ইনসাইড থট

ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানি ব্যবহারে সচেতন হওয়া জরুরি


প্রকাশ: 22/06/2023


Thumbnail

পৃথিবীর সকল প্রকার প্রাণী, গাছ-পালা, তরুলতা, সবাই পানির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বে ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত। পৃথিবীতে বিদ্যমান পানযোগ্য সুপেয় পানির বড় উৎপত্তিস্থল হলো তুষারময় পর্বত বা পাহাড়ের বরফ, যা গলে পৃথিবীর বিভিন্ন নদীর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। পানীয় পানির দ্বিতীয় উৎস ভূগর্ভস্থ পানি, যা তুলনায় কম।


বর্তমান বিশ্বে তেল, গ্যাস, পেট্রোলিয়াম জাতীয় সম্পদের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিতে বিশ্বব্যপী যেভাবে রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে যায়, বলা যায় একই ঘটনা ঘটবে সুপেয় পানির বেলাতেও। আর সুপেয় পানির পরিমাণই যেখানে দিনকে দিন কমছে, সেখানে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো এই নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সম্পদের জন্য লড়বেন শীঘ্রই, সেটা নিশ্চিত।

ভূ-পৃষ্ঠে ৭১ ভাগ পানি থাকার পরেও কেন এই সহজলভ্য পানি ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারে অমূল্য রতন? কেন বিশ্বে পানি সঙ্কট এতো বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে? এর কারণ হলো, এই নীল গ্রহের মাত্র ৩ ভাগ সুপেয় মিঠা পানি। বাদবাকি লোনা পানি। অর্থাৎ এটি স্পষ্ট যে, আগামীতে সুপেয় পানি নিয়েই বিশ্বে সবচেয়ে বড় সঙ্কট তৈরি হবে।

নিরাপদ সুপেয় পানির অধিকার বঞ্চিত বিপুলসংখ্যক মানুষের অধিকাংশই দরিদ্র। তারা হয় প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা অথবা শহুরে বস্তিবাসী। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুসারে, দেশের উপকূলীয় উপজেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয় প্রকল্পে বাস করেন গৃহিণী। একটি কলস ও একটি বোতল নিয়ে আড়াই কিলোমিটার পথ হেঁটে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কলবাড়ীতে এসে সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন তিনি। দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিয়ে, টাকা দিয়ে পানি কিনে তা বয়ে নিয়ে যান ফিরতি পথ ধরে। এভাবে আসা-যাওয়ায় পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আনা ওই পানি পান করে জীবনধারণ করেন পরিবারের অন্য সদস্যরা।

ওয়ার্ল্ড ভিশন এর ২০২২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীর ১০ টি দেশ তীব্রভাবে বিশুদ্ধ সুপেয় পানি বঞ্চিত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই তালিকার শীর্ষে থাকা ১০টি দেশে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বাস।

পানি সঙ্কটের কারণ হিসেবে মোটা দাগে যে ফ্যাক্টরগুলো দায়ী তা হলো পরিবেশ বিপর্যয়, বিশ্বায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, পানি দূষণ ও অপচয়। 

জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য দুই ধরনের পানি ব্যবহার করে। ভূপৃষ্ঠের পানি (Surface water) এবং  ভূগর্ভস্থ পানি (Underground water)। সেখানে সরকারী বিধান অনুযায়ী সকল আবাসিক-অনাবাসিক, সরকারি-বেসরকারি ভবনে দুই ধরনের পানি সরবরাহের জন্য দুইটি পানির লাইন স্থাপন করা হয়ে থাকে। পানীয় পানির জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয় এবং অন্যান্য ব্যবহারের জন্য অপর লাইনে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অনেক ভবনে ব্যবহৃত Surface water ফিল্টার করে পুনঃব্যবহার করার ব্যবস্থা থাকে। এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে, ফিল্টার করে পানীয় পানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়।


ওয়াসার দ্বায়িত্বশীল প্রকৌশলীর নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ওয়াসাও দুই ধরনের পানি সরবরাহ করে থাকে। পরিশোধিত নদীর পানি এবং ভুগর্ভস্থ পানি। বিভিন্ন এলাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলিত ভূগর্ভস্থ পানি ঐ নির্দিষ্ট এলাকায় সরবরাহ করা হয়, যাহা সকল কাজে ব্যবহার করা হয়। গাড়ী ধোয়া, নির্মাণ কাজ, শিল্প-কারখানা, গৃহস্থালী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহার করে এই মূল্যবান পানির ব্যপক অপচয় করা হয়। কিন্তু এই সীমিত পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে কোনো নীতিমালা বা নিয়ন্ত্রণ নাই। এছাড়া কৃষিকাজে সেচ দেওয়ার জন্যও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি অধিক পরিমাণে উত্তোলনে পানির স্তর নীচে নেমে গেছে। ফলে মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিতে খনিজ দ্রব্যের পরিমাণ অসামঞ্জস্য হয়ে পরেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণও দেখা দিয়েছে। আর্সেনিক মিশ্রিত পানি পান করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য মানুষ রোগাক্রান্ত হয়েছে।

ভূগর্ভস্থ পানি অধিক উত্তোলনের কারণে প্রাকৃতিক পানি সম্পদের উপর প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে। এই চাপ মোকাবিলায় নদী অববাহিকায় উজানের দেশগুলো কৃষি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি সংরক্ষণের জন্য গড়ে তুলছে বিশালাকার বাঁধ বা ড্যাম। উজানের দেশগুলোর বাঁধ নির্মাণের কারণে ভাটি অঞ্চলের দেশগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। যার চরম খেসারত দিচ্ছে নিচু অঞ্চলকে। বিশ্বের ২৭৬টি নদী অববাহিকার পানি সীমান্ত অতিক্রমী এবং বিশ্ব জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের প্রাথমিক পানির উৎস সীমান্ত-অতিক্রমী এসব নদী। এসব নদীর অংশীদারত্ব নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে জটিলতা রয়েছে। কিন্তু বিশ্বে সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হলে, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক ও সহযোগিতাময় পরিবেশ থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পানি বণ্টন নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে তৈরি হচ্ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সম্পর্কের অবনতি, যা দেশগুলোর মধ্যকার ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহমান তিস্তা নদীর পানি বন্টনে বৈষম্যতা।

এমন একটি সময় আসবে, যখন মানুষের কাছে পানযোগ্য কোনো পানি থাকবে না। ফলে মানুষ ফোঁটা ফোঁটা পানির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়বে।

বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে সঙ্কট সমাধানে পুরো বিশ্বে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এখনই। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। নয়তো অচিরেই বিশ্ব এমন এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হবে যেখানে বন্দুক, মিসাইল কিংবা পারমাণবিক বোমা নয়, পানিই হবে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সুতরাং ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ভূগর্ভস্থ পানি শুধুমাত্র পানীয় পানি হিসাবেই ব্যবহার করা উচিত।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭