এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগের বন্ধুবেশে শত্রুরা


প্রকাশ: 30/06/2023


Thumbnail

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল। এই রাজনৈতিক দলটির সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের প্রধান সমস্যা হলো বন্ধু চিনতে ভুল করা। আওয়ামী লীগ যতবার বিপদগ্রস্ত হয়েছে, প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, ততবার বন্ধুবেশে আওয়ামী লীগের শত্রুরাই পিছনে ছুরি চালিয়েছে। আর তাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর টানা ১৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ১৪ বছর পার করবার পর, নতুন একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করছে। আর এই ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ কী তার সঠিক শত্রুকে চিনতে পারছে? সঠিক বন্ধুকে কী পাশে রাখতে পারছে? - এই প্রশ্নটি এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। 

আওয়ামী লীগ যদি তার সঠিক বন্ধুদেরকে চিনতে পারে, তাহলে আওয়ামী লীগ কখনও হারে না, এটাই হলো ইতিহাসের বাস্তবতা। ৭৫’র ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি। ৭৫’র আগের ঘটনাগুলো যদি আমরা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখি, বিশেষ করে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগে বন্ধুবেশে শত্রুরাই দলটির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। খুনী মোশতাক এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চারপাশ ঘিরে রেখেছিল। তাজউদ্দীন আহমদের মতো প্রকৃত দুঃসময়ের বন্ধুদের আওয়ামী লীগ দূরে ঠেলে দিয়েছিল। ভারতের সঙ্গেও সৃষ্টি হয়েছিল এক ধরনের দূরত্ব। বরং আওয়ামী লীগ তথাকথিত ইসলামি উম্মাহর নামে ‘ওআইসি’সহ নানা মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো- যারা সরকারিভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল, তাদের প্রতিও অনুরক্ত হয়ে পরেছিল। আর এ সমস্ত কাজগুলো করার ক্ষেত্রে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা সবাই পঁচাত্তরের পর অন্য চেহারায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে খুনী মোশতাকের সঙ্গে যারা ছিলেন না, যারা পৃথক অবস্থানে ছিলেন, তাদের ভূমিকাও রহস্যময়। বন্ধুবেশে তারা আসলে শত্রু কি না, সেটি ইতিহাসই নির্ধারণ করবে। তবে বন্ধুর ভূমিকায় যে, তারা অবতীর্ণ হননি, তা পরিষ্কার। ড. কামাল হোসেন ৭৫’র ট্র্যাজেডির সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৫ আগস্টের ঘটনার সময় তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। সেই সময়ে তার ভূমিকা কী ছিল? - তিনি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু সঙ্কটকালে তিনি কি বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন? কিংবা আব্দুল মালেক উকিল ৭৫’র ১৫ আগস্টের পর কোন ভূমিকা পালন করেছিলেন? - এইসব প্রশ্নের নির্মোহ উত্তর দরকার। 

৭৫’র ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে। নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে অবশেষে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তণ করেন। এ সময় যাদের প্রতি তিনি আস্থা রেখেছিলেন, যাদেরকে তিনি এই কঠিন দুঃসময় পাড়ি দেওয়ার জন্য সহযাত্রী হিসেবে পাবেন বলে ভেবেছিলেন, তারাই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তারাই তাকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। আর এই সময়েও আওয়ামী লীগ বন্ধুবেশি শত্রুদের কাছেই নাস্তানাবুধ হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আব্দুর রাজ্জাক পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি জাতির পিতার হাতে গড়া একজন রাজনীতিবিদ। কর্মীদের সঙ্গে তার ছিল নিবিড় সখ্যতা এবং সম্পর্ক। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি দেশে ফেরার পর তার ভূমিকা কী ছিল? তিনি কতটুকু সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যাকে? সেই প্রশ্ন আজ উঠতেই পারে। ১৯৯১’র নির্বাচন নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুঃসময়ে আওয়ামী লীগ যাদেরকে বন্ধু ভেবেছিল, তারা পাশে থাকেনি। বরং তারাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ক্ষতিগুলো করেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ড. কামাল হোসেন কি দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতির? তিনি গণফোরাম কেন গঠন করেছিলেন? আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিপন্ন করার জন্য? - এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি আজ আমাদের হতেই হবে। 

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন বিজয়ী হয়, তখন দুঃসময়ের সাথীরা দূরে সরে যায়। আওয়ামী লীগের অনেক নিত্য নতুন শুভাকাঙ্খি তৈরি হয়। অনেক নতুন বন্ধু জড়ো হয় চারপাশে। এই বন্ধুরা আওয়ামী লীগকে কতটুকু সহযোগিতা করেছে? বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিল। বন্ধুবেশে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ কী করেছিলেন, সেটা সকলেই জানে। আওয়ামী লীগ কী বার বার বন্ধু চিনতে ভুল করে? ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাদের উপর ভর করেছিল, তারা কেউই আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়ায়নি। বরং আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ কিংবা বিচারপতি লতিফুর রহমান বা তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ সাঈদের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। তারা একটি পরিকল্পিত মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। আর এই মিশনের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে হারানো। আর তাই ২০০১ সালে, বিয়াল্লিশ শতাংশ (৪২%) ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আরেকবার কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন, নিপীড়ন। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আক্রান্ত হন বিএনপি-জামায়াত শিবিরের তাণ্ডবে। কিন্তু সেই দুঃসময়ের সাথীরা এখন কোথায়? ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় যারা জীবন দিয়েছিল, যারা আহত হয়েছিল, চীরজীবনের জন্য যারা পঙ্গুত্বকে বরণ করেছিলেন, তারা এখন কোথায়? আওয়ামী লীগের কাছেই এটি এখন এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। ২০০৬ সালের আন্দোলনে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, যারা সেই সময়ে বিএনপির নীল নকশা ভেস্তে দেওয়ার জন্য রাজপথে সংগ্রাম করেছিলেন, তারা আজ কোথায়? 

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত এক-এগারো’র সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। এক- এগারো’র সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু হয় সংস্কারপন্থিদের এক উত্থান পর্ব। সেই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাদেরকেও বন্ধুবেশি শত্রুর রূপে দেখা যায়। যারা মুখোশ পরেছিল, তাদের মুখোশ খুলে যায়। তাদের আস্তানার মধ্যে লুকানো ছুরি বেরিয়ে আসে। কিন্তু ২০০৭ সালের সেই বিপর্যয় পাড়ি দেন শেখ হাসিনা একাই, লড়াই-সংগ্রাম করে। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। সেই থেকে এখনও ক্ষমতায় আছে। গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগের অনেক বন্ধু হয়েছে। ২০০৮ এ  যারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছিলেন, ২০০৭ সালের সেই দুর্গম পরিস্থিতিতে যারা আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, যারা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিলেন, সেই রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা এখন অপাংক্তেয়। তারা কোনো নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নাই। তারা কোনো সুযোগ-সুবিধাও গ্রহণ করেননি। এরকম শুভার্থীরা এখন আওয়ামী লীগে অপাংক্তেয়। তারা এখন দূর দ্বীপের বাসিন্দা। এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে নব্যদের ছড়াছড়ি, তারা এখন আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তা, তারাই এখন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক, তারা এখন আওয়ামী লীগের সবকিছু নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেশি। এই সমস্ত আওয়ামী লীগের নতুন বন্ধুরা কি দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের পাশে থাকবে? সামনে আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগকে তার বন্ধু চিনতে হবে। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে যে, দুঃসময়ে যারা পাশে ছিল, তারা সব সময় দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ায়। সুসময়ে যারা বন্ধু সাজে তারা দুঃসময়ে থাকে না। সুসময়ে যারা কাছে আসে, তারা আসে মধুর আশায়, নানা রকম প্রাপ্তির প্রত্যাশায়। এরা কেউ ব্যাংক পায়, কেউ ব্যাংক ঋণ নেয়, কেউ অর্থ পাচার করে, কেউ আওয়ামী লীগের পরিচয় ব্যবহার করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। এদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। এরা দুঃসময়ে পাশে থাকবে না। দুঃসময়ে যারা পাশে থাকবে- তাদের সাথে নিয়েই আগামীর ষড়যন্ত্র আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে হবে। সেটি কি আওয়ামী লীগ পারবে?



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭