ইনসাইড বাংলাদেশ

কয়েক যুগ ধরে শিক্ষা ও উন্নয়ন বঞ্চিত লক্ষ্মীপুরের একটি গ্রামের ৩ হাজার অধিবাসী


প্রকাশ: 28/05/2023


Thumbnail

আন্দারমানিক নামটি শুনলেই মনে ভেসে ওঠতে পারে আধাঁরের মধ্যে হয়তো আলোর ঝলকানি। কিন্ত গ্রামটির পুরোটা এত অন্ধকার যে, মনে হয় যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোন গ্রাম। শিশুদের জন্য ৪ কিলোমিটারের মধ্যে সরকারি কোন প্রাইমারি স্কুল নেই, ভালো রাস্তা নেই, বর্ষাকালে হাঁটা যায় না। এ গ্রামে কেউ আত্মীয়তা করতে চায় না। প্রাথমিক চিকিৎসারও কোন ব্যবস্থা নেই। গ্রামের এক মাত্র কাঁচা রাস্তাতে ৭-৮ ফুট উচূঁ একটি কালভার্ট গ্রামকে দ্রুত যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এ গ্রামেই রয়েছে ৯টি ইটভাটা। প্রায় সময় হয় চুরি, ডাকাতি।

শিক্ষায় অবহেলিত ও দীর্ঘদিনের উন্নয়ন বঞ্চিত এ গ্রামের নাম দক্ষিণ আন্দারমানিক। গ্রায় ৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ গ্রামে ৩ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস রয়েছে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারিগঞ্জ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের এ গ্রামে কোন জনপ্রতিনিধির পা পড়েনি বলে গ্রামবাসীর অভিযোগ। 

এখন ক্ষুব্দ গ্রামবাসীরা রাস্তা ও স্কুলের জন্য লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয় ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সরেজমিনে গেলে স্থানীয়রা জানায়, উন্নয়ন বলতে গত বছর পাঁচেক আগে সরকারের শতভাগ বিদ্যুৎতায়নের আওতায় গ্রামটিতে বিদ্যুৎ এসেছে। এছাড়া আর কিছুই হয়নি।

কৃষক মোঃ নোমান জানায়, গত ৪০ বছরের মধ্যে এ গ্রামের রাস্তায় একমুঠো মাটি পড়েনি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ গ্রাম এড়িয়ে চলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান কিংবা সংসদ সদস্য কেউই জীবনে এ গ্রামে আসেনি। শুধু নোমানই না, তার সাথে গ্রামের অন্তত ৫০ জন মানুষের সাথে কথা বললে সবাই একই অভিযোগ করেন।

রিকসা চালক হাসান জানায়, গ্রামের শিশুদের জন্য সরকারি প্রাইমারি স্কুল নেই। গ্রামের বেশির ভাগ শিশু স্কুলে যেতে পারে না। গ্রামবাসীদের অনুদানে চলা একমাত্র বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি  ঠিক মতো চলতে পারছে না। কারণ শিক্ষকরা বেতন পায় না, সরকারের কোন প্রকল্প থেকেও কোন সহায়তা নেই। তাই বিনে পয়সায় আর কত দিন ?

মোঃ শামছুল আলম কাবুল নামের এক ব্যক্তি জানায়, পুরো গ্রামের সব মানুষ কৃষক ও শ্রমজীবি। তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ৫৫ বছর আগে মোঃ শামছুল আলম কাবুলের বাবা আক্তারুজ্জামান নিজে নিরক্ষর থাকা সত্ত্বেও গ্রামে একটি স্কুল স্থাপনের জন্য ৫০ শতক জমি দান করেছিলেন।

পরে গ্রামবাসীরা সেই জমিতে গড়ে তোলেন দক্ষিণ আন্দারমানিক এ জামান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।  নিরক্ষর ও কৃষক গ্রামবাসীদের দান  অনুদানে ১৯৯১ সাল থেকে বিদ্যালয়টি নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে ৩৩ বছর পার করছে। এর মাঝে দেশব্যাপী ২৬ হাজার বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হলেও একমাত্র বাদ পড়ে দক্ষিণ আন্দারমানিক এ জামান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। 

প্রধান শিক্ষক মোঃ লুৎফর রহমান জানায়, শিক্ষকরা দীর্ঘদিন বিনা বেতনে গ্রামের প্রায় আড়াইশ ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার দায়িত্বে রয়েছেন। কিন্ত তাদেরও তো সংসার রয়েছে। আমরা সরকার কিংবা অন্য কোন সংস্থা থেকে কোন প্রকার দান অনুদান পাই না।

মোঃ লুৎফর রহমান জানায়, এর মাঝে আরো করুণ বিষয় হলো, ২০১৯ সালে ঝড়ে এ বিদ্যালয়ের টিনের ছাউনি উড়িয়ে নেয়। তখন আমরা চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও এবং জেলা প্রশাসকের নিকট সহযোগিতার জন্য বারবার সশীররে গিয়ে দরখাস্ত করি। কিন্ত কেউই ৫ টাকা দিয়েও সহযোগিতা করেনি। অথচ প্রতিদিন আমরা শুনি সব জায়গায় নাকি সরকারের সহযোগিতা রয়েছে।

অন্যদিকে কমান্ডার মোহাম্মদ উল্লাহ নামের এক ব্যক্তি জানায়, গ্রামের মাঝ বরাবর একমাত্র কাঁচা রাস্তাটিতে রয়েছে রাস্তা থেকে ৭-৮ ফুট ওপরে সুউচ্চ একটি ভাঙ্গা কালভার্ট। কালভার্টির কারণে গ্রামের কাঁচা রাস্তাটিতে রিকসা, সাইকেল চলতে পারে না। এ গ্রামে সহজে কেউ যাতায়াত করতে পারে না। নানা দিকে গ্রামবাসীর কষ্টের শেষ নেই।

মোঃ আইম্যান নামের এক তরুণ জানায়, গ্রামে প্রায় সময় চুরি, ডাকাতি হয় এবং অপহরণের ঘটনাও ঘটছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো না। এ তরুণ জানায়, উন্নয়ন বলতে গত বছর পাঁচেক আগে সরকারের শতভাগ বিদ্যুৎতায়নের আওতায় গ্রামটিতে বিদ্যুৎ এসেছে। এছাড়া আর কিছুই হয়নি। তবে গ্রামবাসীর এত কষ্টের মাঝেও এ গ্রাম জুড়ে রয়েছে ৯টি ইটভাটা। ইটভাটা গুলো গ্রামবাসীদের কষ্টকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

দক্ষিণ আন্দারমানিক এ জামান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন জানায়, গ্রামের একমাত্র বিদ্যালয়টি টিকিয়ে রাখতে আমরা সংগ্রাম করে যাচ্ছি। বিভিন্ন দপ্তরে হাটঁতে হাটঁতে এখন ক্লান্ত। গ্রামে ভালো রাস্তা নেই, বর্ষাকালে হাঁটা যায় না। এ গ্রামে কেউ আত্মীয়তা করতে চায় না। চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই।

তিনি ক্ষোভের সাথে জানান, পত্রিকায় একটি সংবাদ দেখে অবাক হয়েছি যে, গত ৬ মার্চ তারিখে লক্ষ্মীপুর জেলার প্রথম স্মার্ট ভিলেজ হিসেবে যে গ্রামের গেইট উন্মোচন করা হয় সে স্মার্ট হোসেনপুর গ্রাম এবং চরম উন্নয়ন বঞ্চিত দক্ষিণ আন্দারমানিক গ্রাম একই ইউনিয়ন তেওয়ারিগঞ্জে অবস্থিত।

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন জানায়, এটা আমাদের জন্য লজ্জার আর অপমানের। কারণ আমরা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছি। কিন্ত একই ইউনিয়নের আরেকটি গ্রাম বিলাসি হচ্ছে। আমরা এর বিচারের ভার ছেড়ে দিলাম সৃষ্টিকর্তার ওপর।

তিনি এমন বৈষম্য দূর করার জন্য দক্ষিণ আন্দারমানিক এ জামান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে জাতীয়করণ এবং গ্রামের একমাত্র কাঁচা রাস্তাটি সংস্কারসহ উন্নয়নের দাবি জানান।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তেওয়ারিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক ইবনে হোছাইন জানান, তিনি নিজে এলজিএসপি প্রকল্পের একটি তালিকায় দক্ষিণ আন্দারমানিক এ জামান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন। তবে উপজেলা পিআইও অফিস তালিকা থেকে বিদ্যালয়টির নাম কেটে দিয়েছে। অন্যদিকে গ্রামের মাটির রাস্তায় চেয়ারম্যানের কোন কিছু করার নেই বলে জানান তিনি।

একই বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু জানান, গ্রামটির বিষয়ে কেউ তাকে জানায়নি। এখন যেহেতু জেনেছেন তাই শীঘ্রই তিনি এলাকাটি পরিদর্শন করে গ্রামের রাস্তা ও বিদ্যালয়টির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭