প্রেস ইনসাইড

১/১১ নিয়ে বোল পাল্টানোর চেষ্টা মতির!


প্রকাশ: 06/05/2023


Thumbnail

২০০৭ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে ১/১১ প্রতিষ্ঠার অন্যতম কুশীলব প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান সম্প্রতি এর দায় এড়াতে বোল পাল্টানোর চেষ্টা করছেন। তিনি আজ শনিবার (৬ মে) ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে ১/১১-এর সরকারের দায় সশস্ত্র বাহিনীর উপর চাপনোর চেষ্টা করেছেন এবং এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে আবার একটি ১/১১ সৃষ্টির পায়তারা করছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। 

সূত্রটি বলছে, ২০০৭ সালের ১১ জুন প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত তার লেখার শিরোনাম ছিল, ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে’। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান সব সময়ই ছিলেন গণতন্ত্র বিরোধী। তার এই গণতন্ত্রবিরোধী অবস্থানের চিত্র বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ১/১১- এর সময়ে তার এই অবস্থান এবং আসল চেহারা সরূপে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। সেই সময়ে তিনি দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে একটি গণতন্ত্রবিরোধী এবং ১/১১-এর সরকারের পক্ষে একটি লেখা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন দুই নেত্রীকে সরে যেতে হবে। অর্থাৎ ১/১১- এর সময়ে তিনি ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র সপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিরাজনীতিকরণের অন্যতম একজন উদ্যোক্তা বলেও জানিয়েছে একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র। 

সূত্রমতে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১/১১-এর সরকারকে মূল্যায়নের প্রশ্নে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ২০০৭ সালে ১/১১-এর সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সরাসরি সশস্ত্র বাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে এবং যে দু’বছর ওই সরকার চলেছিল, তার প্রধান শক্তি ও ভিত্তিও ছিল সশস্ত্র বাহিনী। ওই সরকারের প্রধান দুটি লক্ষ্য ছিল, একটি হলো সঠিক ভোটার তালিকা তৈরি করা এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। আজকে ২০২৩ সালে এটা বলতে পারি যে, ১/১১ এর সরকার একটি সঠিক ভোটার তালিকা তৈরি এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করতে পেরেছিল, তাতে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল, ১/১১-এর সরকার সফল হয়েছিল, এক্ষেত্রে। 

মতিউর রহমানের এই বক্তব্য থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ১/১১-এর সরকার একটি সফল সরকার। দেশ পরিচালনা, নির্বাচন পরিচালনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই গণতন্ত্র বিরোধী ১/১১-এর সরকার একটি সফল সরকার। এই বক্তব্য থেকে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, ২০০৭ সালে ঠিক যে ধরনের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংবিধান বিরোধী, গণতন্ত্র বিরোধী একটি ১/১১-এর সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মতিউর রহমান গং ব্যক্তিরা। এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও ঠিক একই ধরনের আরেকটি ১/১১ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এ ধরনের বক্তব্য রেখেছেন মতি। 

প্রকৃতপক্ষে, ২০০৭ সালে ১/১১ প্রতিষ্ঠার অন্যতম কুশীলব মতিউর রহমান একটি তৃতীয় পক্ষের হাতে দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বাংলাদেশের অন্যতম গণতান্ত্রিক দু’টি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র প্রধান দুই নেত্রীকে মাইনাস করার সংস্কারেও ছিলেন এই মতিউর রহমান। তিনি তার ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে’- শিরোনামে একটি লেখায় সরাসরি দেশের প্রধান দুইটি দলের প্রধান দুই নেত্রীকে সরসরি অক্রমণ করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তার অবস্থান। কিন্তু ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এর দায় এড়াতে চেষ্টা করেছেন।        

২০০৭ সালের ১১ জুন প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে’-শিরোনামে তার লেখায় তিনি বলেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা হচ্ছে। তারা কি দলের নেতৃত্ব ছেঁড়ে দেবেন, রাজনীতি থেকে অবসরে যাবেন, না স্বেচ্ছায় বিদেশে চলে যাবেন- এসব নিয়ে এখন অনেক আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে, এখনও হচ্ছে নানা মহলে। সর্বশেষ, গত সোমবার বিবিসির সংলাপে দুই দলের জেষ্ঠ্য নেতা বলেছেন, প্রয়োজনে দুই নেত্রীকে বাদ দিয়েই সংস্কার করতে হবে।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের কাছ থেকে তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অবৈধ অর্থ-চাদা-সম্পত্তি সংগ্রহ এবং বাসে আগুন দেওয়া ও খুনের মামলা চাপা দেওয়াসহ বহু ব্যাপারে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। ক্ষমতায় থেকে বা ক্ষমতার বাইরে গিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল দুটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের চাঁদা আর দুর্নীতির যে রূপ বের হয়ে আসছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর। এসবের অনেক কিছুই আমরা জানতাম, সমাজে আলোচিত ছিল, তারপরও সত্য এত ভয়ংকর যে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো সবাইকে যুগপৎ গভীরভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। কিন্তু বেগম জিয়া বলেছেন, ‘আমার ও আমার পরিবার সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’ শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জীবনে কাউকে এক টাকাও দিতে বলিনি। কারও কাছে চাঁদা চাইনি।’ তবে দুই নেত্রীর এসব কথা কেউ বিশ্বাস করে না। এখন আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি। কিছুদিন আগে আইন ও তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছিলেন, দুই দলের নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ীই সরকার দুই নেত্রীর ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ (দুই নেত্রীকে দেশের বাইরে পাঠানো) নিয়েছিল। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে পরামর্শদাতাদের নাম প্রকাশের অনুরোধ করা হয়। জবাবে মইনুল হোসেন পরামর্শদাতাদের নাম প্রকাশ না করে আবারও একই কথা বলেন। তবে তিনি বলেন, দুই নেত্রীকে দেশে রেখে বা দলের শীর্ষে রেখে সংস্কার করা যাবে কি যাবে না- এ ব্যাপারে দলের মধ্যে দুই রকম মত থাকতেই পারে। তিনি নাম প্রকাশ করেন আর না-ই করেন, তাঁর এ বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক ও সুধীমহলে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

তবে এ কথাটি সত্য, বিএনপি ও আওয়ামী লীগে এমন অনেক নেতা, কর্মী রয়েছেন যারা দলের সংস্কার চান, পরিবারতন্ত্রের অবসান চান, দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। তবে দুই নেত্রী দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে এসব কিছু হবে না বলে তারা মনে করেন। মাঠপর্যায়ের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যেও এ রকম মনোভাব রয়েছে। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে দুই দলের ভেতরে ও বাইরে বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনাও হয়েছে। দুই দলের বড়ো নেতারা এ রকম মতামত ব্যক্ত করেছেন অপ্রকাশ্যে। তাদের কাছ থেকেই আমরা এসব কিছু শুনেছি, জেনেছি। কিন্তু তারা এতদিন প্রকাশ্যে কিছু বলতে বা কোনো অবস্থান নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। তারা এখন কিছু কিছু কথা বলছেন।  

তবে ভয়েজ অব আমেরিকার আজকের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ১/১১- এর সরকারের প্রধান যে দু’টি লক্ষ্য ছিল, একটি সঠিক ভোটার তালিকা তৈরি করা এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, দুটোতেই তারা সফল হয়েছিলেন। তবে দেশ পরিচালনায়, অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় অনেক বড় বড় ভুল-ত্রুটি ছিল, অন্যায় কার্যক্রমও হয়েছিল, যেগুলো পরবর্তীতে সমালোচিত হয়েছে। সেসব পদক্ষেপ মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। ওই ভুলগুলো রাজনীতি, অর্থনীতি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক ক্ষতির কারণ হয়েছিল এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক ক্ষতিকর ফল বয়ে এনেছিল। আমরা দেখেছি, রাষ্ট্র বা সরকার পরিচালনায় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ কোনো ভালো ফল বয়ে আনেনি, বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায়ও দেখি রাজনীতি বা সরকার পরিচালনায় সেনাবাহিনীর হস্তুক্ষেপ কোনো দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না, বরং নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভয়েজ অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মতিউর রহমান সেনা বাহিনী পরিচালিত সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও ২০০৭ সালের ১১ জুন মাসে তার পত্রিকায় প্রকাশিত তার ওই লেখায় তিনি ১/১১-এর সরকারের পক্ষে স্তুতি গেয়ে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলের জেরার মুখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক দুই বড়ো দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং বড়ো ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য ও বক্তব্য থেকে দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির যেসব তথ্য বের হয়ে এসেছে, তাতে আবার প্রধান দুই নেত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলচনা শুরু হয়েছে। এ কথা বেশ জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে যে, যারা দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছেন, যারা দলের জন্য ও নিজের জন্য বহু সম্পদ গড়ে তুলেছেন, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যা-খুনের সঙ্গে জড়িত, তাদের নেতৃত্বে রেখে দল বা দেশের জন্য কী লাভ হবে? ১৫ বছর ধরে সরকার ও বিরোধী দলে থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দেশকে প্রায় ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছেন। বিএনপির বিগত সরকার যারপরনাই ক্ষতি করেছে দেশের। ২২ জানুয়ারির নির্বাচন হলে দেশে আরও সর্বনাশ হতো। কোনোভাবে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের আরও ভয়ংকর রূপ আমরা দেখতাম। আর কোনোভাবে আওয়ামী লীগ জিতে গেলে তারাও আগের রেকর্ড ভঙ্গ করত। তাঁর সব লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল।  

প্রকৃতপক্ষে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভয়েজ অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বোল পাল্টানোর চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের বোল পাল্টানো মতিউর রহমানের নতুন কোনো বিষয় নয়। বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে এবং একটি গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে বহুবার বহু রকমের বোল পাল্টিয়েছেন। তবে এই সাক্ষাৎকারে তিনি নির্বাচনকালীন সময়ে ১/১১-এর সরকারকে সফল বলে মন্তব্য করেছেন। এবার আবার একটি ১/১১-এর সরকার প্রতিষ্ঠা বা অন্য কোন স্বার্থে নতুন করে বোল পাল্টিয়েছেন কি না মতিউর রহমান- সেটিই এখন দেখার বিষয়। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭