এডিটর’স মাইন্ড

‘নৌকা’ ডোবাতে মরিয়া কতিপয় মন্ত্রী এবং আমলা


প্রকাশ: 10/06/2023


Thumbnail

মঙ্গলবার (৬ জুন) ১০টায় একজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে আমার সাক্ষাতের কথা। সাড়ে ১০টা বাজে তার কোনো খবর নেই। ভদ্রলোক একটি অধিদফতরে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। দেরি দেখে তাকে ফোন করলাম। বললেন, ‘ভাই আসছি। সাত দিন বাসায় পানি নেই। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় গেছি গোসল করতে। এই গরমে বাঁচব কীভাবে।’ তিনি এলেন দেড় ঘণ্টা পর। বললেন, লোডশেডিংয়ের অত্যাচারে ফ্ল্যাটের পানির পাম্প নষ্ট হয়ে গেছে। এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে নতুন পাম্প কেনার সামর্থ্য নেই মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট বাসিন্দাদের। অগত্যা কী করা। এখানে-ওখানে উদ্বাস্তুর মতো গিয়ে গোসল সারতে হচ্ছে। তিনি জানালেন, এর আগের দিন সপরিবারে অফিসে গেছেন। সেখানে স্ত্রী, সন্তান গোসল সেরেছেন। একজন মধ্যস্তরের সরকারি কর্মকর্তার যখন এই হাল, তখন আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা কী অবস্থায় আছি বলাই বাহুল্য। লোডশেডিং এখন এক বিভীষিকার নাম। আগে মানুষ অসন্তুষ্ট ছিল। এখন ক্রমশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। কখন এই ক্ষোভ বিস্ফোরণে রূপ নেবে কে জানে? সেদিন একজন আওয়ামী লীগ নেতা, যিনি নিয়মিত টকশোতে যান, বলছিলেন, ‘ভাই আর টকশোতে যেতে ভালো লাগে না। বিদ্যুৎ নিয়ে কী বলব? কয়েকজনের অপকর্মের দায় কেন আমাদের নিতে হবে? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যারা মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ান, মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, তারা এখন উদ্বিগ্ন নন, আতঙ্কিত। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী টানা ৯ বছর ধরে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। এই মন্ত্রণালয়ে আবার একজন ‘আজীবন’ উপদেষ্টাও আছেন। আমি এসব নিয়ে সমালোচনা করতে চাই না। উপদেষ্টা এবং প্রতিমন্ত্রীর ভুলের ফিরিস্তিও এখানে তুলে ধরার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু প্রতিমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশের ভঙ্গি দেখে আমি হতবাক এবং বিস্মিত। লোডশেডিং নিয়ে সংসদে এবং সংবাদ সম্মেলনে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। মনোবিজ্ঞানে বহুল প্রচলিত একটি বিষয় হলো ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা শরীরী ভাষা। একজন মানুষের কথা কতটা সত্য, আন্তরিক এবং হৃদয় থেকে উৎসারিত তা শরীরী ভাষায় বোঝা যায়। নসরুল হামিদের দুঃখ প্রকাশটা নিবিড় পরীক্ষার জন্য কোনো মনোবিজ্ঞানীকে দেখানোর দরকার নেই। মনোবিদ ছাড়াই বলে দেওয়া যায়, তাঁর দুঃখ প্রকাশটা দায়সারা, ঔদ্ধত্যপূর্ণ। এর কারণ জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন। জনবিচ্ছিন্ন হলে একজন জনপ্রতিনিধির কী হয়, তার বিজ্ঞাপন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘সমন্বয়হীনতার’ জন্য কয়লা আমদানি ঠিকঠাক মতো হয়নি। কার সমন্বয়হীনতা? কে বা কারা কয়লা আমদানিকে দীর্ঘসূত্রতার জালে বন্দি করল? প্রতিমন্ত্রীকে এসব প্রশ্নের উত্তর ঝেড়ে-কেশে দিতে হবে। বিদ্যুৎ খাতের সবকিছুতেই রহস্যের ধোঁয়াশা। লুকোচুরি খেলা। সবকিছুর মধ্যেই সমন্বয়হীনতা। লোডশেডিংয়ের অত্যাচারে চিলেচ্যাপটা হওয়া প্রতিটি মানুষই জানেন বিদ্যুৎ খাতে পুকুরচুরির গল্প। হাটে বাজারে শুনি মানুষের কথা। কে কত হাজার কোটি টাকা চুরি করেছেন। কে দুবাইয়ে শপিং মল কিনেছেন। ঢাকার অদূরে একটি আস্ত গ্রাম কিনে ফেলেছেন কে? বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বনানীর যে সড়কে থাকেন সেখানে কখনো বিদ্যুৎ যায় না, এমন খবরও সংবাদপত্রের পাতায়। এসব নিয়ে এখন প্রকাশ্যে আলোচনা হয়, সঙ্গে চলে খিস্তি। আমি দুর্নীতির ফিরিস্তি দেব না। অতি সাধারণ কিছু জিজ্ঞাসা মনের ভিতর উঁকিঝুঁকি দেয়। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথাই ধরা যাক। ২০১৬ সালে পিডিবি পায়রা থেকে বিদ্যুৎ কিনতে চুক্তি করে। চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে। সুদের হার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের চেয়ে অনেক বেশি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। আর দ্বিতীয় ইউনিট কাজ শুরু করে ওই বছরের আগস্টে। বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলো বটে, কিন্তু বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন হয়নি। তাই জনগণ পায়রা থেকে বিদ্যুৎ পায়নি। অথচ চুক্তি অনুযায়ী দেড় বছর ধরে প্রতিদিন বড় অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে পিডিবিকে (আসলে জনগণকে)। শুরুতেই লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুতে যে বিপুল ভর্তুকির কথা বলা হয়, সেই ভর্তুকির গুড় কে খায়? এটা কি নিছকই ভুল? নাকি ইচ্ছাকৃত লুণ্ঠন?

লোডশেডিংয়ের ভয়াবহতায় বর্তমান সরকারের ১৪ বছরের সাফল্য পানসে, বিবর্ণ এবং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ ক্ষেপে উঠছে। তাই বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এটিকে যতই ‘আকস্মিক’ বলুন না কেন; এটি হঠাৎ করে ঘটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এটি এক পরিকল্পিত নীলনকশার বাস্তবায়ন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতারা লোডশেডিং এবং বিদ্যুৎ খাতের লুণ্ঠন নিয়ে কথা বললেই বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলের কথা বলেন। মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে প্রতিমন্ত্রী সেই একই ভাঙা রেকর্ড বাজিয়েছেন। বিদ্যুৎ দিতে পারেনি এ জন্যই তো বিএনপি-জামায়াত জোট জনরোষে পড়েছিল, কানসাটে বিক্ষোভ হয়েছিল, মানুষ জীবন দিয়েছিল। বিএনপি তো তার ব্যর্থতার শাস্তি পেয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ সরকারকে কি সেই একই পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে না? গত সাড়ে ১৪ বছরে এই সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর একটি ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’। এটি প্রধানমন্ত্রীর ১০টি উদ্যোগের একটি। অন্ধকার থেকে বাংলাদেশকে আলোকিত করেছিলেন শেখ হাসিনা। এ দেশের মানুষ লোডশেডিং ভুলে গিয়েছিল। চার্জার, আইপিএস, জেনারেটর ইত্যাদি সামগ্রী ক্রমশ হয়ে উঠছিল অচেনা। কিন্তু বিদ্যুৎ খাত আবার বাংলাদেশকে ২০০২ সালে নিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গর্ব এবং অর্জন ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী এবং আমলারা। কদিন আগে বিদ্যুৎ সেক্টরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কারা কাজ করছে, তাদের একটি তালিকা দেখছিলাম। এদের একটি বড় অংশের পারিবারিক পরিচয় বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্ট। শিক্ষাজীবনে এরা ছাত্রদল কিংবা শিবির করেছে। এদের কেউ কেউ আবার সীমাহীন দুর্নীতিবাজ। মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এরা গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর পদ পেয়েছে। এরাই বিদ্যুৎ খাতের সর্বনাশ করছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘জ্বালানি স্বনির্ভরতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জ্বালানি স্বনির্ভরতার কোনো আগ্রহ নেই বিদ্যুৎ খাতের কর্তাদের। এই যেমন ভোলার ইলিশায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। শুধু এ গ্যাস দিয়েই বাংলাদেশের ১০ বছরের গ্যাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। কিন্তু নানা অজুহাতে ভোলার গ্যাস দেশের গ্যাস গ্রিডে আনা হচ্ছে না। এর কারণ দুর্নীতি। আমদানি না করলে উপরি উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। তাই গ্যাস অনুসন্ধানের আগ্রহ নেই জ্বালানি বিভাগের। লোডশেডিং নিয়ে সাধারণ মানুষের আর্তনাদ সাম্প্রতিক। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ে হাহাকার চার বছর ধরেই চলছে। দাবদাহের চেয়েও তীব্র এখন বাজারের উত্তাপ। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই তিনি অপরিহার্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তিনি না থাকলে এই মন্ত্রণালয় ধ্বংস হয়ে যাবে। তা না হলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থ এবং অযোগ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে তিনি কীভাবে চুক্তিতে নিয়োগ পান? দ্রব্যমূল্যের বিষয়টা অনেকটা সার্কাস কিংবা ম্যাজিকের মতো। কখনো চালের দাম বাড়ে, কখনো কাঁচামরিচ, কখনো বা পিঁয়াজ কিংবা চিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘সিন্ডিকেটের’ কাছে বাজার জিম্মি হয়ে গেছে। মাঝখানে কিছু দিন চিনি, সয়াবিন তেল বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল। বাণিজ্যমন্ত্রী অসহায়। সচিব যেন দূর গ্রহের বাসিন্দা। সম্প্রতি পিঁয়াজ নিয়ে চলল তেলেসমাতি কারবার। এক মাস ধরে পিঁয়াজ আমদানি করা নিয়ে চলল চিঠি চালাচালি। আমলাতান্ত্রিক কসরত। সরকারকে বিব্রত করার সেই একই কৌশল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেন খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী। মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘১৫ দিন পর আমদানির সিদ্ধান্ত এলো। এখন পিঁয়াজের দাম পড়তে শুরু করল। বাণিজ্যমন্ত্রী যদি পরদিন পিঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে পিঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ৯০ টাকা হতো না।’ বর্তমান সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তখন ছিল বিশ্বমন্দা। সারা বিশ্বে খাদ্যের দাম হু হু করে বাড়ছিল। চাল সংকটে দেশে দেশে চলছিল হাহাকার। এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরেছিলেন বিস্ময়করভাবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী ছিলেন কর্নেল (অব.) ফারুক খান। তিনি যখন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিলেন না, তখন দ্রুত মন্ত্রী বদল করেন শেখ হাসিনা। জাতীয় পার্টির জি এম কাদেরকে দেওয়া হয় দায়িত্ব। অসাধারণ দক্ষতায় তিনি পরিস্থিতি সামাল দেন। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনও এ দেশের মানুষ মেনে নিয়েছিল, এর একটা বড় কারণ ছিল দ্রব্যমূল্যের সহনীয় পরিস্থিতি। অর্থনীতিতে সুবাতাস। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা তোফায়েল আহমেদ। এ সময় জিনিসপত্রের দাম তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখেন নিপুণ দক্ষতায়। ২০১৫ সালে ভোজ্য তেলের বিশ্ববাজারে অস্থিরতা দেখা দিল। ব্যবসায়ীদের ডেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন তোফায়েল আহমেদ। এটাই মন্ত্রীদের কাজ। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান টিপু মুনশি। তাঁর আমলে বাজারের কী হাল সেটা নতুন করে আর লিখতে চাই না। বাংলাদেশের বাজারের ওপর এখন সরকার কিংবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট। মন্ত্রীরা যদি মন্ত্রণালয়ের ড্রাইভিং সিটে বসতে না পারেন তাহলে আমলারা দানবে পরিণত হন। যা খুশি তাই করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এখন সেটাই হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হচ্ছে সরকারের। ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে আওয়ামী লীগের। বিদ্যুৎ নিয়ে আওয়ামী লীগের অহংকার যেমন চুরমার করে দিয়েছে লুটেরা এবং ষড়যন্ত্রকারীরা, তেমনি দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারের গৌরব নষ্ট করেছে অযোগ্য আমলাতন্ত্র ও লুটেরা সিন্ডিকেট।

গত মঙ্গলবার একনেকের বৈঠকের পর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান স্বীকার করেছেন- ‘মুদ্রাস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।’ তিনি বলেছেন, ‘এটা আমার জন্য লজ্জার বিষয়।’ এটা মন্ত্রীর জন্য লজ্জার কি না জানি না, আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অশনিসংকেত। অর্থনৈতিক সংকট এখন দেশের জরাজীর্ণ, দরিদ্র চেহারা উন্মোচন করেছে। সবাই আশা করেছিল, এবারের বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস, অর্থনৈতিক সংকট পুনরুদ্ধারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু এই বাজেট অর্থনীতির নিম্নগামী গতিপথ কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় আছে। উপরন্তু আয়কর, বিদেশ ভ্রমণের তথ্য প্রকাশ নিয়ে বেশ কিছু অস্পষ্টতা গুজবের ডালপালা মেলার সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী থেকেও নেই। বাংলাদেশের একটি বড় সৌভাগ্যের জায়গা হলো অধিকাংশ সময়ই আমরা ভালো অর্থমন্ত্রী পেয়েছি। তাজউদ্দীন আহমদ, সাইফুর রহমান, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রত্যেকেই দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। কেউ কম, কেউ বেশি। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীদের মনে করা হয় প্রধানমন্ত্রীর পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আগের অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর বিশাল ফারাক। আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর জীবনের শেষ বাজেট দিয়েছিলেন এক মাস প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা কাজ করে। নিদ্রাহীন রাত কাটিয়ে। অংশীজনের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক করে। আর বর্তমান অর্থমন্ত্রীকে আমরা পেলাম বাজেটের দিন। ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’। দেশের অর্থনৈতিক সংকটে, আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকে, কিংবা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপনে কোথাও নেই আমাদের অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী অসুস্থ। অসুস্থ হলে তাঁকে কেন মন্ত্রিত্বের ভার বহন করতে হবে? প্রধানমন্ত্রীর একজন ‘আমৃত্যু’ অর্থনৈতিক উপদেষ্টাও আছেন ১৪ বছর। আগে তাঁকে দেখা যেত সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে। সুশীলদের আলোচনায়। এখন তিনিও অদৃশ্য। ভয়ংকর অর্থনৈতিক সংকটে অর্থনীতির লাটাই এখন আমলাদের হাতে। এই আমলারা কতটা দেশের স্বার্থ দেখছেন? অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলায় রাজনৈতিক ভাবনা নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাথায় নির্বাচন নেই। আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংকট সমাধানের দায়সারা চেষ্টা সমস্যাকে আরও গভীর করছে। ভাবা যায়, এই সরকারেই ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে বিশ্বের সেরা পাঁচ দেশের একটি ছিল। সেই উদীয়মান অর্থনীতি এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়? অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই সরকারের বিরুদ্ধ পক্ষের লোকজন বসে আছেন এমন কথা কান পাতলেই শোনা যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও বিএনপির ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন এমন আমলা এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের সচিব। সরকারকে বিব্রত করতে এরা প্রতিনিয়ত নানা ফন্দিফিকির করেন। বাংলাদেশে এখন ডলার সংকট। সর্বশেষ একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী বিদেশি ঋণের প্রকল্পগুলো দ্রুত ছাড় দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, এতে ডলার আসবে। প্রধানমন্ত্রী যখন এ কথা বলেছেন, তখন পরিকল্পনা কমিশন বিদেশি ঋণের প্রকল্পগুলোকে কীভাবে আটকে দেওয়া যায় তার আয়োজনে ব্যস্ত। আমি শুধু একটি উদাহরণ দিতে চাই। বিশ্বব্যাংকের ঋণে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে সবচেয়ে বড় একটি প্রকল্প চলছে। এ প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী নিয়ে একটি মূল্যায়ন সভার বিবরণ পড়ে আঁতকে উঠলাম। পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্যের (সচিব) সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়নে যেসব সুপারিশ এবং নির্দেশনা গ্রহণ করা হয়েছে, তা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের চুক্তির পরিপন্থী। এসব সুপারিশ যদি শেষ পর্যন্ত একনেক গ্রহণ করে, তাহলে শর্তভঙ্গের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করবে। কারণ, বিশ্বব্যাংক যে খাতের জন্য ঋণ দেয়, সেই ঋণের টাকা অন্য খাতে খরচ করার কোনো সুযোগ নেই। এটি সরাসরি চুক্তি লঙ্ঘন। অথচ সচিব (সদস্য) বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের টাকা দিয়ে সরকারি অর্থে পরিচালিত আরেকটি প্রকল্পে অর্থায়নের সুপারিশ করেছেন। ওই সচিব বিশ্বব্যাংকের নিয়মকানুন জানেন না, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বিশ্বব্যাংক যেন চুক্তি বাতিল করে, ঋণ দেওয়া বন্ধ হয় সে জন্যই পরিকল্পিতভাবে এটা করা হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমলাতন্ত্রের নব্য আওয়ামী লীগার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ওই ব্যক্তি সচিব হয়েছেন। তিনি সচিব হওয়ার পর আমলাদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগ ঘরানার তারা হইচই করেছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। এখন তিনি তার আসল রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এরকম ভূতের উৎপাত এখন বেড়েছে। সরকার তার মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে। এ সময় সরকারের প্রধান কাজ জনসন্তুষ্টি নিশ্চিত করা। জনগণের আস্থা অর্জন করা। কিন্তু কিছু অযোগ্য, অদক্ষ মন্ত্রীর হিতাহিত জ্ঞানশূন্য আচরণ এবং মাত্রাহীন লোভ পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। কেউ কেউ অর্বাচীনের মতো আচরণ করছেন। সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে সব একাডেমিক সার্টিফিকেট পুড়িয়ে আলোচনায় আসেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী মুক্তা সুলতানা। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এক প্রতিমন্ত্রী তাকে ডেকে চাকরি দিলেন। এর ভয়াবহতা আঁচ করার মতো বোধশক্তিও কি ওই প্রতিমন্ত্রীর লোপ পেয়েছে? মন্ত্রীপত্নীও দেখলাম স্বামীর শিশুসুলভ বালখিল্যতার সমালোচনা করেছেন। এখন প্রতিদিন সার্টিফিকেট পোড়ানোর মতো জঘন্য কাজ চলছে ঘটা করে। প্রতিমন্ত্রী কি সবাইকে চাকরি দেবেন? মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নাম কামানোর জন্য এ ধরনের চটুল, সস্তা উপায় কেন নিতে হবে? প্রশাসনেও ঘাপটি মেরে থাকা সুবিধাবাদীরা এখন মুখোশ খুলে ফেলছে। শেখ হাসিনা একা তিল তিল করে গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ নামের ‘নৌকাকে’ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সুবর্ণ বন্দরের কাছে নিয়ে গেছেন। কিন্তু যারা এটা চান না, তারা এখন সর্বশক্তি দিয়ে এই অর্জন বিনষ্টের মিশনে নেমেছেন। ১৪ বছরে বিএনপি-জামায়াত তাদের আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। কিন্তু সরকারের কিছু ব্যক্তির কারণে জনগণ এখন সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। নৌকা যখন বন্দরে পৌঁছবে তখনই কেউ কেউ নৌকা ফুটো করে দিচ্ছে। নৌকা ডোবানোর মিশনে নেমেছেন কিছু মন্ত্রী আর আমলা।

এদের চিহ্নিত করতে হবে। এদের দায়িত্ব থেকে সরাতেই হবে। আওয়ামী লীগে বহু যোগ্য আদর্শবাদী ও নীতিবান নেতা আছেন। যারা এই কঠিন সময়ে দায়িত্ব পেলে যোগ্যতার পরিচয় দেবেন। সংকট উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীকে সহায়তা করবেন। তাঁদের সামনে আনতে হবে। আমলাতন্ত্র-নির্ভরতা কমিয়ে সরকারের রাজনৈতিক চেহারা সামনে আনতে হবে। এতে জনগণ আশ্বস্ত হবে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। জনগণ ছাড়া একটি রাজনৈতিক দলের অন্য কোনো সম্পদ নেই, থাকে না।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭