ইনসাইড বাংলাদেশ

‘দাদা ভাই’ চলে গেলেন ওপারের অন্ধকারে


প্রকাশ: 09/06/2023


Thumbnail

শেষবার যখন দেখা, সেটাই প্রথমবার। উদ্দেশ্য ছিল একটি বেসরকাররি টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য সাংবাদিক হিসেবে তার একটা সাক্ষাৎকার নিবো। টেলিভিশনটির প্ল্যানিং এন্ড কন্টেন্ট এডিটরের সঙ্গে কথা বলেই গিয়েছিলাম। তিনি যদি রাজি থাকেন তাহলে গাড়িসহ ক্যামেরা পাঠাবেন তিনি। তিনি এটাও বলেছিলেন, তিনি-তো (সিরাজুল আলম খান) সাক্ষাৎকার দেন না। দেখেন, যদি আপনি রাজি করাতে পারেন, তাহলে ক্যামেরা পাঠানো যাবে। সিরাজুল আলম খান দাদা ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনষ্টিটিউট থেকে পাশ করা একজন বড় আপার মাধ্যমে। আপার লেক সার্কাস কলাবাগানের বাসার যে বিল্ডিংটা, সেই বিল্ডিংয়েই থাকতেন দাদা ভাই।

আপার সাথে কথা বলে একদিন গিয়ে হাজির হলাম। সময় তখন ঠিক সন্ধ্যা। প্রথমে আপার বাসার ড্রইং রুম। পরে আপাই নিয়ে গেলেন দাদা ভাই সিরাজুল আলম খানের ফ্ল্যাটে। তিনি সেখানে একাই থাকেন, দুই জন ব্যক্তিগত সহকারী রাসেল এবং জুলেয়, তার সেবা-শুশ্রূষা করে থাকেন বলেই জানতে পারলাম। জীবনে বিয়ে করেননি দাদা ভাই সিরাজুল আলম খান। তার একজন বড় ভাইয়ের মেয়ে আছেন, পেশায় ডাক্তার। তিনি ওই বাসাতেই থাকেন এবং তাকে (সিরাজুল আলম খান) দেখাশোনা করেন। আমার সাথে যখন দেখা হয়, তখন তিনি অনেক অসুস্থ, জীবন সায়াহ্ন লগ্নে তিনি। যতটুকু মনে পরে, এক সাথে ১৫কি ১৬টি ওষুধ খেয়েছিলেন তিনি। মানে ওষুধ খেয়েই বেঁচে থাকতে হতো তাকে। 

যাক, সময়টা সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে। আমি আপার সাথে গিয়ে উপস্থিত হলাম দাদা ভাই সিরাজুল আলম খানের ফ্ল্যাটে। ঠিক তখন দাদা ভাইয়ের রাতের খাবার শেষ করে ওষুধ খাবার সময় হয়েছে। আমাকে ডাইনিং টেবিলের পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে আপা বললেন, তুমি বসো, আমি আসছি। এই বলে আপা বেড়িয়ে গেলেন। আমাকে চা-বিস্কুট দেওয়া হলো। দাদা ভাইয়ের সহকারী ছেলেটা রাসেল। সে এসে চা-বিস্কুট দিয়ে গেলো। ডাইনিং টেবিলের ঠিক মাথার চেয়ারটাতে আমি বসে চা-বিস্কুট খাচ্ছিলাম। দাদা ভাই এলেন, তিনি ঠিক উল্টো পাশের মাথার চেয়ারটাতে বসলেন। সহকারী রাসেল উনাকে রাতের খাবার খেতে দিলো- মাছ, ভাত, ডাল, সবজি। দাদা ভাই খেতে খেতেই আমার সাথে কিছু কথা বললেন। জানালেন তার শারীরিক অসুস্থতার কথা। আমি চুপচাপ সময় কাটালাম। তখনও ঠিক সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়টি সাহস করে বলিনি।

দাদা ভাইয়ের খাওয়া শেষ হতে না হতেই আপা আবার এলেন। খাবার শেষ হলে দাদা ভাই গেলেন নিজের শোবার ঘরে। আপা আমাকে সাথে নিয়ে সে ঘরে গেলেন। দেখলাম, প্লাস্টিকের বক্স ভর্তি করা ওষুধ। একবেলায় ১৫/১৬ টা ওষুধ খেতে হয়। দাদা ভাই জানালেন অসহায়ত্বের কথা। কথায় কথায় অনেকটা মিশে গেলাম আমি। দাদা ভাই আমাকে আপন করে নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন বিয়ে করেছি কি না। আপাকে আমি ইশারা করে সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়টা বলতে বললাম। আপা অবশ্য আমাকে আগেই বলেছিলেন, তিনি সাক্ষাৎকার দেন না। তারপরও আপা বললেন, দাদা ভাই, ও আপনার একটা সাক্ষাৎকার করতে চায়। তখন প্রশ্ন ওঠলো আমি কি করি। মানে কি আমার পেশা? 

জিজ্ঞেস করলেন কোথায় কাজ করি? যথারীতি বলালাম। তিনি জানালেন, তিনি কাউকে সাক্ষাৎকার দেন না। অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তার সাক্ষাৎকার নিতে চাইছে। কিন্তু তিনি দিচ্ছেন না। তিনি বললেন, ‘আমার সম্পর্কে যদি জানতে চাও, তাহলে তুমি আমার লেখা দুইটি বই আছে পড়ে নিতে পারো। এই বই পড়লে তুমি আমার বক্তব্য পাবে। বাংলাদেশের রাজনীতির সঠিক ইতিহাস জানতে পাবে। এখনতো ইতিহাস অনেক বিকৃত হয়ে গেছে।’ 

অনেক অনুরোধ করলাম, কিন্তু তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেন না। তিনি জানালেন তার দুইটি বই সরকার নিষিদ্ধ করেছে। ওই বইগুলো মুদ্রিত এবং প্রকাশিত হয় না। জীবনের অর্ধ যুগেরও বেশি সময় তিনি জেল খেটেছেন। যে কারণে তার সংসার করা হয়ে ওঠেনি। কাজ করেছেন দেশের জন্য, দেশের রাজনীতির জন্য।   

তিনি বললেন, ‘তুমি তো সাংবাদিক। তুমি তো বেশ্যা। এই পেশাটা আমার পছন্দ নয়।’ 

মনে মনে অপমানিত বোধ করলেও আমি চুপ হয়ে রইলাম। আবার তিনি বললেন, ‘তুমি কখনও নিউ ইয়র্ক টাইমসে কাজ করতে পারবে কি না জানি না, যদি কখনও করার সুযোগ হয়, তাহলে চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে যে রিভ্যুলুশন হয়েছিল, সেই রিভ্যুলুশনকে তোমার একটা পুর (ছোট/গরীব) রিভ্যুলুশন বলতে হবে। আবার যদি তুমি কোনো চায়না দৈনিকে কাজ কর, তাহলে চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারের রিভ্যুলুশনকে তোমার বিশ্বের সেরা রিভ্যুলুশন বলতে হবে বা লিখতে হবে। এটাই তোমার পেশা। তুমি যখন যার হয়ে কাজ করবে। তখন তুমি তারই পক্ষে লিখবে।’

ওই দিন দাদা ভাই সিরাজুল আলম খানের সাথে অনেক কথা হয়। তার অভিযোগ, তার অর্জন অনেক কথাই বলেন তিনি। অনেকক্ষণ আড্ডা হয়। কিন্তু তার সবগুলো কথা আমার মনে না থাকলেও সাংবাদিকতা নিয়ে, আমাকে নিয়ে বলা তার কথাগুলো এখনও আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে। হয়তো মনে থাকবে আজীবন। 

আজ শুক্রবার (৯ জুন) বাংলাদেশের রাজনীতির সেই ‘রহস্য পুরুষ’ সিরাজুল আলম খান (দাদা ভাই) মারা গেলেন। আর কোনো দিনও তার সাক্ষাৎকার নেওয়া আমার হবে না। কিন্তু সেদিন তিনি কথায় কথায় অনেক বড় একটা সাক্ষাৎকার আমাকে দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটি হয়তো তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য দেননি, কিন্তু তিনি আমার নিজের জীবনের জন্য সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন।

আজ দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরাতন ভবনের চতুর্থ তলার আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মারা যান দাদা ভাই সিরাজুল আলম খান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ সূত্রমতে, অসুস্থ সিরাজুল আলম খানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে ১ জুন আইসিইউতে রাখা হয়। অবস্থার অবনতি হলে গতকাল বৃহস্পতিবার (৮ জুন) রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়।

সিরাজুল আলম খানের জন্ম নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে, ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি। তার বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন, গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদক হন সিরাজুল আলম খান। ১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয় তার উদ্যোগেই। স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্রনেতারা। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি কখনও নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের পরামর্শক হিসেবে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত। তাকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকেন। সিরাজুল আলম খান কখনও জনসমক্ষে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে তিনি পরিচিত।   

মহিউদ্দিন আহমদ রচিত ‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’ বইটিতেই সিরাজুল আলম খান তার জীবনের শেষ ইচ্ছার কথা বলেছিলেন। সেটি হলো, ‘আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।’

দাদা ভাই সিরাজুল আলম খানের সাথে ওই দিনের সাক্ষাৎকারেও তিনি আমাকে তার মায়ের শাড়ির কথাটি বলেছিলেন। বলেছিলেন জীবনের অর্ধযুগেরও বেশি সময় জেলহাজতে অতিবাহিত হওয়ার কথা। বলেছিলেন, যৌবনের সুবর্ণ সময়টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে উৎসর্গ করে নিজের জীবনের সংসার না হওয়ার কথা। বলেছিলেন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কথা। প্রচারবিমুখ মানুষ হিসেবে হয়তো তিনি ক্যামেরার সামনে আমাকে সেদিন সাক্ষাৎকার দেননি। কিন্তু তিনি সেদিনই জানিয়েছিলেন তার জীবনের অনেক অজানা কাহিনী, অনেক অভিযোগ, অনুযোগ। সেই দাদা ভাই আজ চলে গেলেন ওপারের অন্ধকারে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭