ইনসাইড পলিটিক্স

চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে আওয়ামী লীগের সামনে পাঁচ বাধা


প্রকাশ: 05/07/2023


Thumbnail

আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের অভ্যন্তরীণ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার বিরোধী আন্দোলন, বহির্বিশ্বের পশ্চিমা দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, দেশের সাধারণ মানুষের জন্য দ্রবমূল্যের নিয়ন্ত্রণ, তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানামুখী চাপে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এ চাপগুলো আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতেও বড় বাধা বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী মহল এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। যদিও আওয়ামী লীগ বিষয়গুলোকে প্রকাশ্যে স্বীকার না করে উড়িয়ে দিচ্ছে, তথাপিও এসব চাপ নিয়ন্ত্রণে ভেতরে ভেতরে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে দলটি। দলের নীতিনির্ধারক মহল এসব বিষয়গুলোকে পর্দার আড়ালে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করে- তা মোকাবিলার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। 

ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় মনে করে, ১৫ বছরের টানা শাসনে তারা অভূতপূর্ব উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ভুলত্রুটি থাকলেও পরবর্তী মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তারা জন-অসন্তোষের সবকিছু সফলভাবে উতরাতে চায়। সে কারণে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে দলটি ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আওয়ামী লীগের চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার বাধা হিসেবে- এ বিষয়গুলোকে বাংলা ইনসাইডারের কাছে এভাবেই ব্যাখ্যা করেন। 

আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে যেসব বাধাগুলো রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো:-     

১. বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন: টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার জন্য বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনকে পাত্তা দিতে নারাজ আওয়ামী লীগ। তাদের বিশ্বাস, রাজপথের আন্দোলনে কেউ আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করতে পারবে না। তবে তাদের মাথাব্যথার একটিই কারণ; সেটি হলো- বিএনপিসহ সরকার বিরোধী দলগুলো আন্দোলনে রাজপথে টিকতে না পেরে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে নানা ধরনের নালিশ অব্যাহত রেখেছে, তাতে করে বর্তমান সরকারের উপর আন্তর্জাতিক মহলের এক ধরনের চাপ অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচনের আগে এ ধরনের চাপ আরও বাড়তে পারে বলেও মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী মহল।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘আমরা সব সময় চেষ্টা করব দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে। বিএনপি একদফার আন্দোলন বা আন্দোলনের নামে যদি পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, সেটা মানা হবে না। তখন রাজনৈতিকভাবেই তাদের মোকাবিলা করা হবে।’ এর বাইরে বিএনপির একদফার আন্দোলন শুরু হলে দেশকে স্থিতিশীল রাখাও সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতের মতো জ্বালাও-পোড়াও বা সহিংস পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সে বিষয়টি নিয়ে বেশ সতর্ক আওয়ামী লীগের নেতারা।      

২. পশ্চিমা দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল: বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা যদি ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের জন্য আরও চাপ বৃদ্ধি করে, একই সঙ্গে রাজপথের বিরোধী দলগুলোকে ব্যবহার করার পন্থা বেছে নেয়, সেটা হবে আওয়ামী লীগের চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার জন্য অন্যতম বাধা। আমেরিকা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ৯ কর্মকর্তার উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পাশাপাশি নতুন যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, তার আলোকে যদি আরও স্যাংশন দিতে চায়, সেটাও হবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার জন্য অন্যতম একটি বাধা। 

এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থার মদদে বাংলাদেশের দুর্নীতির খোঁজে কাজ করছে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)। এরই অংশ হিসেবে তাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কূটনীতিকদের সক্রিয় করার একটা অপচেষ্টা বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মূলত ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতকে অনুষ্ঠানে ডেকে অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে সিজিএস। এটি পশ্চিমা দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের একটি অন্যতম ষড়যন্ত্র। আসছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলো ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে আরও তৎপর হয়ে ওঠতে পারে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

৩. অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান: নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। এছাড়াও জাতীয় সংসদের বিভিন্ন উপনির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। বিএনপি দাবি করছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় এবং সেই বার্তা পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। ফলে বিএনপিসহ একটি পশ্চিমা পরাশক্তি এদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। কাজেই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করাও আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ইতিমধ্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ইস্যুতে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল এ মাসে ঢাকা সফর করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও এ মাসে ঢাকায় আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের টিম গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্নে কোনো ছাড় দিতে নারাজ। নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না হলে পরবর্তী সময়ে তারা কী পদক্ষেপ নিতে পারে, তাও অনেকটা স্পষ্ট করেছে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা চিঠি দিয়ে তাদের প্রেসিডেন্টকে চাপ প্রয়োগ করেছেন। এদিকে র‌্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে আরও কিছু সেক্টরে। বিশেষ করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশকে বাইরে রাখার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।        

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, বিদেশি শক্তি বা ষড়যন্ত্রের মদদে এবং সেটিকে মোকাবিলা করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটা অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু করা আওয়ামী লীগের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, নির্বাচন বন্ধ করার জন্য একটা চক্রান্ত হচ্ছে। এজন্য তিনি বিরোধী দল বিএনপিকে দায়ী করেন।

৪. দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ: নির্বাচনী বছরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। দেশের মানুষ সংসার চালাতে গিয়ে কঠিন সংকটের মধ্যে রয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোডশেডিং। শহরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সহনীয় হলেও গ্রামের চিত্র ভিন্ন। কখন বিদ্যুৎ আসে, কখন যায় আর কতক্ষণ থাকে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়বে। সরকার বিরোধী কাতারে জনগণের যুক্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী মনে করেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে না পারলে এর জন্য ক্ষমতাসীন দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক মূল্য দেওয়া লাগতে পারে। তবে বিষয়টি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে চান না।  এই পরিস্থিতির জন্য করোনা মহামারি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে আসছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু দেশের মানুষ এই যুক্তি পুরোপুরি মানতে রাজি নন। তারা এজন্য সরকারের সদিচ্ছাকেও দায়ী করতে চান।

৫. তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল: এই সময়ে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানো আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। কারণ, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে একদিকে যেমন কিছু নেতাকর্মী ফুলেফেঁপে উঠেছে, তেমনই দলের অসংখ্য নেতা-কর্মী হয়েছেন উপেক্ষিত, বঞ্চিত। তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে নানা উপদল। এ নিয়ে একরকম খুনোখুনি লেগেই আছে। নেতা-কর্মীদের এক কাতারে আনতে না পারলে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে। এই অভ্যন্তরীণ বিরোধ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে নেতারা আশঙ্কা করছেন।

ভোটের আগে ১৪ দলের শরীক ও অন্য মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখাটাও আওয়ামী লীগের জন্য আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ অনেকটা ক্ষোভে মহাজোট থেকে এক প্রকার বের হয়ে সরকার বিরোধী অবস্থান নিয়েছে জাতীয় পার্টি। মূলধারার নেতারা সরকারের সমালোচনায় মুখর। বাংলাদেশ জাসদ ১৪ দল ছেড়েছে। বিরোধ প্রকাশ্যে না এলেও ১৪ দলের কয়েকটি শরীক রাজনৈতিক দলের নেতা সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছেন। তাদের অবস্থান শেষ মুহূর্তে কী হয়, তা নিয়ে চিন্তিত খোদ আওয়ামী লীগ নেতারাই। আসন ভাগাভাগিসহ কয়েকটি ইস্যুতে শরীকদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার ওপর জোর দিচ্ছেন তারা।

এছাড়াও, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবার যোগ্য প্রার্থী বাছাই এবং দলের ইশতেহার তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। কারণ, মাঠের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি অগণিত কালোটাকার মালিক এই নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইবেন। যারা টাকার জোরে মনোনয়ন বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। অতীতের মতো নির্বাচন হলে সহজেই এমপি হওয়া যাবে-এ ধারণা থেকে এবার কালোটাকার মালিক বা নব্য বিত্তশালী হয়ে ওঠা ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন। তাদের মধ্য থেকে যোগ্য প্রার্থী খুঁজে বের করার কাজটি হবে খুবই কঠিন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭