ইনসাইড থট

তিনটি জেনারেশন, যাদের অবদান দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে


প্রকাশ: 13/07/2023


Thumbnail

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের কাজের সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আজ অনেক দূর এগিয়ে এসেছে, অনেক কিছুই অর্জন করেছে। এই অর্জনের পেছনে যে তিনজনের অবদান সবচেয়ে বেশি, জীবন সায়াহ্নে এসে যাদের অবদানের কথা আমার সবচেয়ে বেশি মনে পরে, তাদের নিয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাই। 

প্রথমত, সর্ব যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে দেখলেন এখানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এডুকেশনের ভালো ব্যবস্থা নেই। তখন তিনি দেশে ফেলোশিপ অব কলেজ এন্ড ফিজিশিয়ান এন্ড সার্জন (এফসিপিএস) প্রতিষ্ঠা করলেন। একই সাথে তিনি মেডিকেল রিসার্চের কথা চিন্তা করেন এবং বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বা বিএমআরসি প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু তাই নয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে তখন তিনি থানা হেলথ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। একটি জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তখন পাকিস্তানিরা যে রাস্তা ভেঙ্গেছিল, পুল ভেঙ্গে রেখেছিল, চট্টগ্রাম বন্দরকে তখন বোমা পুঁতে রেখে অচল করে রেখেছিল সেগুলোকে নিরাপদ করার কাজকে তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কিন্তু এগুলোর পাশাপাশি জনগণের মৌলিক চাহিদা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও তিনি চিন্তা করতেন এবং সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজও তিনি শুরু করেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া। বঙ্গবন্ধুই স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় অর্থাৎ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মাত্র ৩ বছরেই তিনি প্রতিটি থানায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’। চালু করেছিলেন ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে।

এরপর ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে গনতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করলেন। তিনি কিন্তু একটি দর্শন নিয়েই দেশে ফেরত এসেছিলেন। আমরা অনেকেই হয়তো ভুলে গেছি যে, তখন দেশে কারফিউ ছিল। নেত্রী শেখ হাসিনার আন্দোলনের ফলে কারফিউ তুলে নিতে সরকার বাধ্য হয়। তারপরে তিনি ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন। যার ফলে আমরা গণতান্ত্রিক ভাবে ভোটের সুযোগ পাই। এর আগে ধারণা ছিল যে গুন্ডা হলেই নির্বাচনে জেতা যায়। এসব নৈরাজ্য তিনি বন্ধ করলেন এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ ভেঙেচুরে দেয়া হয়েছিল সেই আদর্শকে তিনি শুধু জোড়া লাগালেন না, সেটিকে বুকে ধারন করলেন এবং একে একে বঙ্গবন্ধুর অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে নেমে পরলেন। ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা পিতার স্বপ্ন ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। জন্ম দেন অভিনব ধারণা কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে মোট ১৪ হাজার ৪৯০টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা গ্রামে ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা শুরু হয়। ২০০১ সালের মধ্যেই ১০ হাজার ৭২৩টি অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চালু করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সংবিধানেও বলে গিয়েছিলেন যে, কোনো একটি লোকও যেন চিকিৎসা সেবার বাইরে না থাকে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সেটি বাস্তবায়ন করলেন।

দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা এমন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলেন যেন ২৫ মিনিটের মধ্যে মানুষ চিকিৎসা সেবা পেতে পারে। পাশাপাশি চিকিৎসার সাথে সাথে কি কি খেলে তার নিউট্রিশন বাড়বে, হাটলে যে অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং প্রাথমিক অবস্থায় আসলে যে তাদের সামান্য ঔষধেই ভালো করা যাবে এসব বিষয়ে অবগত করবে। আর যেটি তাদের সীমারেখার বাইরে সেটি তারা রেফার করবে। এই রেফারের সিস্টেমটা যেনো সঠিক হয় সেজন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক ভিত্তিক মডেল জাতিসংঘে ‘কমিউনিটি ভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি’ শিরোনামের ঐতিহাসিক রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে এবং দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এই কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে কোন মানুষ আর মূল স্বাস্থ্যসেবার বাইরে থাকল না। 

দার্শনিক শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বাল্যবিবাহও রোধ করেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে হেলথ ওয়ার্কার হিসেবে চাকরির ব্যবস্থা হবার ফলে অনেক মেয়েই বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং স্বাবলম্বী হয়েছে। ফলে দেখা গেছে স্কুলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা বিশ্বে একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন দার্শনিক শেখ হাসিনা। চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে তিনি শান্তি স্থাপনের যে নজির সৃষ্টি করেছেন- তা পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। জাতিসংঘ এখন অন্যান্য দেশকেও এই মডেলের অনুকরণে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের ব্যপারে উৎসাহিত করছে। 

এরপর শেষ আরেকজনের কথা না বললেই নয়। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে অটিজম আন্দোলনের ফলে অনেক অটিস্টিক শিশু মূলধারায় ফিরে আসছে। তিনি ২০০৮ থেকে শিশুদের অটিজম ও স্নায়বিক জটিলতা-সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ শুরু করেন। এছাড়া বাংলাদেশের অটিজম-বিষয়ক জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের কাজের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রশংসা পেয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪-এর সেপ্টেম্বরে তাকে ‘হু’ ‘অ্যাক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। 

এক সময় অটিস্টিক শিশু সমাজ ও পরিবারে অবহেলিত ছিল। এ ধরনের শিশুর পরিবারকেও সামাজিকভাবে অনেক অবজ্ঞা সহ্য করতে হতো। অটিস্টিক শিশুর সঙ্গে সাধারণ শিশুদের মিশতে দেয়া হতো না। এসব অবহেলিত শিশুদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সায়মা ওয়াজেদ। অটিজম বিষয়ে সচেতনতা ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের অবদান অতুলনীয়। আমার নিজের নাতিরও অটিজম আছে। তাই আমি জানি সায়মা ওয়াজেদের অবদান কতটা গুরুত্ব রেখেছে। 

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যদি চিন্তা করি তাহলে, একই পরিবার থেকে তিনটি জেনারেশন যাদের অবদান এ দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রথমে জাতির পিতা, তারপর তার কন্যা দার্শনিক শেখ হাসিনা, তারপর তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ। এমন উদাহরণ বিশ্বে কোথাও পাওয়া খুব কঠিন। একজন নাগরিক হিসেবে এটি আমাদের জন্য অত্যান্ত গর্বের বিষয়।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭