ইনসাইড পলিটিক্স

আওয়ামী লীগের বিশ্বাসঘাতকগণ; ক্ষমতার লোভে এখনও ছড়ায় বিষবাষ্প!


প্রকাশ: 23/06/2023


Thumbnail

মূলধারার রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রাচীনতম সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের উত্থান-পতন হয়েছে। নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে চলতি ২০২৩ সালে টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় আসীন রয়েছে দেশের অন্যতম প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। এর আগে ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল, কিন্তু অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের ক্ষমতা হারায় আওয়ামী লীগ।

কিন্তু আওয়ামী লীগ এমন একটি দল, যে আওয়ামী লীগকে কখনো বাইরের শক্তি পরাজিত করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়েছে আওয়ামী লীগের কারণেই। অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দল, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিশ্বাসঘাতকতা, দলীয় নেতৃত্বের চেইন অফ কমান্ড না মেনে ক্ষমতার লোভে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের কালোছায়া- বার বার আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগ কখনো লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলনে হারেনি, আওয়ামী লীগ কখনো নির্বাচনে হারেনি। কিন্তু সব সময়ই আওয়ামী লীগ হেরে গেছে, অভ্যন্তরীণ কলহ-কোন্দলের কাছে, আওয়ামী লীগ হেরে গেছে ষড়যন্ত্রের কাছে। 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাকের যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছিল, সমসাময়িক সময়েও সেই খন্দকার মোশতাকদের প্রেতাত্মা আওয়ামী লীগের ক্ষতি সাধনে কখনও কখনও তৎপর হয়ে ওঠে, শুরু করে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র। ৭৫’র ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সে সময়ের মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য খন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হয়েছিলেন, ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিদক দল আওয়ামী লীগের সে সময়ের পতনের করুণ কাহিনী।    

জাতির পিতার রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে রাষ্ট্রপতি হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। তখনো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ। শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সপরিবারে হত্যার পর ওই দিনই রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ৬ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৮৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন মোশতাক।

ইতিহাসবিদদের মতে, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো- মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যারা পদ পেয়েছিলেন, দু’জন বাদে অন্য সবাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য। খন্দকার মোস্তাক ১২ জন মন্ত্রী ও ১১ জন প্রতিমন্ত্রী নিয়ে তার মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। ২৩ সদস্যের এই মন্ত্রিসভার ২১ জনই ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাকশালের ক্যাবিনেট সদস্য। তাদের দপ্তরও খুব একটা পরিবর্তন করা হয়নি। প্রায় সবাইকে আগের দপ্তরেই বহাল রাখা হয়। বাকশালের বাইরে খন্দকার মোশতাক কেবল শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় যুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ।

মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণের সময় প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি পদকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ পান মোহাম্মদ উল্লাহ। মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ পড়ান এইচ টি ইমাম, যিনি সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। তবে বিভিন্ন সময় এইচ টি ইমাম বিভিন্ন টক শো ও বক্তব্যে এই তথ্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এইচ টি ইমামের মতে, তাকে বাসা থেকে তুলে আনা হয়েছিল। তিনি শুধু বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আর শপথবাক্য পাঠ করান বিচারপতি আবু সাঈদ।

এইচ টি ইমাম বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদের (১৯৭১-১৯৭৫) ক্যাবিনেট সচিব ছিলেন। পরে ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ক্যাবিনেট সচিব থাকা এইচ টি ইমামের পরবর্তীতে (পদাবনতি পদে) সচিব হিসেবে ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা সচিবের পদে নিযুক্ত ছিলেন।

মোশতাকের মন্ত্রিসভায় এম ইউসুফ আলী পরিকল্পনামন্ত্রী; ফণীভূষণ মজুমদার স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী; সোহরাব হোসেন পূর্ত ও গৃহনির্মাণ মন্ত্রী; আব্দুল মান্নান স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী; মনোরঞ্জন ধর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী; আব্দুল মোমিন কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী; আসাদুজ্জামান খান বন্দর ও জাহাজ চলাচল মন্ত্রী; ড. আজিজুর রহমান মল্লিক অর্থমন্ত্রী; ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বিমান ও পর্যটন; দেওয়ান ফরিদ গাজী বাণিজ্য ও খনিজ সম্পদ; তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তথ্য বেতার ও শ্রম; অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী শিল্প; নুরুল ইসলাম মঞ্জুর রেল ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়; কে এম ওবায়দুর রহমান ডাক ও তার; মসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া পাট মন্ত্রণালয়; ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতর; রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বন, মৎস্য ও পশুপালন; সৈয়দ আলতাফ হোসেন সড়ক যোগাযোগ; মোমেন উদ্দিন আহমেদ বন্যা পানি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

ওই সময় আর্মি চিফ অব স্টাফ জেনারেল সফিউল্লাহ, এয়ারফোর্স চিফ এ কে খন্দকার, নেভি চিফ অ্যাডমিরাল খান, ফরেন সেক্রেটারি ফখরুদ্দীন এবং পুলিশ প্রধান (আইজিপি) ছিলেন নুরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানী হন মন্ত্রীর সমমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা। মাহবুব আলম চাষী হন মুখ্য সচিব। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। তিনি পরবর্তীতে মোশতাকের অধীনে জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে শপথ নেন।

শপথবাক্য পাঠ করানো বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

এই হলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের অবস্থা এবং অবস্থান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে শুরু হয় আওয়ামী লীগের পতনের ইতিহাস। সেই থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছিল দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রক্ষমতার লোভ এবং আওয়ামী লীগ বিধ্বংসী আওয়ামী লীগের বিশ্বাসঘাতকরাই আওয়ামী লীগের পতন ডেকে এনেছিল। কিন্তু ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ধ্বংসস্তুপে পরিণত আওয়ামী লীগের পুনরায় হাল ধরেন। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগে বিশ্বাসঘাতকতা এবং অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের এখানেই শেষ নয়। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যখন আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা হয়, তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারাগারে। তখনও আওয়ামী লীগের একটি শ্রেণি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে মুচলেকা দিয়ে প্যারোলে মুক্তিলাভের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কারণে সেই ষড়যন্ত্র সফলতার মুখ দেখেনি। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খুনী মোশতাকরা পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু সেই সময়ে তাজউদ্দীন আহমেদের বিরোচিত ভূমিকার কারণে- সেটিও সম্ভব হয়নি।  ৭৫’র ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই। ১৯৮১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন, তখনও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তার নিকটাত্মীয়দের ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে যে বাকশাল করা হয়েছিল, সেটিও ছিল আওয়ামী লীগকে দুর্বল করে তোলার একটি অন্যতম ষড়যন্ত্র।              

সর্বশেষ এক-এগারো। এই এক-এগারো’র একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিলো বিরাজনীতিকরণ। বিরাজনীতিকরণের অংশ হিসেবেই মাইনাস-টু ফর্মুলা চালু করা হয়েছিলো ১/১১’র সময়ে। এ সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের চার বয়জেষ্ঠ্য নেতা। এক-এগারো’র সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগের মধ্যে সংস্কারপন্থীদেরকে উষ্কে দেয়া হয়েছিলো। এই সংস্কারপন্থীদের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগের ওই নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংস্কারের প্রস্তাব তুলেছিলেন। যে কারণে তাদেরকে বলা হয় সংস্কারপন্থি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১/১১ এর অন্যতম আলোচনার বিষয় হলো সংস্কারপন্থিদের ভূমিকা। এই সংস্কারপন্থিদের আওয়ামী লীগের তৃণমূল সে সময়ে সহজভাবে মেনে নেয়নি। তাদেরকে গণদুষমন বা দলের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিলো। যদিও এই সংস্কারপন্থিদের কেউ কেউ এখনও আওয়ামী লীগের সাথেই রয়েছেন। 

এছাড়াও, বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সময়কাল পর্যন্ত ক্ষমতার লোভে অথবা নিজস্ব ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন এবং করছেন, কেউ কেউ আবার দল থেকে বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। কিন্তু সকল ষড়যন্ত্র, বাধা-বিপত্তি আর ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আজ ৭৫ বছরে পা রেখেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ, এগিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ।  



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭