ইনসাইড থট

"উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে বাজারজাতকরণ কৌশল"


প্রকাশ: 25/04/2023


Thumbnail

মুদ্রাস্ফীতির অতি সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে বিগত সময়ে ১০০ টাকা দিয়ে আমি যে পণ্য পেতাম এখন ১০০ টাকা দিয়ে একই পণ্য আরো কম পাচ্ছি। এতে সীমিত আয়ের লোকদের জীবন নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হয়। অনেক পণ্য কেনাকাটা বাদ দিতে হয় অথবা কম কিনতে হয়। বর্তমানে স্থিমিত তিন বছর মেয়াদী "ওমিক্রন সংক্রমণ" এবং পরবর্তীতে চলমান "ইউক্রেন সংকটের" কারণে সৃষ্ট বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থার বিপত্তি, জ্বালানি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এই মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। মূল্যস্ফীতির প্রভাব অর্থনীতি এবং সমাজ জীবনে ব্যাপক। মুদ্রাস্ফীতির সুফল এবং কুফল দুটোই আছে। এ বিষয়ে সমষ্টিক অর্থনীতির ছাত্রদের পরীক্ষায় প্রশ্নও  আসে। মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ এবং এর পরিমাপ পদ্ধতি নিয়েও বিতর্ক আছে। সরকারি হিসেবেই আমাদের চলমান মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের আশেপাশে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই হার ৩০, ৫০, ৭০ এবং ১৩০ শতাংশ পর্যন্ত আছে। 

বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এমনটি হচ্ছে এই বিষয়টি সরকার এবং ব্যবসায়ের পক্ষ থেকে জনগণকে বুঝানোর চেষ্টা করা হলেও যেহেতু এই বিষয়টি দ্বারাই জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত,  এই বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসছে এবংসরকার এবং ব্যবসায়কে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। ব্যাংকের টাকা লুটপাট এবং কথিত বিদেশে পাচার, ঋণ খেলাপীর পরিমাণ বাড়লেও এতে সাধারণ জনগণের আপাতত সরাসরি কোন ক্ষতি হচ্ছে না । একজন গ্রাহকও বলতে পারবেনা সে ব্যাংকের টাকা রেখেছিল,  কিন্তু  ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে টাকা পায়নি। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট এর কারণে শতকরা একজন লোক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমনটি বলা যাবে না। প্রস্তাবিত উপাত্ত সংরক্ষণ আইনের কারণে ব্যক্তি বিশেষ তাঁর উপাত্ত চুরি হওয়ার আতঙ্কেও নেই।  বিভিন্ন প্রকল্পের বড় বড় দুর্নীতি এবং ঘুষ দ্বারা দেশের ক্ষতি হলেও ক্ষীণদৃষ্টিতে ব্যক্তি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত মনে করে না। মুদ্রাস্ফীতির কারণে যারা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাঁরা এ বিষয়টাকেই বেশি মনে রাখবে। বিদ্যুৎ, সড়ক, সেতু, ট্যানেল, যোগাযোগ ও সরকারের অন্যান্য পরিসেবা থেকে যে উপকার পাচ্ছে সেটাকে ছাড়িয়ে যাবে মুদ্রাস্ফীতির ক্ষতি। মানুষ উপকার অপেক্ষা অপকার বেশি মনে রাখে। ২০০২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ক্যায়েনম্যান বলেছেন, "মানুষ ঝুঁকি নিতে চায় না, লাভের চেয়ে ক্ষতিকে অনেক বেশি ঘৃণা করে। উপকারের চেয়ে অপকারকে বেশি গুরুত্ব দেয়।...মানুষ পুরাতন অতীত ভুলে যায়, বর্তমানের প্রতি বেশি সংবেদনশীল"।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে আলোচনায় গণমাধ্যম এবং টেলিভিশনে অধিকাংশ আলোচনাতেই ক্রেতাদের দুর্দশার কথাই উঠে আসে ।  অন্যান্য পক্ষগুলো যেমন শিল্প উৎপাদনকারী, ছোট ব্যবসায়ী, ছোট ও নুতন উদ্যোক্তা, এমনকি ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমস্যা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়। সীমিত আয়ের ক্রেতাদের মুদ্রাস্ফীতি জনিত দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি রেখেই আজকের বিষয় উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট মার্কেটারদের সমস্যা আলোচনা করা।

বর্তমানে যে মুদ্রাস্ফীতি চলছে তা সহসা আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না। বৈশ্বিক পর্যায়ে সেটা ১৯৮০ দশকের মুদ্রাস্ফীতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়ের জন্যই এটা একটা দারুন সংকট। ৪০ বছর আগে যারা (আকিজ সাহেব) এই মুদ্রাস্ফীতি দেখেছিলেন তাঁদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই, এখন যারা ব্যবসা করছেন তাঁরা (নাসির, বশির) কখনো এমন দুরাবস্থা মোকাবেলা করেনি। বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপকগণ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা সময় অতিক্রম করছেন। এক সময় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ১৪-১৫ শতাংশ হারে ব্যাংকের ঋণ পেলেও বলতো, "আলহামদুলিল্লাহ"। এখন সর্বোচ্চ নয় শতাংশ  সুদেও ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে চাচ্ছেন না (যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ খেলাপি সেজে বিদেশে টাকা পাচার করতে চায় তাদের বাদ দিতে হবে। তবে ঋণ খেলাপির সংখ্যা বাড়লেও এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কিছু ব্যবস্থাও দেখা যাচ্ছে। গত ১ এপ্রিল দৈনিক সমকাল পত্রিকায় খবরে বলা হয়েছে, 'জেল থেকে বাঁচতে এবং আদালত কর্তৃক রিসিভার নিয়োগ এবং  দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা এড়ানো সহ পাঁচ কারণে বাধ্য হয়ে চট্টগ্রামের ৫৪২ জন ঋণ খেলাপি ১২শ কোটি টাকা ব্যাংকে ফেরত দিয়েছে)।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বজজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্টজনদের ইতিহাসের নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এই কান্তিকালে কোম্পানির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্রেতা কি আচরণ করছে বা করবে এবং এর সাথে বারজাতকরণ কৌশলের সমন্বয় করে তাঁদের নিকট ভ্যালু পৌঁছে দেয়া এবং প্রতিযোগীদের সাথে তার ভিন্নতা বজায় রাখা। এই সংকট মোকাবেলায় একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগকেই এই সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব দিতে হবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময় কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের লোকদের কাজ হচ্ছে ক্রেতার অবস্থা অনুধাবন করে, ক্রেতার অবস্থা মূল্যায়ন করে উপযুক্ত কর্মকৌশল নির্ধারণ।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে টিকে থাকার সবচেয়ে বড় কৌশলী হচ্ছে, 'কম খরচে ব্যবসা করা'। অধ্যাপক Michael  Porter যেটাকে বলেছেন, "overall cost leadership"। এর জন্য যা করতে হবে:

(১) নির্মোহভাবে খরচ ও মুনাফা  পর্যালোচনা করতে হবে।
(২) magnifying glass দিয়ে খরচকে দেখতে হবে। ইতোমধ্যেই না করে থাকলে খরচ পর্যালোচনার জন্য প্রয়োজনে "QuickBook" এর মত সফটওয়্যার ব্যবহার হবে।
(৩) সৃজনশীল হোন। প্রয়োজনে খরচ স্থিতিশীল রাখার জন্য পণ্য ও সেবার সংখ্যা কমিয়ে দিন। যেমন সাপ্তাহে একদিন সার্ভিস সেন্টার বন্ধ রাখুন। ক্রেতাদের জন্য সেলফ সার্ভিস এর ব্যবস্থা করুন। যেমন রেস্টুরেন্টে QR পদ্ধতিতে বিল পরিশোধের ব্যবস্থা করুন। (Domino's ক্রেতা এসে পিজ্জা নিয়ে গেলে ডিসকাউন্ট দেয়। কিছু কিছু হোটেল অতিথি অনুরোধ জানালেই কেবল হোটেলের পক্ষে পরিচ্ছন্নতা কর্মী পাঠায়।)
(৪) লেনদেন প্রক্রিয়াটিকে সংক্ষিপ্ত এবং স্বয়ংক্রিয় করুন। প্রযুক্তির সাহায্যে কি কোন কাজ করা যাবে, যা আপনি বা আপনার কর্মচারী করছে ? বড় ধরনের প্রভাব না হলে কিছু কাজ কি বাদ দেয়া যাবে?
(৫) কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়ান। কর্মীদেরকে সন্তুষ্টও রাখতে হবে। কর্মী হারানোর ঝুঁকি নেয়া যাক ঠিক হবে না। তাঁদের জন্য কার্যসম্পাদন ভিত্তিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। 
(৬) অপচয় রোধ করে নির্মোহভাবে খরচ কমাতে হবে। এমন কিছু ক্রয় করবেন না, যা থাকলে আপনার ভালো লাগে (nice to have)। জিনিসটা কি কাজে লাগে তা পরখ করে দেখুন। এমন কিছু কি কিনেছেন যা আপনি সহসায় ব্যবহার করবেন না। কোথাও কি এমন চাঁদা দিচ্ছেন, যাদের সেবাটি এ সময়ে আপনার না নিলেও চলে।
(৭) জুম মিটিং করুন। সামনাসামনি ভ্রমণ করা বা দেখা হওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা ভেবে দেখুন। কৌশলগত খরচ এবং মামুলি ধরনের খরচের পার্থক্য নির্ণয় করুন।
(৭) যদি নিশ্চিত হন দাম আরো বাড়বে সেক্ষেত্রে সুযোগ থাকলে এখনই কাঁচামাল মজুদ করুন। বাল্ক/লট ধরে কিনুন।
(৮) মুদ্রাস্ফীতির সময় নগদ টাকা ধরে রাখলে লোকসান বাড়বে, নগদ দ্রুত অবমূল্যায়িত হয়। অপব্যবহারযোগ্য নগদ থাকলে ভবিষ্যতে ব্যবহারযোগ্য সম্পদ সংগ্রহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করুন। মুদ্রাস্ফীতি স্বল্প বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, তবে চিরস্থায়ী হবে না। সুযোগ থাকলে ঋণ বা বাকিতে ক্রয়ের পরিশোধ বিলম্বিত করুন। এতে আপনার আর্থিক দায় পরিষদের পরিমাণ কমে যাবে। সরকার বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই সময়ে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, সুযোগ থাকলে সেটা নেয়ার চেষ্টা করুন। 
(৯) কোম্পানির বর্তমান ক্রেতাদের প্রণোদিত করুন। নতুন ক্রেতা ধরার চেয়ে পুরাতন ক্রেতাকে ধরে রাখার খরচ অনেক কম। কাস্টমার লয়ালিটি প্রোগ্রাম,  বাট্টা এবং অন্যান্য অফার অব্যাহত রাখুন (Mitchell Leiman,2022)।

বাজারজাতকরণ মিশ্রণ কৌশল 

(১) পণ্য (product): উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময়ে পণ্য এবং ব্যবসায় খাতের সমন্বয় অব্যাহত রাখতে হবে। যেকোনো ব্র্যান্ডের মধ্যমণি হচ্ছে পণ্য। ব্র্যান্ডের অবস্থানের জন্য মৌলিক উপাদানই হচ্ছে পণ্য। এ সময়ের উদ্ভাবনই হতে পারে মূল ভরসা। ক্রেতার কথা শুনতে হবে, পণ্য হচ্ছে ক্রেতার সমস্যার একটি সমাধান। Big data বিশ্লেষণ করে ক্রেতাদের মনোভাব ট্র্যাকিং করা এখন অনেক সহজ। যেমন সুপার সপ থেকে পণ্য ক্রয়ের সময় ক্রেতারা কোন্ দিক থেকে কোন্ দিকে ঝুঁকছে তা আজকাল সহজেই জানা যায়। সেই অনুযায়ী পন্য পোর্টফলিও সমন্বয় করতে হবে। উদ্ভাবনের জন্য বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। পণ্য বা সেবা কোন ক্ষেত্রেই উদ্ভাবনের বিকল্প নেই। যেহেতু আর্থিক চাপ সামলাতে গিয়ে ভোক্তাদের পছন্দ বদলে যাচ্ছে তাই পণ্যকে আপডেট রাখা আরো বেশি প্রয়োজন। উদ্ভাবনী কাজে ভোক্তাকে 'কো-ক্রিয়েটর' হিসেবে গ্রহণ করুন। এতে নতুন উদ্ভাবিত পণ্য ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে। 

অস্থিরতা (volatility) অনেক সময় সুযোগ নিয়ে আসে। ভিন্ন সেগমেন্টে কম খরচের সরবরাহকারী হিসেবে যাওয়ার কথা ভাবুন। ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিতে বিরক্ত হবেন না। এতে আপনার দৃষ্টির বাইরে থাকা ক্রেতার সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন। এটা বাজারজাতকরণ প্রচেষ্টা কমানোর সময় নয়। ক্রেতাকে প্রদেয় আবশ্যকীয় সেবার ব্যাপারে অবহেলা করা যাবে না। বহু শিল্পে কাস্টমার সার্ভিসের উপরেই ক্রেতার সন্তুষ্টি বহুলাংশে নির্ভর করে ।

(২) মূল্য(Price): সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। মূল্যবৃদ্ধিকে ক্রেতা, ডিলার, এমনকি নিজস্ব বিক্রয় কর্মীরাও ভালোভাবে নেয় না; তা জেনেশুনেই কোম্পানিগুলো মূল্য বৃদ্ধি করছে। মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন ও বিতরণ খরচ বেড়ে যাওয়া। ক্রমবর্ধমান খরচ কোম্পানির মুনাফাকে কমিয়ে দেয়, আর কোম্পানি তখন বাধ্য হয় নিয়মিত মূল্য বাড়াতে থাকে। কোম্পানি অনেক সময় খরচ আরো বৃদ্ধি পাবে এ আশঙ্কায় যতটুকু খরচ বেড়েছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে মূল্য বাড়ায়। কোম্পানিগুলো এ সময়ে সাধারণত তার ক্রেতাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী মূল্য চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চায় না। কারণ তাঁদের ভয় থাকে খরচ বৃদ্ধির কারণে  মুনাফা নাও হতে পারে। অন্য যে উপাদানটি অবদান রাখে তা হচ্ছে বিভিন্ন উৎসবকে (রোজা, ঈদ, পূজা) উপলক্ষ করে মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা। যখন কোন কোম্পানি তার ক্রেতাদের চাহিদার পরিমাণে সরবরাহ করতে পারে না তখন মূল্য বাড়িয়ে দেয়। কখনো কখনো ক্রেতাদের জন্য পণ্যের কোটা নির্ধারণ করে দেয়। ক্রমবর্ধমান খরচের সঙ্গে তাল রাখার উদ্দেশ্যে কোম্পানির মূল্য বৃদ্ধির জন্য অনেকগুলো পথ খোলা আছে। যে পণ্যটি বেশি চলে তার বাট্টা প্রত্যাহার করে এবং পণ্য লাইনে বেশি দামি পণ্য যোগ করে প্রায় অদৃশ্যভাবেই মূল্যবৃদ্ধি করা যায়। অথবা খোলাখুলি ভাবে পণ্যের মূল্য বাড়ানো যায়। অতিরিক্ত বর্ধিত মূল্য ক্রেতাদের নিকট থেকে আদায় করার সময় পণ্যটি যেন "বাটালি" বা "মূল্য ডাকাতের" ভাবমূর্তি না পায় সেদিকে কোম্পানিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কোম্পানি কেন মূল্য বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে তা ব্যবসায়ী এবং শিল্প ক্রেতাদেরকে (business and industrial buyers) জানানোর জন্য যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে । কোম্পানির বিক্রয় কর্মীদের উচিত ক্রেতারা কিভাবে পণ্যটি মিতব্যয়িতার সাথে পেতে  এবং ব্যবহার করতে পারে সে ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ দেয়া।

অনেক কোম্পানি মূল্যবৃদ্ধি না করেও উচ্চ খরচ অথবা চাহিদাকে মোকাবেলা করে। কোম্পানি পণ্যটিকে সংকুচিত করতে পারে। মিষ্টি বা চকলেটের  ক্ষেত্রে প্রায়ই এমনটি করা হয়।  বিগত বছরগুলোতে দুধের দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেলেও ঢাকা শহরের কিছু দোকানে রসগোল্লার একক প্রতি দাম বাড়েনি,  ক্রমশ আকৃতি ছোট হচ্ছে। আগের দামে প্যাকেটে কম পণ্য দেয়া কৌশলটাকে বাণিজ্যিক পজিশন হিসেবে "shrinkflation" বলা হয়। দাম না বাড়িয়ে খরচ কমানোর  জন্য আরও যেসব পদক্ষেপ নেয়া যায় সেগুলো হচ্ছে কম দামি উপকরণ ব্যবহার করা (পুস্তকের ক্ষেত্রে অফসেট কাগজের বদলে সাধারণ সাদা কাগজ বা নিউজ প্রিন্ট ব্যবহার করা), পণ্যের কিছু বৈশিষ্ট্য বাদ দিয়ে  তৈরি (খাবারের ক্ষেত্রে দুই একটি মসলা বাদ দেয়া), প্যাকেজিং খরচ কমানো (কন্টেইনারের বদলে সাদামাটা পলিথিনের  প্যাকেট ব্যবহার), অথবা সেবার পরিমাণ কমিয়ে দেয়া (বিনা খরচায় ক্রেতার বাড়িতে পণ্য পৌঁছে দেয়ার বদলে ক্রেতাকে দোকান থেকে পণ্য নিয়ে যেতে বলা), অথবা কোম্পানিটি তার পণ্য ও সেবার একক বান্ডিল খুলে পণ্য ও সেবা প্রত্যেকটির জন্য পৃথক মূল্য ধার্য করা (যেমন IBM এখন প্রশিক্ষণের জন্য পৃথক মূল্য ধার্য করে, আগে যা কম্পিউটারের বান্ডেলে অন্তর্ভুক্ত ছিল), অনেক রেস্টুরেন্ট ডিনার ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ থেকে সরে এসে মূল্য নির্ধারণের  cafeteria approach, 'যা খাবেন তার মূল্য দিতে হবে' ব্যবহার করছে। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ক্রেতার ব্যয়ের ইচ্ছা অনুধাবন (willingness to pay)। বর্ধিত দামে ক্রেতা কতটুকু পণ্য কিনবে সেটা নির্ভর করবে পণ্যটি তাঁর নিকট যতটা গুরুত্বপূর্ণ(ভ্যালু)। প্রতিযোগীর পণ্যের সাথে তুলনা করেই তাঁরা কোন কোম্পানির পণ্যকে 'বেটার অপশন' হিসেবে নির্বাচন করবে। মূল্য সমন্বয়ের যথার্থ কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা (মূল্য ,আয় ও আড়াআড়ি) যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। বিক্রেতা তাঁর পণ্যের মূল্য এক ধাপে অথবা দফায় দফায় বাড়াতে পারে। যেখানে পণ্যের ব্যাপক মানোন্নয়ন সম্ভব নয় সেখানে একধাপে বাড়ানোই ভালো। ক্রেতার সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ থাকলে তার নিকট মূল্যবৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, অন্যথায় ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। B2C এর তুলনায় B2B ক্ষেত্রে মূল্য সংক্রান্ত ব্যাখ্যা প্রদান বেশ ফলপ্রসূ। মূল্য সংক্রান্ত যোগাযোগ সচ্ছ হতে হবে, ঘোষণা আকারে প্রকাশ করতে হবে এবং মূল্যবৃদ্ধির গল্পটা ক্রেতার নিকট বোধগম্য হতে হবে। মূল্যস্ফীতিকে দোষারোপ করবেন না। নতুন বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করুন। পন্য সংক্রান্ত দুই একটি গোপন তথ্য থাকলে বলুন, যা আগে বলেননি। উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে দায়ী না করে পণ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে মূল্য সম্পর্কে  ক্রেতাকে অবহিত করুন। উচ্চমূল্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না। 

বিনীতভাবে শর্তগুলো বর্ণনা করুন। আপনার বার্তা স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার হতে হবে এতে গ্রাহকের আস্থা বাড়বে। তাঁদের জানিয়ে দিন (এসএমএস করুন)। একটি নতুন বিষয়বস্তু বা বৈশিষ্ট্য অফার করুন যা ইতিমধ্যেই ছিল, কিন্তু গ্রাহকদের জানানো হয়নি। আপনি যে মান অফার করেন তার উপর ফোকাস করুন। পন্যের গুণমান হাইলাইট করুন। ক্ষমাপ্রার্থনা না করেও বিনয়ী হোন; একটি প্রশংসিত উপায়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করুন।

(৩) স্থান (place): উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে পণ্য সুবিধাজনক স্থানে পাওয়া ব্র্যান্ড সফলতার অন্যতম শর্ত। মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্রেতা ভিন্ন খুচরা চ্যানেলে চলে যেতে পারে। করোনা কালের মত ই-কমার্স বাড়তে পারে । নিম্ন চ্যানেলে ক্রেতা চলে যেতে পারে (এই সময় ফুটপাতে ক্রেতার সংখ্যা বাড়ে)।

(৪) প্রমোশন (promotion): উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময়ও বিজ্ঞাপন খাতে বিনিয়োগ বন্ধ করা যাবে না। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোক্তার সাথে কোম্পানির আবেগীয় বন্ধন সুদৃঢ় রাখা যায়। বিজ্ঞাপনে ব্যয় হ্রাস বা বন্ধ করলে ব্র্যান্ডের অপরনীয় ক্ষতি হতে পারে। মার্কেট শেয়ার কমে যাওয়া, ক্রেতা সচেতনতাকে দুর্বল করা, বাজারে অবস্থান এবং ক্রেতার সংযোগ দুর্বল করে দিতে পারে। ২০১৮ সালে পরিচালিত  Ehrenburg -Brand Institute এর এক গবেষণায় দেখা গেছে দীর্ঘদিন যাবত যে সকল ব্র্যান্ড বিজ্ঞাপন বন্ধ রেখেছে তাদের গড় বিক্রি কমেছে প্রথম বছরে ১৬ শতাংশ, দুই বছরে ২৫ শতাংশ কমে গেছে। মুদ্রাস্ফীতির সময় প্রমোশনের চ্যানেল সমন্বয়ের প্রয়োজন হতে পারে। সংকটের সময় ক্রেতারা যে মিডিয়া বেশি ব্যবহার করে সে অনুযায়ী মিডিয়ার প্ল্যান সমন্বয় করতে হবে। ক্রেতারা আবেগীয় পন্য সহজে ছাড়তে পারে না। অপর দিকে এময়ে আর্থিক সংকটে থাকা ক্রেতারা নিম্নস্তরের ব্র্যান্ডের পন্য কেনে, যেগুলো গ্রহণযোগ্য মানের। বিজ্ঞাপনে গল্প বলার সময় ক্রেতা যে দুর্ভোগে পড়েছে তার প্রতি সহমর্মিতা (empathy) দেখাতে হবে (যেমন- "এ মাসে দুধ আর মাসের বাজারের টাকা একসাথেই শেষ হয়েছে...")। দুরবস্থার সময় ক্রেতা তাঁর নিকট জনের সাথে পরামর্শ করে। 'Word-of-mouth' এ সময়ে খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ব্যবহারকারীর নির্মিত কনটেন্ট ব্যবহার করে ইনফ্লুএন্সার মার্কেটিং এর উপর জোর দিতে হবে (Rafael Schwarz, 2022)। ক্রেতার অগ্রাধিকার জেনে এবং সে অনুযায়ী সাড়া দিয়েই এই দুর্মূল্যের বাজারে টিকে থাকতে হবে। ক্রেতাকে জানাই হচ্ছে মার্কেটিংয়ের মূল কেন্দ্রবিন্দু। মুদ্রাস্ফীতি এক পর্যায়ে কমে যাবে, যদিও গত কয়েক মাস ধরে এটা দেখা যাচ্ছে না। কিছু সমন্বয় করে এবং এজাইল থেকে ব্যবসায় চালিয়ে নেয়া এবং ব্যবসায় বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখুন এই দুঃসময়ে।


লেখক: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান 
মার্কেটিং বিভাগ, 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭