এডিটর’স মাইন্ড

রেমিটেন্স যোদ্ধারা লাথি খায়, ব্যাংক লুটেরা পায় জামাই আদর


প্রকাশ: 07/07/2023


Thumbnail

ছেলেটির নাম জাহিদ। তার নিষ্পাপ দুটি চোখ ভরা বিস্ময়। বিমান বন্দরে কিছু ঠাউরে উঠার আগেই প্রচন্ড গালিতে কেঁপে উঠলো সদ্য কৈশোর পেরুনো জাহিদ। ‘কাগজ দেখাও’ বোর্ডিং পাস নিতে গিয়ে আঁতকে উঠলো সে। কাগজ বের করতে গিয়ে হুড়মুড় করে পরে গেল কাগজ পত্র। তার কাগজপত্র কুড়াতে কেউ এগিয়ে এলো না। বরং পিছন থেকে অপেক্ষমান যাত্রী রীতিমতো খিস্তি দিয়ে উঠলো। ছেলেটি যেন এক মহা অপরাধী। বিমানবন্দরে ঢুকে যেন সে মহা অন্যায় করে ফেলেছে। একজন বিমানের কর্মচারী এসে রীতিমতো লাথি দিয়ে তাকে সরিয়ে দিলো। বললো, আগে কাগজ পত্র ঠিক করে তারপর লাইনে দাঁড়াও। বিপন্ন বিস্ময়ে ছেলেটি এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। আমি এগিয়ে এলাম। কত হবে ছেলেটির বয়স বড়জোর ১৯/২০। বিজনেস ক্লাসের বোর্ডিং দিচ্ছিলেন একজন মহিলা। তাকে অনুরোধ করলাম ছেলেটির বোর্ডিং পাস আগে দিতে। ছেলেটি তখন কাঁপছে। ইমিগ্রেশনেও একই রকম হেনস্থা। ইমিগ্রেশন কাউন্টারের পাশেই একটা প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক। এখানে একজন বসে আধো ঘুম, আধো জাগরণে কিসের অপেক্ষা করছেন, কে জানে? ধাক্কা গুতা খেয়ে ছেলেটি ইমিগ্রেশন পার হলো। প্লেনে উঠার আগে আবার ছেলেটির সঙ্গে দেখা। মুম্বাই হয়ে মরিশাস যাবে সে। একটা কাজ পেয়েছে। বিমানে ওঠার আগে শেষ পরীক্ষাতেও পাশ করলো জাহিদ। শেষ চেকিং এর পর অযথাই একজন এয়ারলাইন্স ষ্টাফ তার কাছে বোর্ডিং পাশ চাইলো। ছেলেটি বোঝেনি হয়তো। এয়ারলাইন্স কর্মী এবার খেকিয়ে উঠলেন। ভয়ে কুঁকড়ে গেল জাহিদ। আমার স্ত্রী আর সহ্য করতে পারলো না। বললো, ওর সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করছেন কেন? ওরা আছে জন্যই আমরা আছি। এই দেশটা এখনও শ্রীলংকা হয়নি। এই দেশটাকে তো ওরাই সচল সবল রেখেছে। এয়ারলাইন্স কর্মী একটু কাচুমাচু হলো। আমি জাহিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। জাহিদ একজন রেমিটেন্স যোদ্ধা। এই যোদ্ধারাই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। সদ্য বিদায় নেয়া ২০২২-২৩ অর্থ বছরে দেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। এক জুনেই প্রবাসী আয় এসেছে ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। যেভাবে পিকে হালদার গংরা দেশ থেকে নির্বিচারে টাকা পাচার করেছে, তাতে বাংলাদেশের এতোদিন দেউলিয়া হয়ে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু হয়নি জাহিদদের জন্য। বাংলাদেশে ঋণ খেলাপী এবং অর্থ পাচারকারীরা একই সূত্রে গাঁথা। ঋণ খেলাপীরা ব্যাংক থেকে টাকা লুট করেন। এখন স্বনামে নয়, নিজেদের ড্রাইভার, চাকর, বাকরদের নামেও টাকা লুণ্ঠন করে অবাধে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর বলেছিলেন ঋণ খেলাপী আর বাড়বে না। কিন্তু এই অর্থমন্ত্রীর মেয়াদে খেলাপী ঋণ সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। যারা ব্যাংক লুট করে তারা ধনী। সমাজে প্রভাবশালী। তাদের টাকা দেশে নেই। এরা টাকা পাচার করেছে সুইজারল্যান্ড, কানাডা কিংবা আমেরিকায়। এখন এই দেশ গুলো তাদের জন্য নিরাপদ নয়। একারনেই তারা সুইস ব্যাংক খালি করে ফেলেছে। সুইজারল্যান্ড থেকে টাকা চলে গেছে দুবাই এবং মধ্য প্রাচ্যে। আমাদের ব্যবসায়ীদের বড় অংশ এখন ঘনঘন দুবাই যান। অনেকে যান চার্টার করা প্লেনে। দুবাইয়ের নানা গল্প শুনি। ধনিক গোষ্ঠীর কারো যদি দুবাইতে ঘরবাড়ী না থাকে,  তাহলে নাকি তিনি ইদানিং এলিট সমাজে মুখ দেখাতে পারেন না। আওয়ামী লীগ সরকারের হোমড়া চোমড়া এক প্রতিমন্ত্রীর দুবাইয়ে সম্পদের গল্প নিয়ে এখন এলিট পাড়ায় আলোচনা হয়। কার দুবাইয়ে শপিং মল আছে কে কয়টা এ্যাপার্টমেন্ট কিংবা ভিলা কিনেছে সে গল্পও কারও অজানা নয়। শুধু দুবাই কেন, কানাডায় বেগম পাড়ায় যারা ঘরবাড়ি বানিয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই আমলাগন। এরা এক সময়ে আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার ছিলেন। এদের অধিকাংশই নানা ভাবে সরকারের প্রিয়ভাজন ছিলেন বা আছেন। এরা তাদের চাকরীর মেয়াদ শেষে নানা চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এইসব ‘অতিভক্ত’ আমলাগনের এখন ঠিকানা দূরদেশে। ব্যাংক লুন্ঠনকারী, ঋণ খেলাপী, অর্থপাচারকারী এবং দুর্বৃত্ত আমলারা শেষে গিয়ে এক বিন্দুতে মিলিত হন। এরা সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে দেশের বারোটা বাজায়। লুটপাট করে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু বানিয়ে দেয়। অথচ এদের সর্বত্র ‘জামাই আদর’। ব্যাংকের টাকা মেরে দেয়া এক ‘বড় ব্যবসায়ী’ (নাকি ব্যাংক লুটেরা) যখন বিদেশে যান তখন তার প্রটোকলের বহর দেখে ভিড়মী খেতে হয়। কে তার ব্যাগ টানবে, কে তার জুতা ঠিক করে দেবে, এনিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। কেউ কি তাকে চ্যালেঞ্জ করে? কেউ সাহস করে বলতে পারে, আপনি অর্থপাচারকারী। দেশের টাকা ফেরত না দিলে আপনাকে বিদেশে যেতে দেবো না। সরকার কি সাহস করে বলতে পারেনা, ঋণ খেলাপীরা রাষ্ট্রের কোন সুযোগ সুবিধা পাবে না। আমরা সবাই মিলে দূর্বৃত্ত, লুটেরাদের খাতির করি। তাদের সীমাহীন অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতা সহ্য করি। ব্যাংক লুটেরা, অর্থপাচারকারীরা এখনও গর্বিত ভঙ্গীতে চলাফেরা করেন। রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধার বেশিটা পায় এরাই। আমরা সবাই জানি, দেশের ক্ষতি করা ছাড়া এদের কোন অবদান নেই। ৫২ বছরে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক খানি। বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর অগ্রযাত্রায় যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের কৃষক, গার্মেন্টস কর্মী নারী, রেমিটেন্স যোদ্ধারা। এছাড়াও ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তা, মুটে মজুর অন্যান্য শ্রমিকদের অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় যারা সম্মুখ সমরের যোদ্ধা তাদের জন্য আমরা, এই রাষ্ট্র কি করছে? ১৭ কোটির দেশের খাদ্য ঘাটতি নেই। বাংলাদেশের কৃষকরা আসলে শস্য ফলায় না সোনা ফলায়। কৃষকদের কি কেউ সিআইপি পুরুস্কার দেয়? পাঁচ তারকা হোটেলে মন্ত্রী বাহাদুররা ডেকে তার সংগে একদিন ফটোসেশন করে? অর্থনীতিতে অবদান রাখা কৃষকদের স্বীকৃতি কি? এমনকি তারা ন্যায্য মূল্যটাও পায় না তাদের উৎপাদিত ফসলের। লাভের গুড় খায় সিন্ডিকেট। যার কথা বানিজ্য মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন। গার্মেন্টস এ যে নারী শ্রমিকরা দিনরাত একাকার করে কাজ করেন, তাদের ক’জন ন্যায্য মজুরী টুকু পান। শ্রমিকদের ঠকিয়েই তো গার্মেন্টস মালিকরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এই সব নব্য ধনিকগোষ্ঠী আবার সংসদেও রাজনীতিবীদদের হটিয়ে জায়গা করে নিচ্ছেন। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এক মন্ত্রীর ব্যর্থতার কাহিনী তো আরব্য রজনীর গল্পের চেয়েও লম্বা। শ্রমিকদের ঠকানো ছাড়া কজন গার্মেন্টস মালিক আছেন, তার তালিকা কি কেউ প্রকাশ করবেন প্লীজ। রেমিটেন্স যোদ্ধা কিংবা প্রবাসী কর্মীদের নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি। নানা আয়োজন করি। কিন্তু সত্যি কি আমরা তাদের মর্যাদা দেই। তাদের স্যালুট করি? বিমানবন্দরে জাহিদের অবস্থা দেখে আমার মনে এই প্রশ্নটি তোলপাড় করছে। আমাদের এককালের মুক্তিযোদ্ধা হলেন গার্মেন্টস কর্মী, কৃষক, প্রবাসী কর্মী। তারাই আমাদের সবচেয়ে গর্বের। সম্মানিত নাগরিক। আর লুটেরা ঋণ খেলাপী, অর্থপাচারকারীরা হলো এযুগের রাজাকার, আলবদর, যুদ্ধাপরাধী। যেদিন আমরা এই সব যুদ্ধাপরাধীদের দন্ডিত করতে পারবো, সেদিন এই যুদ্ধ শেষ হবে। যেদিন আমরা কৃষক, শ্রমিক, প্রবাসী ভাইদের স্যালুট জানাতে পারবো, সেদিন আমরা জাতি হিসেবে মহান হবো।
  

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭