ইনসাইড বাংলাদেশ

লক্ষ্মীপুরে দেশীয় কাঠশিল্পীরা খুচ্ছে বিকল্প পেশা


প্রকাশ: 21/06/2023


Thumbnail

আধুনিকতার ছোঁয়ায় লক্ষ্মীপুরে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় ফার্নিচার ব্যবসা। ফলে নানা শঙ্কায় রয়েছেন এ পেশায় জড়িত কাঠশিল্পীরা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিদেশী ফার্নিচারের চাকচিক্য আর নানান রঙ্গ, ডিজাইনের সাথে পাল্লা দিয়ে অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছেন দেশীয় ফার্নিচারের কারিগররা। এদিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় টিকতে না পেরে পেশা বদলাচ্ছেন অনেক কাঠশিল্পী।

জেলা শহর লক্ষ্মীপুরে গত ২ বছর আগেও শহরের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র উত্তর তেহমুহনী থেকে ইলিশাকেন্দ্র ট্রাফিক মোড় পর্যন্ত এ আধা কিলোমিটার এলাকায় ছিল মাত্র ৭টি দেশীয় কাঠের ফার্নিচার দোকান। এখন সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০টি। সংখ্যার হিসেবে ফার্নিচারের দোকান বাড়লেও বাস্তবে দেশীয় কাঠের ফার্নিচারের দোকান উল্টো কমেছে ৪টি। এখন সবগুলোই দেশের বড় বড় এবং বহুজাতিক কোম্পানির ফার্নিচার শো রুম। দেশীয় ফার্নিচারের যে ৩টি দোকান রয়েছে সেগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পণ্যরাখছেন সাথে। ফলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে দেশীয় ফার্নিচারের পাশাপাশি দোকানিরা রাখছেন বহুজাতিক কোম্পানির পণ্যও।

স্থানীয়ভাবে জানা যায়, কারুকাজ আর সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে মেশিনে তৈরি এবং প্রসেস কাঠের ফার্নিচারের কদর বাড়ছে। সে কদর বুঝে বড় ব্যবসা শুরু করেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। বড় কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে সার্টিফাইড উড আমদানি করছে। এসব আমদানি করা কাঠের মধ্যে ওক, বিচ এবং পাইন অন্যতম। বিদেশী প্রসেস কাঠের আঁশে নান্দনিক ডিজাইন করা যায়। প্রসেস উডের মধ্যে রয়েছে পার্টিক্যাল বোর্ড, ভিনিয়ার্ড বোর্ড, এমঅডিএফ বোর্ড, প্লাই বোর্ড। এই প্রসেস উডের ফার্নিচার বেশ চলছে। এ কাঠে আসবাব তৈরি করছে দেশের বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। সেগুলোর মধ্যে অটোবি, নাভানা, হাতিল, প্যাসিফিক, পারটেক্স, নাদিয়া, ব্রাদার্স ও আকতারের দখলে পুরো জেলার বাজার।

লক্ষ্মীপুর শহরের মের্সাস চট্টগ্রাম ফার্ণিচারের মালিক মহিন উদ্দিন। তিনি জানান, যারা ঐতিহ্য আর গুণগত মান চায় শুধু তারাই এখন দেশীয় কাঠের ফার্নিচারের ক্রেতা। বড় বড় ফার্নিচার কোম্পানীর চাপে দেশীয় কাঠ শিল্পী ও মিস্ত্রিরা এখন পেশা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে। শহর থেকে একেবারে গ্রাম পর্যন্ত তাদের শো রুম বা ডিলার রয়েছে। সহজ কিস্তিতে গ্রাহকের কাছে এসব পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ি দেশীয় ফার্নিচারের পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানির পণ্যও রাখতে হয় দোকানে।

কয়েকজন ফার্নিচার ক্রেতা-বিক্রেতা, কাঠ শিল্পী ও মেস্ত্রিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলার পাঁচ উপজেলার সবগুলো ছোট বড় হাটবাজারে দেশীয় ফার্নিচার শিল্পের নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ফার্নিচারের চাকচিক্য আর নানান রঙ্গ, ডিজাইনের সাথে পাল্লা দিয়ে অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছেন দেশীয় ফার্নিচারের কারিগর ও ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেলা শহরে রয়েছে অটোবি, নাভানা, হাতিল, পারটেক্স, প্যাসিফিক এবং আক্তার ফার্ণিচারসহ নানা বড় বড় কোম্পানির বিক্রয় কেন্দ্র। বড় ব্র্যান্ডের কোম্পানি ছাড়াও নন ব্র্যান্ডের আরো বহু ফার্নিচার দোকান রয়েছে যেগুলো দেশীয় কাঠের ফার্নিচারের পুরো বাজার প্রায় ঘিলে ফেলেছে। জেলা ও উপজেলা শহর ছাড়াও বড় হাট বাজারেও ব্র্যান্ডের কোম্পানির শো রুম রয়েছে। আবার স্থানীয় অনেকে মেশিনে তৈরি নন ব্র্যান্ডের ফার্নিচারের দোকানও খুলেছেন। এতে প্রতারিতও হচ্ছেন গ্রাহকরা।

লক্ষ্মীপুর দক্ষিণ তেহমুনীর মদিনা স’মিলের মালিক আবদুল মালেক জানান, দেশীয় ফার্নিচার শিল্পের সাথে স’মিল শ্রমিক, কাঠ মেস্ত্রি, নকশা শিল্পী, খোদাই শিল্পী এবং রং, বার্নিশ মেস্ত্রীসহ অন্তত ৫-৬ রকমের মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। তিনি আরো জানান, লক্ষ্মীপুর জেলায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ কাঠ শিল্প ও মেস্ত্রি শ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের প্রত্যেকেরই দৈনিক আয় কমপক্ষে ৩শ-৫শ টাকা। বড় বড় কোম্পানির ফার্নিচারের দাপটে এ বিশাল শ্রমজীবি মানুষের পেশা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ এলাকার শিক্ষকপতœী ফাতেমা আক্তার জানান, তিনি বাড়ি থেকে পরিকল্পনা করে এসেছেন সেগুন কাঠের একটি খাট কিনবেন। লক্ষ্মীপুর শহরে কয়েকটি দোকানে কাঠের খাটও দেখেছেন। কিন্ত একটি বড় কোম্পানির শো রুমে ঢুকামাত্র ডিজাইন ও ফিনিশিং দেখে খাট পছন্দ হয়। তিনি আর সেগুনের খাট কিনেননি। দোকানদার বলেছে সেটা নাকি ওক গাছের খাট। ডিজাইন ও ফিনিশিং এর কারণে তার কাছে দামও কম মনে হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের ছাত্র কামরুল হাসান হৃদয় জানান, আগে কলেজ ম্যাসের ছাত্ররা কাঠের চৌকি ব্যবহার করতো। শহরে চৌকির বাজারও ছিল। এখন ছাত্ররা চৌকির পরিবর্তে খুব কম দামে কেরোসিন কাঠের খাট কিনছে। ছাত্রদের ছোট এ খাটগুলো বড় কোম্পানিগুলো বানিয়ে দিচ্ছে।

লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের রহিম ফার্নিচারের আবদুর রহিম জানান, তার দোকানে আগে ২০জন শ্রমিক দিয়ে শুধুমাত্র দরজার চৌকাঠ তৈরি করতেন। সে ব্যবসায়ও হাত বাড়িয়েছে বড় কোম্পানিগুলো। বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন কাঠের চৌকাট বিক্রি করে। ফলে তাদের বিক্রিও শূন্যের কোটায় নেমে গেছে। তিনি ব্যবসা ছোট করে দোকানে শ্রমিক রেখেছে ৩ জন।

রামগতির আলেকজান্ডার বাজারের ইউছুফ মিস্ত্রী জানান, তিনি তার কারখানায় খাট, শো-কেস, ওয়ারড্রপ, ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার-টেবিল এবং চৌকিসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরী করতেন। গত এক বছর যাবত খাট ছাড়া আর কোন কিছু তৈরির অর্ডার পাচ্ছেন না।

সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ এলাকার একটি দোকানে কাঠের খোদাই শিল্পী আজগর জানান, তার খোদাই ঘরের বয়স ৫ বছর। প্রথম ৩ বছর ভালোই চলছিল। কিন্ত এখন আর তেমন কাজ নেই। কাজ হলেও দাম কম বলে। মানুষ এখন কাঠের ফার্নিচার তৈরি করতে চাচ্ছে না। বড় বড় কোম্পানিগুলো মেশিনের লেজার লাইট দিয়ে নিখুঁত নকশা করে। মেশিনে তৈরি ফার্নিচারের সাথে পাল্লা দিয়ে শিল্পীদের তৈরি ফার্ণিচার বাজারে টিকতে পারছে না।

বার্নিশ মিস্ত্রি রুবেল জানান, যে লোক মেশিনের বার্নিশ করা ফার্নিচার দেখবেন তার কাছে হাতের বার্নিশ ভালো লাগবে না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পেশা আর বেশি দিন টিকে রাখা যাবে না।

লক্ষ্মীপুর জেলা ইউনিয়ন পরিষদ সচিব সমিতির অর্থ সম্পাদক ও তোরাবগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব গিয়াস উদ্দিন জানান, তার ইউনিয়নে বিভিন্ন বাজারে ফার্নিচার ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে এমন ব্যবসার সংখ্যা প্রায় একশ। তিনি ইউনিয়ন সচিবদের সাংগঠনিক তথ্য দিয়ে জানান, লক্ষ্মীপুর জেলায় ফার্নিচার দোকান আছে প্রায় ১৫শ। তাদের হিসেবে পুরো জেলায় কাঠ শিল্পী ও মেস্ত্রি পেশার লোক সংখ্যা কমপক্ষে ৩০ হাজার।

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাইন উদ্দিন পাঠান জানান, বহুজাতিক কোম্পানির চাকচিক্য পণ্যেও ভিড়ে স্থানীয় কাঠ শিল্পীদের কদর কমতে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্পের ন্যায় স্থানীয় কাঠ শিল্পও হারিয়ে যাবে। স্থানীয় শিল্প রক্ষায় তিনি সরকারের নিকট বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসার কিছু নীতিমালা তৈরি করে দেয়ার দাবিও জানান।

এদিকে দেশীয় ফার্নিচারের ব্যবহার বাড়াতে ও কাঠমেস্ত্রিদের রক্ষার্থে সরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন এমনটিই প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭