ইনসাইড টক

‘বুলেটের প্যাকেট কাঁধে নিয়ে আমরা মার্চ শুরু করলাম’


প্রকাশ: 30/04/2023


Thumbnail

‘১১ নম্বর সেক্টর আমার ছিল, এই অঞ্চল, এখন যেটা শিববাড়ি হয়ে, ধোবাউড়া অঞ্চল। কলসিন্দুর, দুর্গাপুর, বিজয়পুর। বিজয়পুর ক্যাম্পেই আক্রমণ করলাম প্রথম, শেষ যখন আসি, ভোর রাত ৪ টার সময় আক্রমণ করেছি। ক্যাপ্টেন মোরারি ছিলেন আমাদের যৌথ কমান্ডেন্ট। তিনি বললেন, মার্চ অন। তখন আমাদের হেটে চলতে হতো, তখনতো এতো কিছু বুঝি না, আমি তখন ছাত্র। তখন হঠাৎ করে একটি কমান্ড আসলো- সব সীমান্তে চলে যেতে হবে। হাইড আউট, মানে লুকিয়ে যাওয়া, আমরা লুকিয়ে গিয়ে একটি অবস্থান নিয়েছিলাম। তখন আঞ্চলিক কমান্ডের একটি নির্দেশ আসলো, তখনতো আর মোবাইল ছিল না, তখন আমাদের লোকেদের কাছে অতো ওয়ারলেসও ছিল না। কাউকে দিয়ে লোক পাঠিয়ে খবর দেওয়া হতো।’ - বলছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেন।           

তিনি বলেন, ‘খবর পেয়ে তখন আমরা মার্চ করলাম নেউলাগিরি সীমান্তে। সেখানে আমরা জমায়েত হলাম, কাছাকাছি যারা ছিলাম। তারপর আমরা সন্ধ্যার পরেই আবার মার্চ শুরু করলাম। আমাদের কাছে কম্বল ছিল, খাবার জন্য প্লেট ছিল, আমরা সব ফেলে দিলাম। সব ফেলে দিয়ে বুলেটের প্যাকেট কাঁধে নিয়ে, হাফপেন্ট পড়া আর গেঞ্জি আর আর্মস, আমরা মার্চ শুরু করলাম। আমরা যাচ্ছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা আমরাও জানি না।’ 

গত ২২ এপ্রিল ছিল পবিত্র ইদ-উল ফিতর। ঈদ-উল ফিতরের এই দিনে নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলার নিজ এলাকায় ঈদ পূণর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেন। ওই অনুষ্ঠানে স্থানীয় বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেন। পরে আহমদ হোসেনের গ্রামের নিজ বাড়িতে এক মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন করা হয়। ওই দিন মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের ঘটনাবহুল স্বশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেন- এর সঙ্গে। তিনি বাংলা ইনসাইডারের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন। পাঠকদের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন- এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা ইনসাইডারের বিশেষ প্রতিনিধি আল মাসুদ নয়ন।  

বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেন বলেন, আমরা মনে করলাম এটা চিতলি হাওর। তখন কার্তিক মাস ছিল, তখন ডিক্লিয়ার হলো যুদ্ধ। ইন্ডিয়ায় আক্রমণ করলো, ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখ। ইন্দিরা গান্ধী তখন কলকাতা ছিলেন। তখন আগ্রাবাদে বিমান হামলা হলো। তখন ইন্দিরা গান্ধী ম্যাসেজ পেলেন, ম্যাসেজ পেয়েই দিল্লি চলে গেলেন। আগ্রাবাদে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী হামলা করলো, বোমা বর্ষণ করলো। তখন টেলিভিশন ছিল না, বেতার ছিল মেইন, ভারতীয় বেতার থেকে আমরা খবর পেতাম। ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় বেতারে ভাষণ দিলেন। এটা ইতিহাস। পরে জেনেছি। 

তিনি বলেন, আমরা যখন চিতলি হাওর দিয়ে আসছিলাম, চিতলির হাওর যে এতো শুকিয়ে গেছে কে জানে? হাটু পানি। তখন শিশির পড়েছে। আমাদের কমান্ড করা হলো ‘হোল্ড’। আমরা বসে পড়লাম। সেখানে একটা বাড়ি ছিল ‘চেয়ারম্যান বাড়ি’, বিশাল এক পুকুর ছিল, ওই পুকুরের পাড় ঘেঁষেই আমরা লাইং পজিশনে অর্থাৎ শুয়ে পড়লাম। পুকুরের পাড়ে অস্ত্র রাখলাম, মাথা নিচে। আমাদের পেছন থেকে কাভার করবে, পেছনে মর্টার। মর্টার হামলা করছে, বার বার মর্টার হামলা করছে, কিন্তু পাকিস্তানের ক্যাম্প থেকে কোনো রিপ্লাই আসছে না। তখন আমরা সিঙ্গেল ফায়ার করলাম। কোনো রিপ্লাই নাই। এ সময় আমরা বুঝতে পেলাম, তারা পালিয়ে গেছে। আমরা চিৎকার করে ওঠলাম, জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু। 

আহমদ হোসেন বলেন, আসলে তখন তারা পিছিয়ে যাচ্ছিল। তাদের কমান্ড থেকেই তাদেরকে পিছিয়ে যেতে বলা হচ্ছিল। ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকেই তাদের কমান্ড আসতেছিল পিছিয়ে যেতে। তাদের সাত দিনের আর্মস আছে, সাত দিনের খাবার আছে, ফাইটার বিমান পাঠানোর কথা ছিল, সেগুলো আসছিল না। তাদের রসদ ফুরিয়ে যাচ্ছিল। তারা রিট্রিট করছিল, মানে পিছিয়ে যাচ্ছিল। 

তিনি বলেন, তারা পিছিয়ে গিয়ে শিবগঞ্জের এখানে স্ট্রেঞ্জ (পরিকা) করেছে। গাছের উপরে চৌকি বেঁধে তারা উপরে শুয়ে গুলি করছিল। আমরাও পাল্টা গুলি করছিলাম। ওরাও ফায়ার করে, আমরাও ফায়ার করি। তারপর একটা পর্যায়ে তারা পিছিয়ে গেল, সেখানে গিয়ে আমরা স্ট্রেঞ্জ (পরিকা) করলাম। কুদাল দিয়ে, কাঠ দিয়ে আমরা স্ট্রেঞ্জ (পরিকা) করে নিলাম। সন্ধ্যার পর শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ, শিবগঞ্জে পাকিস্তানিরা অবস্থান নিয়েছিল, আমরা আরও একুট সামনে অবস্থান নিয়েছিলাম। সারারাত যুদ্ধের পর তারা পিছিয়ে যাচ্ছিল, সকালে তারা জারিয়ার দিকে চলে গেছে। অমরা গিয়ে তাদের ক্যাম্প দেখলাম। দেখলাম আগুন জ্বলছে, একজন মহিলার লাশ দেখতে পেলাম পড়ে আছে। তখন আমরা জারিয়ার দিকে হাটতে হাটতে মার্চ শুরু করলাম। এভাবে আমরা ময়মনসিংহ গেলাম। জেলা স্কুলে গিয়ে আমরা অবস্থান নিলাম, এই সময় খবর পেলাম যে সারেন্ডার হয়ে গেছে, সারেন্ডার হওয়ার পথে। আসলে আমাদের কাছে খবরই ছিল না, শুধু কমান্ড শুনতাম আর যুদ্ধ করতাম, আমাদের কাজ যুদ্ধ করো, আর মরো।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭