প্রকাশ: 23/06/2023
উত্তরা থেকে কাজী সাকিনুর সেতু গত ২১ জুন ইমেইলে আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন ‘প্রতি শনিবার অপেক্ষায় থাকি আপনার লেখা কলামটি পড়ার আশায়। গত ১৭/০৬/২৩ তারিখে আপনার লেখা কলামটি না পেয়ে খুব মনখারাপ হয়েছে। বিশেষ করে আমার মা আপনার কলামটি খুবই যত্ন সহকারে পড়েন।’ সেতুর চিঠির শেষ লাইনটি হৃদয়কে স্পর্শ করে। তিনি লিখেছেন ‘প্রতি শনিবার আমার মা অপেক্ষায় থাকেন আপনার কলামটি পড়ার আশায়। তাই আপনার লেখা প্রতি শনিবার আশা করি। তাই আপনার কাছে অনুরোধ প্রতি শনিবার আমার মায়ের হাসিটি যেন দেখতে পাই আপনার লেখা কলামটি পড়ে।’ টানা প্রায় আড়াই বছর ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’ নিয়মিত প্রতি শনিবার উপ সম্পাদকীয় লিখেছি। ১০ জুন প্রকাশিত হয় আমার শেষ কলাম। শিরোনাম ছিলো ‘নৌকা ডোবাতে মরিয়া কতিপয় মন্ত্রী এবং আমলা।’ সকালে সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকাটির সম্পাদক আমাকে টেলিফোন করে অভিনন্দন জানান। প্রিয় বন্ধু নঈম নিজাম জানান, তিনবার তিনি লেখাটি পড়েছেন। এই সময়ের সেরা লেখা এটি। দুপুরে আবার ফোন করেন বন্ধু সম্পাদক। এবার বেশ উচ্ছ্বসিত। বললেন, অনলাইনে পাঠক লেখাটা পাগলের মতো পড়ছে। রাতের মধ্যে ৫০ লাখ পাঠক এই লেখা পড়বে বলে মনে হয়। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই। রাত আটটায় আবার বন্ধুর ফোন। এবার বিষণ্ণতায় ভরা তার কণ্ঠ। বললেন, ‘লেখাটা অনলাইন থেকে সরিয়ে ফেলতে হচ্ছে।’ আমি কিছু বলিনি। পরদিন সকালে সম্পাদককে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠাই। জানিয়ে দেই, বাংলাদেশ প্রতিদিনে আর লিখবো না।’ সম্পাদক আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছেন। দীর্ঘ আড়াই বছরের যাত্রা ১০ জুন শেষ হয়েছে। লেখক হিসেবে আমি খুবই নগণ্য এবং তুচ্ছ। আমি যা লিখি তা আদৌ কিছু হয় কিনা, তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ। কিন্তু আমি আমার লেখার ব্যাপারে সৎ থেকেছি। আমার বিশ্বাসের সঙ্গে কখনো আপোষ করিনি। লেখা—লেখি আমার পেশা নয়, আবেগ। আমার বিশ্বাস ভুল হতে পারে, আমার লেখালেখি পক্ষপাত দুষ্টও হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমি ফরমায়েশী লেখক হিসেবে বিবেকহীন আনুগত্যের কাছে কখনো বশ্যতা স্বীকার করিনি। আমি মূলত: রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করি। আমার রাজনৈতিক ভাবনায় কোন অস্পষ্টতার কালো মেঘ নেই। কোন বিভ্রান্তি নেই। আমার চিন্তা-দর্শন নীতি থেকে কখনো বিচ্যুত হবো না। প্রয়োজনে লেখালেখি বন্ধ করে দেব। আমার এই নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে আমার নিকটজন অনেকেই একমত হননি। কিন্তু আমার সহধর্মিনী আমাকে সাহস জুগিয়ে বলেছে ‘তুমি হৃদয় থেকে যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই সঠিক’। নীতি, আদর্শ এবং বিবেক যখন চ্যালেঞ্জের মুখে পরে, তখন আপনার কি করনীয়? আদর্শ এবং নীতি থেকে একটু সরে গেলেই আপনি স্বাচ্ছন্দ্য পাবেন, ঝুঁকি মুক্ত নিরাপদ থাকবেন, তখন আপনি কি করবেন? একটু সমঝোতা করলেই আপনি বিতর্ক এড়িয়ে সুবিধামতো জায়গায় থাকতে পারবেন, আপনি কি সমঝোতা করবেন? এই প্রশ্নের মুখোমুখি প্রতিটি মানুষকেই জীবনে কখনো কখনো হতে হয়। ব্যক্তি জীবনে, পরিবাবে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব কাজ করে। ভাবে এই সিদ্ধান্ত কি ভুল ছিলো? এরকম দ্বন্ধের দোলাচলে আমিও আক্রান্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আমার দ্বিধা কেটে গেল প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যে। গত ২১ জুন বুধবার প্রধানমন্ত্রী গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন মানে খোলা বই। সব প্রশ্ন তাকে অকপটে করা যায়। যেকোন প্রশ্নের মুখোমুখি হন তিনি দ্বিধাহীন ভাবে। ঐ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘তারা (বিএনপি) কি সেন্টমার্টিন দ্বীপ বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়?’ শেখ হাসিনা বলেন ‘২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল কীভাবে? তখন তো গ্যাস বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। তাহলে এখন তারা দেশ বিক্রি করবে, নাকি সেন্ট মার্টিন বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে আসতে চায়?’ তিনি বলেন, আমি এতটুকু বলতে পারি, আমি জাতির পিতার বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আমার হাত থেকে এই দেশের কোন সম্পদ কারো কাছে বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে চাই না। ঔই গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিলে আমিও ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। আর এখনো যদি বলি ঔই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ কাউকে লীজ দেব, তাহলে আমাদের ক্ষমতায় থাকতে কোন অসুবিধা নেই। আমি জানি সেটা। কিন্তু আমার দ্বারা সেটি হবে না। বঙ্গবন্ধুর পর এদেশে আর কোন নেতা এরকম সাহসী উচ্চারণ করতে পারেননি। আদর্শ, নীতির প্রশ্নে অটল থাকার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অমরবাণী। গত এক বছরের বেশী সময় ধরেই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের টানা পোড়েন। আগে সম্পর্কের অস্বস্তি নিয়ে লুকোচুরি ছিলো। এখন তা প্রকাশ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা দিলো। মানবাধিকার রিপোর্টে জামায়াতকে সমাবেশ করার অনুমতি না দেয়ার জন্য আর্তনাদ করলো। নির্বাচন নিয়ে ভিসানীতি ঘোষণা করলো। এরপর কংগ্রেসম্যান, সিনেটররা পালা করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছেন। তাদের বিবৃতি গুলো পড়লে মনে হতেই পারে, বাংলাদেশ কি তাহলে পাকিস্তান কিংবা মায়ানমারের চেয়ে খারাপ? পাকিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যাথা নেই। যেখানে গণতন্ত্রের নামে তামাশা চলছে। সুপ্রীম কোর্ট আর সেনাবাহিনীর ‘টাগ অব ওয়ার’ দেখছে সেদেশের জনগণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন আইন প্রণেতা এনিয়ে একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা গণতন্ত্রকেই খেয়ে ফেলেছে। বিশ্ব নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙ্গুঁল দেখিয়ে যেখানে প্রকাশ্যে এবং গোপনে ব্যবসা করছে মার্কিন কোম্পানী। অথচ বাংলাদেশে কি এমন হলো যে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘুম হারাম। মুখে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, আমরা কাউকে ক্ষমতায় আনতে বা কাউকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চাই না। কিন্তু বাস্তবে তারা যেন সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করছে। কেন? এনিয়ে নানা জনের নানা মত। কেউ বলেন, বিএনপি-জামায়াতের লবিষ্ট ফার্মরা মার্কিন প্রশাসনকে প্ররোচিত করছে। একথা অস্বীকার কোন কারণ নেই যে, বিএনপি এবং জামায়াত বিভিন্ন লবিষ্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছে। এসব লবিষ্ট ফার্মের পেছনে তারা বিপুল অর্থর্ খরচ করছে। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন সম্পর্কে যারা খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন, শুধু লবিষ্ট ফার্ম দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের একটি দেশের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা অসম্ভব। অনেকেই বলেন, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কথা। বিদেশে বাংলাদেশের মিশন গুলোর অযোগ্যতা নিয়ে অনেক কথা শুনি। কিন্তু ব্যাপারটা তো এমন না, হঠাৎ করে আমাদের পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তারা অযোগ্য হয়ে পরলেন। তারা আগে যা ছিলেন এখনও তাই। তাদের ব্যর্থতা এবং সীমবদ্ধতা তো আছেই। কিন্তু এজন্য গোটা মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের নিবার্চন নিয়ে মাতম তুলবে। এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। মার্কিন অতি আগ্রহের কারণ স্পষ্ট করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগে এনিয়ে কানাঘুষা শুনেছি। কিন্তু গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী ঝেড়ে কেশে বললেন। এটাই আসলে শেখ হাসিনার শক্তি। তিনি সত্যটাকে সরাসরি জনগণের কাছে তুলে ধরেন। এজন্যই সাধারণ মানুষ তাকে বিশ্বাস করে। তার উপর আস্থা রাখে। সেন্ট মার্টিনের জন্যই যে যুক্তরাষ্ট্রের এতো আয়োজন, তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে এখন স্পষ্ট। শেখ হাসিনার জায়গায় অন্য কেউ হলে কি করতো? ‘সেন্টমার্টিন’ যুক্তরাষ্ট্রকে লীজ দিলে বাংলাদেশের কি কি লাভ হবে তার ফিরিস্তি তুলে ধরতো? আমি নিশ্চিত কোন সরকার প্রধান যদি এরকম সিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে, বিরোধী পক্ষ কেউ এমনকি কট্টর বামরাও তার প্রতিবাদ তো দুরের কথা, টু শব্দ করতো না। সুশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শেখ হাসিনা বন্দনা শুরু হয়ে যেত। মার্কিন পাসপোর্ট ধারী সুশীল বুদ্ধিজীবীরা বলতেন ‘এটাই শেখ হাসিনার সেরা সিদ্ধান্ত।’ বিরোধী আন্দোলন চুপসানো বেলুনে পরিণত হতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের প্রশংসায় মুগ্ধতার এক বিবৃতি প্রকাশ করতো। কী’ নিশ্চিত, নিরাপদ, সহজ সরল সমাধান ছিলো শেখ হাসিনার কাছে। কিন্তু সে পথে তিনি গেলেন না। তিনি বেছে নিলেন নীতি, আদর্শের পথ। যে পথের অভিযাত্রা ভয়ংকর ঝুঁকি। ক্ষমতা হারানোর ভয়। এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও। শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত সঠিক না ভুল তা নিয়ে বির্তক হতেই পারে। কিন্তু তিনি যে নীতির প্রশ্নে সৎ, আদর্শের ব্যাপারে অটল, এটি আবারো প্রমাণিত হলো। আদর্শ, আত্নসম্মান মর্যাদার জন্য যে তিনি ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নিতেও কুণ্ঠা বোধ করেন না, এটি সবার জন্যই এক শিক্ষা। আমার দ্বিধা, দ্বন্দ্ব , না লিখতে পারার কষ্ট মুহুর্তেই কেটে গেল। বঙ্গঁবন্ধু কন্যা যদি নীতির প্রশ্নে ‘ক্ষমতা’কে ঝুঁকিতে ফেলতে পারেন, তাহলে আমি আমার কলমের সাথে কেন সমঝোতা করবো? নীতির প্রশ্নে এতটুক আপোষহীন না থাকলে আমি কি মানুষ?
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল:
poriprekkhit@yahoo.com
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭