ইনসাইড পলিটিক্স

বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে বিরোধী দলের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা


প্রকাশ: 20/06/2023


Thumbnail

একটি বিষয় বেশ কিছুদিন ধরে মনকে খুব পীড়া দিচ্ছে। বিষয়টি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বিষয়ক অব্যাহত নেতিবাচক প্রচারণা। বিরোধী দল সর্বপ্রথম বিষয়টিকে উপস্থাপন করে এবং অতঃপর দেশের প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী চক্র তা লুফে নেয়। বারবার বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও সমমনা বুদ্ধিজীবীগণ বুঝে হোক, না বুঝে হোক ক্রমাগত এ ব্যাপারে লাগামহীন বক্তব্য দিয়েছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। তারা ক্ষুরধার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছেন, কেন জাতিসংঘে বাংলাদেশ থেকে শাস্তিরক্ষী বাহিনী নিযুক্ত করা উচিত নয়। তীক্ষ্ণ খঞ্জরসম এসব যুক্তিতে জাতিসংঘ বিচলিত হচ্ছে কিনা জানা নেই; তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা রক্তাক্ত হচ্ছি প্রতিনিয়ত । 

এখানেই ক্ষান্ত হননি তারা। তাদের এ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করেছেন বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার কংগ্রেসের ০৬ জন কংগ্রেসম্যানকে। তারা দাবি তুললেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। পৃথিবীর এতো এতো ইস্যু থাকতে হঠাৎ তারা কেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অতি উৎসাহী হয়ে উঠলেন এবং সবকিছু বাদ দিয়ে শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়ার জন্য প্রস্তাব করলেন তা বোঝা না গেলেও এতটুকু বোঝা গেলো ঐ চিঠির বক্তব্য তাদের নয় বরং তারা অন্ধভাবে অন্য কারো লিখিত বক্তব্য স্বাক্ষর করেছেন। আমি নিশ্চিত, তাদের এ বক্তব্যের পেছনে যুক্তি দেখাতে বললে তারা আমতা আমতা করে পিছু হটবেন। বরং আমরা এ বক্তব্যের কারণ জানি অথবা ১৬ কোটি মানুষ এমনকি সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যও এ বক্তব্যের কারসাজি জানে। এক এগারোর কুশীলবরা এ বক্তব্য ব্যবহার করে দেশে জরুরি অবস্থা জারির যথার্থতা প্রমাণে সফল হয়েছিলেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মতো একটি নৈমিত্তিক বিষয় কেন এতো গুরুত্ব পায় বাংলাদেশে? কেনইবা রাজনৈতিক নেতারা এটিকে বারবার রাজনেতিক খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে? বিষয়টি নিয়ে ভাবা যাক । 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সেনাবাহিনী/সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণের দুটি ডাইমেনশন আছে। একটি অর্থনৈতিক আরেকটি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এ কারণে যে শান্তিরক্ষী মিশনে কাজ করার সাথে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অংশগ্রহণকারী সদস্যদের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের সুযোগ করে দেয়। আর রাজনৈতিক কারণটি অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত। কারণ কোনো কারণে সেনা সদস্যরা মিশনে যেতে ব্যর্থ হলে তার একটি নেতিবাচক প্রভাব সুরকারের উপর পড়বে; যা বাংলাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য বিনষ্টের কারণ হতে পারে। আর ঠিক এ কারণটিই বিরোধী দল সবসময় কাজে লাগাতে সচেষ্ট থাকে। কিন্তু তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন তাদের এরকম কার্যক্রমের কি ভয়ংকর প্রভাব পড়তে পারে। শান্তি মিশনের দরজা একবার বন্ধ হয়ে গেলে তা আর নাও খুলতে পারে। বিষয়টি এমন নয় যে, সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

বিষয়টি ভালভাবে অনুধাবনের জন্য সাম্প্রতিক একটি ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে। দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষী মিশন কাজ করছে ২০১১ সাল থেকে। ২০১৬ সালে সরকার ও বিরোধী দল সংঘর্ষে লিপ্ত হলে একদল সরকারী সেনা ইউএন এর এইড ওয়ার্কারদের জন্য নির্ধারিত একটি হোটেল "TERRAIN" আক্রমণ করে। ইউএন এর নিকটবর্তী ক্যাম্প বিষয়টি জানার পরও তড়িৎ উপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণে ব্যর্থ হলে বেশ কয়েকজন মহিলা এইড ওয়ার্কার গণধর্ষণের স্বীকার হয় ও একজন স্থানীয় কর্মচারী নিহত হয়। বিষয়টি নিয়ে হৈছে শুরু হলে ইউএন দক্ষিণ সুদানের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ফোর্স কমান্ডার কেনিয়ার লেঃ জেনারেল জনসন মগোয়া কিমানিকে অব্যাহতি প্রদান করে। কিন্তু কেনিয়া জাতিসংঘের পদক্ষেপে সংক্ষুব্ধ হয়ে হুমকি প্রদান করে যে, তাদের ফোর্স কমান্ডারকে অব্যাহতি দেয়া হলে কেনিয়া দক্ষিণ সুদান থেকে সকল সৈন্য প্রত্যাহার করবে। জাতিসংঘ তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে কেনিয়া সুদানে মোতায়েনকৃত পদাতিক কন্টিনজেন্ট প্রত্যাহার করে । ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশী পদাতিক কন্টিনজেন্ট দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষী মিশনে কাজ করার সুযোগ পায়; যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। অন্যদিকে, কেনিয়া পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করেও অদ্যাবধি দক্ষিণ সুদানে আর কোন কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করতে পারেনি । কাজেই জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সৈন্য প্রেরণের জন্য দরজা বন্ধ হওয়া যত সহজ, খোলা তত সহজ নয়। কাজেই তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির আশায় শান্তিরক্ষী বাহিনী সংশ্লিষ্ট যেকোন হঠকারী সিন্ধান্ত দেশের ভাবমূর্তি ও সার্বিক বিষয়ের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে ।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের গৌরবজনক পদযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৮ সালে ইরাকে ১৫ জন মিলিটারী অংশগ্রহণের মাধ্যমে। অতঃপর অদ্যাবধি প্রায় ৫৪টি মিশনে প্রায় ১,৮০,৬৬১ জন সদস্য শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিয়োজিত ছিল। বর্তমানে ০৯টি ভিন্ন মিশনে প্রায় ৬৮০২ জন সদস্য শাস্তি রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের প্রায় ১৬০ জন বিভিন্ন পদবীর শান্তিরক্ষী জীবন বিসর্জন দিয়েছে। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় আত্মবিসর্জনের জন্য ইউএন ০৫ জন সেনা সদস্যকে ইউএন'র সর্বোচ্চ পদক 'ড্যাগ হ্যামারস শোন্ড' পদক অর্জন করে; যা জাতি হিসেবে আমাদের গর্বিত করেছে। 

কাজেই আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে আমাদের সুনাম একদিনে অর্জিত হয়নি । বিপদসংকুল পরিবেশে নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম, অগণিত ব্যক্তিগত আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার মাধ্যমে এর শক্ত ভিত রচিত হয়েছে। সিয়েরালিউন, লাইবেরিয়া, কঙ্গো, সুদান, মালী, কম্বোডিয়া, ইরিত্রিয়া, দক্ষিণ সুদান, আইভরিকোস্ট এর মতো দেশসমূহে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনীর সুকার্যক্রম জাতিসংঘ পরিমন্ডলে বাংলাদেশকে এক অনন্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। যার কারণে এখন বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সেনা প্রেরণকারী দেশ হিসেবে মর্যাদারস্থান ধরে রেখেছে এবং বিভিন্ন মিশনে সৈন্য সংখ্যা হ্রাস করার কার্যক্রম চললেও প্রতিনিয়তই বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাড়ছে। 

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০২৫ সালের মধ্যে নারী স্টাফ ও সৈনিকদের সংখ্যা মোট জনবলের ২৫% বাধ্যবাধকতার অনেকটাই পূরণে বাংলাদেশ সক্ষম হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি কন্টিনজেন্টের সাথে ফিমেল এনগেজমেন্ট টিম সর্বক্ষেত্রে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাছাড়া, অচিরেই বাংলাদেশের এভিয়েশন কন্টিনজেন্ট, এয়ার সাপোর্ট কন্টিনজেন্ট ও কমান্ডো কন্টিনজেন্ট মোতায়েনের সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের বহুমুখীতা  বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিচয় বহন করছে; যা জাতিসংঘ কর্তৃক বহুলাংশে স্বীকৃতি লাভ করেছে । 

এমতাবস্থায়, আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল অব পিস অপারেশন্স জ্য পিয়েরে ল্যায়ার শান্তিরক্ষী মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তুতিমূলক আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য আগামী ২৬ জুন ২০২৩ খ্রিঃ বাংলাদেশে আসবেন। তার এ সফরকে উদ্দেশ্য করে শুরু হয়েছে ন্যাক্কারজনক এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বিরোধী দলের সর্বাত্মক প্রচেষ্ঠায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন, ছয়জন কংগ্রেসম্যানের চিঠি বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে। শান্তিরক্ষী মিশনে সৈন্য প্রেরণে নিজ দেশের নেতিবাচক এসকল উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর ও আত্মধ্বংসী। 

জাতিসংঘে প্রেরিত সৈন্যবাহিনী কোনভাবেই দেশের রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। তবুও বিরোধী দল বারবার এ বিষয়টি উপজীব্য করে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তাদের এ কার্যক্রমে উদ্দেশ্য পরিষ্কার। যেকোনভাবে সেনাবাহিনীকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা। কিন্তু সেনাবাহিনী তো রাজনীতির অংশ নয়। তবে, কেন সেনাবাহিনীকেই বারবার রাজনীতির খুঁটিতে পরিণত করে তাদের গর্ব ও সম্মানকে ধূলিসাৎ করতে তৎপর হয়। 

বিদেশে দেশকে পরিচিত করতে বেশিরভাগ সময়ে যে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, গর্ববোধ করি তা হলো শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী । শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কার্যক্রম মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার সাথে সাথে আমাদের জন্য বয়ে এনেছে এক বিরল সম্মান। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সৈন্যদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে আমাদের মাথা উঁচু করেছে। আমাদের সেই অবস্থান রাজনীতির ঘৃণ্য কূটচালে নষ্ট হোক তা আমরা কেউ চাই না। যদি কেউ চায়, তাহলে সে আর যাই হোক, এদেশ তার না।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭