ইনসাইড থট

‘আমরা বাঙালিরা রক্তের উপর দাঁড়িয়ে নির্বাচন করব’


প্রকাশ: 16/06/2023


Thumbnail

আমেরিকার ছয় জন কংগ্রেস সদস্য আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর বাংলাদেশের আগত নির্বাচনকে লক্ষ্য করে বেশ কিছু বক্তব্য দিয়েছে। এটি আমি বেশ ভালো করে পড়েছি। এর কয়েক দিন আগে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট বরাবর সেখানকার ছয় জন এম ই পি তাদেরও একটি চিঠি বাংলাদেশের নির্বাচন সম্বন্ধে লিখেছিল। আমি তার উত্তরে আমার নিজস্ব কিছু বক্তব্য দিয়েছিলাম। আমি এই আমেরিকার কংগ্রেসম্যানদের যে চিঠি, তার পরিপ্রেক্ষিতে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার একটি বক্তব্য দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব মনে করেই এবং আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও আমাকে বাধ্য হয়ে কিছু বলতে হচ্ছে। 

সর্বপ্রথমেই বলতে চাই যে, আমেরিকান ইতিহাসে আমার যতদূর মনে পড়ে- শতকরা ৫৫ শতাংশের উপরে ওদের নির্বাচনে ভোট পড়েছে- এরকম উদাহরণ প্রায় নেই। এর আগে আরও কম ছিল, এরপর তারা আস্তে আস্তে এটা উন্নতি করেছে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই দেখা যেতো শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ভোট পড়তো। আর আমাদের নির্বাচনে- সম্প্রতি যেটা হলো, সিটি করপোরেশন নির্বাচন, সবারই ধারণা ছিল আওয়ামী লীগই হারবে বরিশালে। কিন্তু সেখানেও প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছে। সেটি একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সুতরাং আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাচন সঠিক হয়েছে- তার মাপকাঠি কি? 

মাপকাঠি হচ্ছে- যার ভোট সে দিতে পেড়েছে কি না, যাকে দিতে চায়- তাকে দিতে পেড়েছে কি না। এখানে ইউরোপীয়ান কয়েকটি দেশে এবং যতদূর আমার মনে পড়ে- আস্ট্রেলিয়া বা নেদার‌ল্যান্ডে আছে- সেখানে কেউ ভোট না দিলে, যদি ভোট দেওয়ার সঠিক কোনো কারণ দেখাতে না পারে, তাহলে তাদের জরিমানা হয়। কিন্তু আমাদের এখানে যার যার ইচ্ছা, ইচ্ছা হলো-ভোট দিলাম, ইচ্ছা হলো না- ভোট দিলাম না। অনেক সময় অনেকে প্রতিবাদে থাকার কারণেও ভোট দেয় না, যেমন আমার কোনো প্রার্থী পছন্দ হচ্ছে না, আমি ভোট দিব না। আগে একবার আমাদের দেশেরই যে সকল তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা- যারা আমেরিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করছে- তারা বলেছিল যে, ভোটিংয়ের যে প্রার্থী থাকে, সেখানে একটা কলাম থাকার দরকার যে, আমার কোনো প্রার্থী পছন্দ হয়নি। অথচ তারাই আজকে তাদের বোল পাল্টে ফেলেছে।

আমি ইতিহাসের একজন ছাত্র, যদিও পেশায় চক্ষু চিকিৎসক। কিন্তু আমি আমেরিকার ইতিহাসটা জানি। ওদের বিভিন্ন স্টেটের আইনেও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। আমেরিকার কংগ্রেসম্যানদের যদি নির্বাচিত হতে হয়, তাহলে দেখতে হয় স্থানীয় স্বার্থটা কি আছে। জাতীয় স্বার্থটা কিন্তু তাদের প্রাধান্যতায় পড়ে না। যেমন ভার্জিনিয়া, সেখানে একজন কংগ্রেস প্রার্থী যদি ধুমপানের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাহলে সে কোনো সময় ভার্জিনিয়া স্টেটে কংগ্রেসম্যান হতে পারবে না, এমনকি সিনেটরও হতে পারবে কি না, তা-ও সন্দেহজনক। সুতরাং ভার্জিনিয়াতে তাদের স্থানীয় স্বার্থটা হলো তামাক এবং এই স্বার্থটা তাদের দেখতে হয়। স্থানীয় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে তাদের রীতিমতো তেল দিয়ে চলতে হয়, তা না হলে ফান্ড পাবে না। যখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়, একমাত্র তখনই বিশ্ববাসী দেখতে পারে, ফান্ডের অভাবেই একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ঝড়ে পড়ছে। সেটা নির্ভর করে টাকা-পয়সার উপরে। সুতরাং মূল কথা কি দাঁড়ায়? মূল কথা হলো যে, আমেরিকায় রাজনীতিতে টিকতে হলে একটা মাত্র আপনার ধর্ম দরকার- আর সেটা হচ্ছে টাকা ধর্ম। টাকা থাকলেই গণতন্ত্র আছে, টাকা থাকলেই সেখানে মানবাধিকার অছে, টাকা থাকলেই সেখানে সবকিছু আছে। 

ওই কংগ্রেসম্যানরাও জানে, আমেরিকাই একমাত্র রাষ্ট্র সেখানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিল, সুপ্রীম কোর্টের রায় দ্বারা। এই সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের ভিতরেও রায়ে দুটি ভাগ হয়েছিল। রিপাবলিকান পার্টির বিচারপতির সংখ্যা সুপ্রীম কোর্টে বেশি ছিল, তারাই ওই রাষ্ট্রপতিকে জিতিয়েছে। ওখানে যদি ডেমোক্রেটিক বিচারপতিদের সংখ্যা বেশি থাকতো, তাহলে ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতো। সুতরাং সেখানে সমস্ত জনগণ- এদের কি ক্ষমতা, ক্ষমতা নেই। কিন্তু বাংলার মাটিতে এখনও গণতন্ত্র আছে, বিশেষ করে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা রাজনীতিতে আসার পর থেকেই এ দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বয়ে চলেছে। যদিও তিনি বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করার ২১ বছর পরে ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু তার আগে থেকেই তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে, ভোটের এবং ভাতের অধিকারের পক্ষে। সুতরাং বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কারো কোনো চিন্তা করার আমি কোনো কারণ দেখি না।

এখানে নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে। সংবিধানে নির্দিষ্ট যে সময় বেধে দেওয়া হয়েছে, সে সময় আনুযায়ীই হবে। এই বর্তমান নির্বাচন কমিশনার যারা আছেন- তাদের অধীনেই হবে এবং সঠিক নির্বাচন হবে। যদি সঠিকভাবে নির্বাচন না হয়, তাহলে নির্বাচনের পরে-তো বোঝা যাবে যে, সঠিকভাবে নির্বাচন হয় নাই। তখন বিশ্ববাসী কেন- বাংলাদেশের লোকও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন, যে নিজেকে যতই ক্ষমতাশালী ভাবুক না কেন! আমরা ১৯৯৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসেও দেখেছি, জনগণকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করা হলে টিকে থাকা যায় না- এটা বাংলাদেশে উদাহরণ আছে। সতুরাং এদের যে চিঠির ভাষা আমি পড়লাম- দু’টি চিঠি। মনে হলো যেন একই জায়গা থেকে ড্রাফটিং করা, মানে একই জায়গা থেকে লেখা হয়েছে।

আমার মনে হয়, তারা একটা লিস্ট দিক না কেন- মানবাধিকারে কি আছে? নির্বাচনে কি হয়? তাদের দেশে কি হয়? তারা কোথায় কোথায় সম্পর্ক রাখে? তাহলেই তো বেড়িয়ে যাবে আমেরিকার এতো রাজনৈতিক দরদ কিসের? আসলে অর্থনৈতিক। তারা বাংলাদেশের এইখানে, এই বঙ্গপোসাগরে- যেহেতু আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে আছি- এখানে আমাদের সেন্টমার্টিনে যদি আমেরিকা একটা নৌঘাঁটি করতে পারে, তাহলেই আমেরিকা- রাশিয়া, চীন- এদের সাথে তাদের যুদ্ধের সুবিধা হবে, ব্যবসার সুবিধা হবে এবং তারা এই সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে- এটা আমেরিকার একটা ক্ষমতার কৌশল। কিন্তু তাতে শুধু আমরা নই, এই সমস্ত অঞ্চল- চীন, রাশিয়া, ভারত, মিয়ানমার- সবাই আমরা আক্রান্ত হবো।

বাংলাদেশের এ বিষয়ে খুবই স্পষ্ট নীতি। দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বলেছেন, সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথেই বৈরিতা নয়। সুতরাং এখানে কারো কোনো বেজ বা নৌঘাঁটি হতে দেওয়া যাবে না। সেটা আমেরিকারও না, চীনেরও না, রাশিয়ারও না। একমাত্র বেজ বা নৌঘাঁটি যদি হয়, সেটা বাঙালিদের হবে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নই এই ধরনের চিঠি লিখুক বা কংগ্রেসই এই ধরনের চিঠি লিখুক- বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর আধা পয়সা মূল্য নাই এবং আমাদের গণতন্ত্রের প্রতি একটা আঁচড় ফেলার ক্ষমতাও এদের নাই। সুতরাং তারা যতই চিঠি লিখুক, অন্যায়ভাবে যত কথাই বলুক না কেন- তাতে কিছুই হবে না। 

কারণ এবার আমরা বাঙালিরা রক্তের উপর দাঁড়িয়ে নির্বাচন করব। কাদের রক্ত? আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, দেশ স্বাধীন করার জন্য আমার সহকর্মীরা যারা রক্ত দিয়েছেন, আমার সেই সহকর্মীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে, আমাদের সাহায্য করেছে ভারত, ভারতের রক্ত এই মাটিতে পড়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর- যার নেতৃত্বে আমরা দেশ স্বাধীন করলাম- তার এবং তার পরিবারে রক্ত এই বাংলার মাটিতে পড়েছে- সেই রক্তের উপরে দাঁড়িয়ে এই বাংলার মাটিতে আমরা নির্বাচন করব। সেখানে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নই হোক আর আমেরিকাই হোক- কারো কোনো ক্ষমতা নেই যে, আমাদের গণতন্ত্রের উপরে কোনোরূপ আঘাত করে তারা সফল হবে। সতরাং নিজের চড়কায় তেল দিন, আমাদের নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭