধিতাকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে, চাটুকার এবং ষড়যন্ত্রকারীরা ঘিরে ফেলে বঙ্গবন্ধুকে। খুনি মোশতাক আর বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ছাত্রনেতারা একজোট হন তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে। তাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিপক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী বানানোর ষড়যন্ত্র ক্রমেই সফল হতে থাকে। তাজউদ্দীন চাটুকারিতা করতে পারেন না। ভুল তথ্য দিয়ে নেতাকে বিভ্রান্ত করতে পারেন না। নেতাকে অপ্রিয় সৎ পরামর্শ দিতে পিছপা হন না। ফলে ধীরে ধীরে তিনি অপ্রিয় মানুষ হতে থাকেন। খুনি মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমানের মতো চাটুকার তোষামোদকারী ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুর চারপাশে জাঁকিয়ে বসেন। তাজউদ্দীন সম্পর্কে এত নেতিবাচক এবং অসত্য তথ্য বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া হয়, একপর্যায়ে দুই নেতার সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি করে। সৃষ্টি হয় দূরত্ব। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদের কাছে কখনো শুনতে চাননি ’৭১-এর ৯ মাস যুদ্ধের মেরুকরণ। কার কী ভূমিকা ছিল। বরং তাকে নানা মনগড়া কল্পকাহিনি শুনিয়েছে খুনি মোশতাক এবং ছাত্রনেতারা। অভিমানী, ব্যক্তিত্ববান তাজউদ্দীনও যেচে বঙ্গবন্ধুকে সেই সময়ের ঘটনাগুলো বলেননি। ফলে মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একপক্ষীয় খণ্ডিত বক্তব্য পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকাকালে কখনো মুজিবনগরের আম্রকাননে যাননি। তাকে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আত্মপ্রকাশের স্থানে না যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করা হয়েছিল। দুই নেতার দূরত্বের মধ্যেই ১৯৭৪ সালে তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন বঙ্গবন্ধু। তাজউদ্দীন উপেক্ষার শেষপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ান। রাজনীতিতে কোণঠাসা হতে হতে তিনি অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর তাজউদ্দীন গ্রেপ্তার হয় প্রমাণ করেন নেতার যোগ্য সহচরদের আসল পরিচয় দুঃসময়ে। ৩ নভেম্বর ’৭৫-এ জেলে শহীদ হয়ে তিনি প্রমাণ করেন, আদর্শবানরা কঠিন সময়ে প্রাণ দেয়, চাটুকাররা বিশ্বাসঘাতক হয়। ৭৫-পরবর্তী সময়ে জোহরা তাজউদ্দীন যদি আওয়ামী লীগের হাল না ধরতেন, তাহলে আওয়ামী লীগের ইতিহাসে তাজউদ্দীনের পুনর্মূল্যায়নও হতো না। আজ তাজউদ্দীন জাতীয় চার নেতার সম্মান পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বগাথা আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন। কিন্তু আমার কাছে তাজউদ্দীন আহমদ শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতীক। সৎ মেধাবী, আদর্শের প্রশ্নে অটল নেতাকর্মীদের প্রতীক তাজউদ্দীন। যেসব রাজনীতিবিদ চাটুকারিতা আর তোষামোদ করে পদ-পদবি হাসিল করতে চান না, তারাই তাজউদ্দীন। নেতার ভালোর জন্য নেতাকে যৌক্তিক সমালোচনা এবং অপ্রিয় পরামর্শ দিতে যারা পিছপা হন না, তারাই তাজউদ্দীন। নেতার নির্দেশ বাস্তবায়নে যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে তারাই তাজউদ্দীন। রাজনীতিতে যারা ত্যাগী, পরীক্ষিত, আদর্শবান তারাই তাজউদ্দীন। কঠিন সময়ে যারা পালায় না বা রংবদল করে না, দৃঢ় প্রত্যয়ে নেতার আদর্শের জন্য লড়াই করে, তারাই তাজউদ্দীন। যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতাকর্মীরা অমূল্য সম্পদ। এরাই দলকে এগিয়ে নেয়। বিজয়ী করে। আওয়ামী লীগে সারা দেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তাজউদ্দীন আহমদের মতো নিঃস্বার্থ, ত্যাগী কর্মী, নেতা। এরাই আওয়ামী লীগের প্রাণভোমরা। এদের জন্যই ’৭৫-এর পর কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আমি এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করি। দুঃসময়ে তাজউদ্দীনরাই লড়াই করে আর সুসময়ে তারা দূরে সরে যায়, উপেক্ষিত হন। অনাদরে অবহেলায় দীর্ঘশ্বাস নেন। সুসময় এলেই আওয়ামী লীগে ভিড় করে অতিথি পাখিরা, চাটুকার, সুবিধাভোগীরা। আগে এসব মতলববাজ শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রের চারপাশে ঘুরঘুর করত। এখন তৃণমূল পর্যন্ত এরা ছড়িয়ে পড়েছে। দুঃসময়ের তাজউদ্দীনরা সুসময়ে এসে নব্য মোশতাকদের কাছে ভীষণ কোণঠাসা। আওয়ামী লীগ আজকের অবস্থানে এসেছে কতগুলো কঠিন সময় পার করে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট। আওয়ামী লীগে বিভক্তি, আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাকশাল গঠন। ’৯১-এর নির্বাচনে বিপর্যয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডবে নির্যাতিত আওয়ামী লীগ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। ২০০৭ সালে এক-এগারো। এই প্রতিটি কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে দুটি ধারা লক্ষ করেছি। একটি ধারার নেতাকর্মীরা কঠিন সময়ে নেতার পাশে অবিচল থেকেছে। নেতার নির্দেশ পালন করেছে। আদর্শের জন্য লড়াই করেছে। নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করেও আপস করেনি। আরেকটি ধারা, কঠিন সময়ে পালিয়েছে। আদর্শ বিকিয়ে দিয়ে নেতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। নেতার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। আপস করেছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগে একটা অদ্ভুত প্রজাতি রয়েছে। এরা অনেকটা সাইবেরিয়া থেকে আসা শীতের পাখিদের মতো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই এরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে। ক্ষমতাকেন্দ্রের চারপাশ দখল করে। মধু খায়। মধুর কথায় নেতাদের বশীভূত করে। তাদের চাটুকারিতা আর ভণ্ডামিতে নেতারা সম্মোহিত হন। তখন কঠিন দিনের তাজউদ্দীনদের চেনে না নেতারা। গত ১৪ বছরে এই ‘নব্য’রাই ক্ষমতাবান হয়ে গেছে। বিভিন্ন সংকটে যারা লড়াই করেছে তারা এখন বিতাড়িত। বিভিন্ন সংকটে যারা বিভ্রান্ত ছিলেন, তারাও এখন নব্য আওয়ামী লীগারদের পেছনে চলে গেছে। এদের কেউ কেউ অবশ্য এখন নব্য আওয়ামী লীগারদের মতো বীভৎস তোষামোদির পথ বেছে নিয়েছে। ফলে ন্যায়নিষ্ঠ নেতাকর্মীরা এখন বহুদূরে। শুধু সরকারে না, তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কমিটিগুলো এখন হঠাৎ বনে যাওয়া আওয়ামী লীগারদের দখলে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসংকেত। যখনই সুবিধাবাদী, তোষামোদকারী, চাটুকাররা আওয়ামী লীগে প্রভাবশালী হয়েছে, তখনই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলটি বিপর্যয়ে পড়েছে। বিপর্যয়ে অপাঙ্ক্তেয় ত্যাগীরা এসে হাল ধরেছে, চাটুকার নব্য মোশতাকরা হয় পালিয়েছে না হয় দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সংকটের কথা বলছেন। ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। নির্বাচনে আগে চক্রান্ত হবে বলে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করছেন। এখনই সময়। আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করার। চাটুকারদের দূরে সরিয়ে ত্যাগী পরীক্ষিতদের সামনে আনার। নব্য মোশতাকরা যেন সরকারপ্রধানকে ঘিরে ফেলতে না পারে, তা নিশ্চিত করার। ক্ষমতাকেন্দ্রে মতলববাজদের হটিয়ে যোগ্যদের আনার এই তো সময়। না হলে দেরি হয়ে যাবে। নব্য আওয়ামী লীগাররা শুধু ক্রিম খাবে। এরাই নব্য মোশতাক। আর দুঃসময়ের কাণ্ডারিরা সংকট উত্তরণে মরণপণ লড়াই করবে। যেমন করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালে। মুজিবনগর দিবসে তাই ত্যাগী, আদর্শবান, নির্ভীক নেতাকর্মীদের দিন। নব্য মোশতাক আর লুটেরাদের প্রতিহত করার দিন। আওয়ামী লীগ কি পারবে সেটা করতে?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭