ইনসাইড থট

পলিথিন নিষিদ্ধ আইনের বাস্তবায়ন চাই


প্রকাশ: 05/06/2023


Thumbnail

পলিথিন একটি অপচনশীল (non-biodegradable) পদার্থ। দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে অবিকৃত অবস্থায় থেকে মাটিতে সূর্যের আলো, পানি এবং অন্যান্য উপাদান প্রবেশে বাঁধা সৃষ্টি করে, মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে, উপকারী ব্যাকটেরিয়া বিস্তারে বাঁধা সৃষ্টি করে। পলিথিন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হওয়ার আগে এক হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী অবস্থায় থাকতে পারে এবং নদী, সমুদ্রে জমা হয়। সেখানে অতি ক্ষুদ্র টুকরায় ভেঙ্গে যায়। এসব টুকরা মাছ খায় কিন্তু হজম হয় না। মাছের পেটে জমা হতে থাকে এবং তা খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে।  সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যাগ জলাশয়ের অতিরিক্ত দূষণকারী কীটনাশক ও শিল্পবর্জ্য শোষণ করে এবং তা জলাশয়ের প্রাণে বড় মাত্রায় ছড়িয়ে দেয়। তখন ক্ষতিকর পদার্থ খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে। পলিথিন প্রজনন সিস্টেম ব্যাহত করে, বন্ধ্যাত্ব, ক্যান্সারের সৃষ্টি করে। পলিথিনে মোড়ানো গরম খাবার গ্রহণ করলে ক্যান্সার ও চর্মরোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। ওভেনপ্রম্নফ প্লাষ্টিক কনটেইনারে খাবার গরম করলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে খাবারে ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, সীসা মিশে যায়। যার ফলে মারাত্মক রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। পলিথিন থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ত্বকের বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়। এ ব্যাকটেরিয়া থেকে ডায়রিয়া ও আমাশয় ছড়াতে পারে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপকহারে ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর নিষিদ্ধ পলিথিন। অন্যদিকে কাপড়ের মতো দেখতে এক ধরনের রঙিন পলিথিন টিস্যু (যা চায়না টিস্যু নামে পরিচিত) ব্যাগে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। পরিবেশবান্ধব পাটজাত দ্রব্য, কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙা, কাপড়ের ব্যাগ ইত্যাদি বিকল্প থাকা সত্ত্বেও আইন অমান্য করে নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, মজুত, পরিবহন, বিপণন, বাজারজাত ও ব্যবহার করা হচ্ছে। রফতানিকৃত পণ্যের বাজারজাত, প্যাকেজিং, নার্সারির চারা, রেণুপোনা পরিবহন এবং মাশরুম চাষের ক্ষেত্রে পলিথিন উৎপাদনের ছাড়পত্র নিয়ে পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরী করে বাজারজাত করা হচ্ছে। পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানীকৃত পলিপ্রোপাইলিন ব্যবহৃত হচ্ছে।

রাজধানীসহ সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরীর প্রায় এক হাজার দুই শত কারখানা রয়েছে। এগুলোর বেশীর ভাগই পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক। পুরান ঢাকার অলি—গলিতে রয়েছে প্রায় তিন শত কারখানা। কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, টঙ্গীতে ছোট—বড় বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। ঢাকা ও আশেপাশের এলাকা ছাড়াও চট্রগ্রামসহ জেলা শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে শত শত পলিথিন কারখানা। ‘জরুরী রফতানি কাজে নিয়োজিত’ লেখা যানবাহনে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন।

ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন আড়াই কোটির বেশী পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা—নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশী টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ পলিথিনের হলেও কাপড়ের ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। শপিং মল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কাপড়ের দোকান, জুতার দোকান, ফ্যাশন হাউজ, বিভিন্ন কোম্পানিসহ সারা দেশের বাণিজ্যিক বিতানগুলো টিস্যু ব্যাগ ব্যবহার করছে। নিষিদ্ধ পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ফলে কাগজ, পাট ও কাপড়ের ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ৬ক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার সকল বা যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে। তবু পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশ পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০ (২০০২ সনের ১০ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ২(খ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পলিথিন শপিং ব্যাগ সংক্রান্ত অপরাধসমূহের ব্যাপারে মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের এস আই/সমপর্যায় হতে এ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ পর্যন্ত; মেট্রোপলিটন বহির্ভূত এলাকায় এস আই/সমপর্যায় হতে সহকারী পুলিশ সুপার পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তাগণকে ০৪ মে ২০০২ তারিখের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উক্ত আইনে সংজ্ঞায়িত “পরিদর্শক” এর ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এখানেও নেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ।

২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা দেশের জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নের ফলে পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তায় বর্তমানে আইনটি সম্পূর্ণ অকার্যকার হয়ে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড—এর সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব। পলিথিন নিষিদ্ধের আইন প্রণয়নের পর তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের ফলে বিকল্পের চাহিদা দেখা দেয় এবং তা বাজারে চলে আসে। আইনের প্রয়োগ শিথিল হওয়ার সাথে সাথে বিকল্পের চাহিদা কমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা শূণ্যের কোটায় নেমে আসে। নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন বন্ধ হলে বিকল্পের চাহিদা সৃষ্টি হবে এবং তা বাজারে চলে আসবে।

বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত রুটিন ওয়ার্ক তথা বাজারে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন পলিথিন উৎপাদান বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আইন বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদপ্তর সক্রিয় র্ভমিকা পালন করবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা। বাংলাদেশ পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধকারী প্রথম দেশ হিসাবে বিশ্ববাসীর প্রসংশা কুড়িয়েছে। পলিথিনের বিকল্প হিসাবে জনগণের চাহিদার প্রেক্ষিতে কাগজের ব্যাগ, প্যাকেট ও ঠোঙা, কাপড়ের ব্যাগ, চটের ব্যাগ, পাটের বিভিন্ন সামগ্রী বাজারে চলে আসে। ঢাকার বিভিন্ন বাজারে এসব বিকল্পের পাইকারি দোকান গড়ে ওঠে। এছাড়াও জনগণ বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে বাজারে যেতেন। বিকল্প তৈরিতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে গ্রামীন নারীদের। আইন প্রয়োগে শিথীলতা এবং জনসচেতনতা ধরে রাখার ব্যর্থতার কারণে পলিথিন সমহিমায় আবার তার পূর্বের অবস্থান ফিরে আসে। এমনকি আগের চেয়েও বেশি ব্যবহার হচ্ছে। একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকা মহানগরীতে যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, তার অন্যতম প্রধান কারণ পলিথিন, প্লাস্টিক। এগুলো পানি চলাচল ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি করে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখে।

এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে সামিল হই সকলে’ (Solution to Plastic Pollution) এবং সেস্নাগান হচ্ছে সবাই মিলে করি পণ বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ (Beat Plastic Pollution)। জনগণকে একসঙ্গে কাজ করা এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোর একটি মোকাবেলা করার আহবান জানানোর লক্ষ্যে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)  এ প্রতিপাদ্য ও স্লোগান নির্ধারণ করেছে। যার মাধ্যমে প্লাস্টিক ব্যবহার কমে আসবে। এক্ষেত্রে একটি টেকসই উপায় হচ্ছে ব্যবহার কমানো এবং পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়ন বাড়ানো।

কিছু ব্যক্তি, এমনকি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তা বলে থাকেন যে, পর্যাপ্ত বিকল্পের অভাবে নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধ করা যাচ্ছে না। এসব ব্যক্তি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না জানিয়ে বরং পলিথিন উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। আর মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বিকল্পের অজুহাত খাড়া করছেন।

আসুন আমরা জনগণ বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাই, খাদ্য সরবরাহবারীকে নন—প্লাস্টিক প্যাকেজিং ব্যবহারে চাপ প্রয়োগ করি, পানির বোতল কেনা এড়িযে চলি, নিজের বোতল সঙ্গে রাখি, প্লাস্টিক কাটলারি বর্জন করি। নিজেদের এবং পরবর্তর্ী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেচে থাকার জন্য আমাদেরকে পরিবেশ সংরক্ষণের সংগ্রামকে আরো বেগবান করতে হবে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি প্রতিদিনই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

সুপারিশ :

·         পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় ভুমিকা পালন করা।

·         পলিথিন শপিং ব্যাগ ও টিস্যু ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

·         নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।

·         পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা ইত্যাদি সহজলভ্য করা এবং এগুলো ব্যবহারে জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করা।

·         বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানীকৃত পলিপ্রোপাইলিন পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

·         টিস্যু ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল আমদানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

·         পরিবেশ অধিদপ্তর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

·         পরিবেশ অধিদপ্তর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭