ইনসাইড বাংলাদেশ

‘বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমর্থন করা মোটেও উচিত হবে না ইইউ'র’


প্রকাশ: 12/07/2023


Thumbnail

চলতি সপ্তাহে দ্য ইউরোপিয়ান টাইমস ও ইইউ অবজার্ভারে ‘দ্য ইইউ মাস্ট নট সাপোর্ট আ কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধ লিখেছেন ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি’র (ইআইটি) সদস্য ইয়ান ফিজেল। এর আগে তিনি ইইউ'র সাবেক কমিশনার ও ধর্ম বিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিষয়টি বাংলাদেশের সাথে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় অনুবাদের চম্বুক অংশ পাঠকদের কথা বিবেচনা করে তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে কোনোভাবেই সমর্থন দেয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন ইইউ’র সাবেক কমিশনার ও ধর্ম বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়ান ফিজেল।

তিনি বলেছেন, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা দেয়া হলে তা আবারও সামরিক বাহিনীর হাতে চলে যেতে পারে। যেমনটা ঘটেছিল এখন থেকে ১৭ বছর আগে ২০০৬ সালে।
 
নিবন্ধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর একনায়কতান্ত্রিক শাসনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখন থেকে প্রায় ৯ বছর আগে থাইল্যান্ডে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল সামরিক জান্তা। সেই সময় ওই জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তখনকার ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান ফেদেরিকো মোঘেরিনি।
  
প্রশংসার পাশাপাশি তার জন্য একটি পূর্বাভাসমূলক সতর্কবার্তাও ছিল: ‘ক্ষমতা একবার সামরিক বাহিনীর দখলে চলে গেলে, সেটা তারা আর সহজে ছাড়তে চায় না। বিশেষ করে জান্তা সরকার নতুন করে এমনভাবে সংবিধান লেখে যাতে ক্ষমতার ওপর তাদের দখল চিরস্থায়ী হয়।’
 
নিবন্ধ অনুযায়ী, অনেকটা প্রত্যাশিতভাবেই থাইল্যান্ডে ২০১৭ সালে নতুন সংবিধান চালু করা হয়। যা সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করে। এরও দুই বছর পর অবশেষে ২০১৯ সালে সেখানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যার মধ্যদিয়ে জান্তা সরকারের প্রধান তার সামরিক উর্দি ছেড়ে ‘বেসামরিক’ চেহারায় থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী হন।
 
দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত ৯ বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই থাইল্যান্ডের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে এবং তার নীতির বিসর্জন দিয়েছে। এক কথায় গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানোর পরিবর্তে দেশটির অগণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্কে ফিরে আসে।
 
অবশেষে চলতি বছরের মে মাসে নতুন সংবিধানের অধীনে দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবার সামরিক অভ্যুত্থানের ৯ বছর পর সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোকে একপাশে সরিয়ে মুভ ফরোয়ার্ড ও পিউ থাই পার্টির মতো গণতন্ত্রপন্থী দলগুলো বড় জয় পেয়েছে।
 
তবে নির্বাচনের তিন সপ্তাহ পরও সরকার গঠন সম্ভব হয়নি। গণতন্ত্রপন্থী জোটের মনোনীত প্রধানমন্ত্রী এখনও অনিশ্চতার মধ্যে রয়েছেন। তার ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়া এখনও অনেকটা ক্ষমতাসীন শক্তির ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করছে।
  
থাইল্যান্ডের পাশের দেশ মিয়ানমারেও গত দুই বছর ধরে সামরিক শাসন চলছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতার দখল নেয় দেশটির কুখ্যাত সেনাবাহিনী।
 
ইয়ান ফিজেল বলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা মিয়ানমারের জান্তা নেতাদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের শুরুতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ইইউ। এখন আমাদের প্রত্যাশা, থাইল্যান্ডের মতো মিয়ানমারে নিজের নীতির বিসর্জন দেবে না ইইউ। বরং পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মিয়ানমারের জনগণের চলমান লড়াইয়ের পক্ষেই থাকবে।
 
এরপর নিবন্ধে বাংলাদেশ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ইয়ান ফিজেল বলেন, ‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। আমাদের সবাইকে দেশটির দিকে নজর দেয়া উচিত।’
 
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর দেশটির প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও ইসলামপন্থি জামায়াতে ইসলামী দাবি তোলে, আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে। তা নাহলে নির্বাচন বয়কট করারও হুমকি দিয়েছে দল দুটি। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সেই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। বলেছেন, অনির্বাচিত কোনো সরকারের হাতে আর কখনই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না।
 
বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিক্ত ইতিহাস তুলে ধরে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানকে সমর্থন করেছেন ইইউ’র সাবেক এই কমিশনার।  নিবন্ধে তিনি বলেছেন, সবশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে ঘটনাক্রমে তা সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা থাকলেও তারা নির্বাচনই স্থগিত করে এবং ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কার্যত দেশ শাসন করে।
 
২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সেই সময় প্রধান বিরোধী দল ও বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন বয়কট করে। যার প্রেক্ষিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সব নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটা অনির্বাচিত সরকার পরবর্তী দুই বছর ধরে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল, তা সাধারণত কোনো জান্তা সরকারই করে থাকে।
 
বিএনপির বর্তমান দুই শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান ছাড়াও সেই সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও জেল-জরিমানা দেয়া হয়। সেদিনের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রভাবক হয়ে থাকতে পারে।
 
ইয়ান ফিজেল আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এমন একটি ব্যবস্থা যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার বলেছে, আগের নির্বাচনগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কারণ সে সময়গেুলোতে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের কোনো আইনি ভিত্তি ছিল না। তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি নতুন আইন পাস করা হয়।
  
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে চাপ অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি অবাধ ‍ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই সঙ্গে নির্বাচন তদারকি করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানিয়েছেন তিনি।
 
নিবন্ধে বলা হয়, চলতি বছরের জুনে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর গাজীপুরে সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে ও বড় কোনো অঘটন ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে কম ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছেন। যদিও বিএনপি এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি।
 
ইয়ান ফিজেলের মতে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় পক্ষের মধ্যে একটি অচলাবস্থা বিরাজ করছে। বিরোধীদের নির্বাচন বয়কটের আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলে আরেকটি সামরিক হস্তক্ষেপের মঞ্চও প্রস্তুত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি সামরিক বাহিনীকে থামাতে হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সামরিক নেতাদের এটা অবশ্যই স্পষ্ট করে দিতে হবে যে এর পরিণতি হবে অত্যন্ত খারাপ।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭