এডিটর’স মাইন্ড

আবার কি বর্গি এল দেশে?


প্রকাশ: 14/07/2023


Thumbnail

“খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে।” ছোট বেলায় নানি, দাদির কোলে শুয়ে এই ছড়া শোনেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুস্কর। কিন্তু এমন নিটোল ছড়ার আড়ালে লুকিয়ে আছে লুন্ঠনকারীদের অত্যাচারের রক্তাক্ত অধ্যায়। এই ছড়ার সৃষ্টির পেছনে আছে ভয়ার্ত ইতিহাস। বর্গি আসলে কারা? কেনইবা তাঁদের খাজনা দেয়া নিয়ে উৎকন্ঠার শব্দ পংক্তি? অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার উপর চড়াও হওয়া মারাঠা লুটতরাজকারীদের বর্গি বলা হতো।

১৭৪০ সালের এপ্রিলে বাংলার নবাব হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন আলিবর্দি খান। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দোলার নানা ছিলেন আলিবর্দি খান। তিনি সরফরাজ খানকে পরাজিত এবং নিহত করে বাংলার মসনদ দখল করেন। সরফরাজ খানের শ্যালক রুস্তম জং আলিবর্দি খানের কতৃত্ব অস্বীকার করেন। তিনি ছিলেন উড়িষ্যার নায়েবে নাজিম। ‘ফলওয়াইয়ের যুদ্ধে’ রুস্তম জংকে পরাজিত করেন আলিবর্দি খান। পরাজিত রুস্তম জং সাহায্য প্রার্থনা করেন নাগপুরের মারাঠা শাসকের। মারাঠাদের সাহায্যে রুস্তম উড়িষ্যা পূন:দখল করেন। কিন্তু এর মাধ্যমে লুটতরাজ প্রিয় মারাঠাদের উৎপাত শুরু হয়। ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, ১৭৪১ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত দশ বছর নিয়মিত লুটতরাজ করতো মারাঠি বর্গিরা। এই দশ বছর বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল বর্গিরা। আলিবর্দি খান যুদ্ধক্ষেত্রে প্রভুত বীরত্বের পরিচয় দিলেও বর্গি আক্রমন ঠেকাতে পারেননি। বর্গি আক্রমনের এক দশককে ইতিহাসবিদরা বাংলার বিভীষিকাময় দশক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিছুতেই বর্গি আক্রমন নিয়ন্ত্রন না করতে পেরে নবাব আর্লিবর্দি খান মারাঠি বর্গি দের সাথে সন্ধি করেন। তাদের উড়িষ্যা ছেড়ে দেন। ‘বর্গি’ নামের এই বহিরাগত লুন্ঠনকারীদের বাংলায় প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছিল রুস্তম জং। ক্ষমতার লোভে রুস্তম বাইরের শক্তিকে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন। যার মাশুল দিতে হয়েছিল বাংলার জনগণকে । তবে কেবল চিহ্নিত শত্রুরা আলিবর্দি খানকে দমাতে বর্গিদের আমন্ত্রন জানায় নাই। নবাবের বিশ্বস্ত  হিসেবে পরিচিত মীর হাবিবও বাংলায় বর্গি লুন্ঠনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। নবাব আর্লিবর্দি খার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তি গোপনে লুন্ঠনকারী বর্গিদের কাছে বাংলার গোপন তথ্য পাচার করতো।

আড়াইশো বছর আগে বর্গি লুন্ঠনের ইতিহাস মনে পড়লো সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে। এখন যুদ্ধ করে নয়, ক্ষমতায় আসতে হয় নির্বাচন করে। নবাবদের রাজত্ব আর নেই। জনগণের শাসন, ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আগের মতো লুন্ঠনকারীরা সাত হাত কম্বল আর বর্ষা নিয়ে আসে না। আসে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন ইত্যাদি ‘ফতোয়া’ নিয়ে। সেকালের বর্গি দের সাথে এখনকার পশ্চিমা হস্তক্ষেপকারীদের পার্থক্য খুব সামান্যই। উভয়েই বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মারাঠি বর্গিদের লক্ষ্য ছিলো বাংলার মানুষের সম্পদ। আর বর্তমান সময়ের অনুপ্রবেশকারীদের নজর তেল, গ্যাসক্ষেত্র, সেন্টমার্টিন কিংবা বাংলাদেশের বাজার দখল।

বাংলাদেশে নির্বাচন হবে চলতি বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে। কিন্তু নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ নিয়ে ঘুম নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর। ১১ জুলাই থেকে চারদিনের সফরে এসেছিলেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারী উজরা জেয়া’র নেতৃত্ব একটি দল। জেয়া’র সংগে ছিলেন দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়া ব্যুরোর অ্যাসিটেন্ট সেক্রেটারী ডোনাল্ড লু এবং আরো ক’জন। তারা বাংলাদেশ দাঁপিয়ে বেড়ালেন। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও সাক্ষাত করেন উজরা। এমন ভাবে মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে মার্কিন প্রতিনিধিদল কথা বলেছেন, তাতে যে কারো ভ্রম হতেই পারে, তারা বোধহয় আমাদের প্রভু। বাংলাদেশ ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত গর্ঠিত স্বাধীন জাতি। কিন্তু গত দুবছর ধরে মারাঠা বর্গিদের মতো যুক্তরাষ্ট্র এদেশের জনগণের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। জনগণের মধ্যে সৃষ্টি করছে ভয় ও ভীতির সংস্কৃতি। বর্গিদের মতোই তারা বার বার বিভিন্ন ইস্যু সামনে এনে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে চাইছে। হ্যাঁ, বাংলাদেশের উন্নয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়ন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের গার্মেন্টস রপ্তানীর প্রধান ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাই বলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে করতলগত রাখার জন্য অব্যাহত চাপ কি একধরনের লুন্ঠন নয়? বাংলাদেশে নির্বাচন কিভাবে হবে, না হবে তা তো বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত। এনিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন স্বঘোষিত মুরুব্বী সেজে বসেছে তা বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। যে কারনে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠাদের চোখ পরেছিল বাংলার উপর, ঠিক একই কারণে এখন মার্কিনীদের নিদ্রাহীন উদ্বেগ বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে।

মার্কিন প্রতিনিধিদের আগে থেকেই (৯ জুলাই) দীর্ঘ ১৫ দিনের সফনে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। তারাও বিভিন্ন অংশীজনের সাথে কথা বলেছে। বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরাও ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে তাদের মনোতুষ্টিতে ব্যস্ত। এমনকি তারা স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ফ্যাসিষ্ট জামায়াতের সাথেও বৈঠকের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জামায়াত তাদের ‘দাওয়াত’ কবুল করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক দলের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ আওয়ামী লীগ সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে করেনি। অথচ এই আওয়ামী লীগই একাধিক কূটনৈতিক বৈঠকে যায়নি, অথবা গিয়েও ফিরে এসেছে শুধু মাত্র যুদ্ধাপরাধীদের উপস্থিতির কারণে। এখন কি আওয়ামী লীগ অসহায়? ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের কি কেউ জিজ্ঞেস করেছে, ইইউ এর অর্ধেক দেশে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কেন ৩০ ভাগের বেশী হয় না। তরুনরা নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী নয় কেন? যাদের নিজেদের দেশে গণতন্ত্র নিয়ে অনীহার কালো মেঘে আচ্ছন্ন, তারা আমাদের নির্বাচন কি পর্যবেক্ষন করবে? ইইউ দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘একান্ত অনুগত’ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তার সর্বশেষ প্রমাণ। মার্কিন ইন্ধনেই কি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ইউরোপের এতো আগ্রহ। 

এই দেশগুলো কেন বাংলাদেশ নিয়ে এতো উৎসাহী। এর একটি কারণ বিএনপি। রুস্তম জং যেমন সরফরাজ খানের পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। নিজের শক্তিতে আলিবর্দি খাকে হটাতে পারবেন না জেনে মারাঠাদের আমন্ত্রন জানিয়েছেন। ঠিক তেমনি বিএনপি। সরকারের বিরুদ্ধে জয়ী হবার জন্য তারা ‘নব্য মারাঠী’দের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। দেশের স্বার্থের চেয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোই বিএনপির এখন প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মর্যাদা বিএনপির কাছে কিছু না। বিএনপি জানে নিজেদের শক্তিতে নির্বাচন কিংবা আন্দোলন কোনটাতেই তারা আওয়ামী লীগকে হারাতে পারবে না। তাই এবার তারা বিদেশী বর্গিদের কাছে নালিশ করেছে। বাংলাদেশে বিদেশী হস্তক্ষেপের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সেই একই ঘটনার যেন পূনরাবৃত্তি। তবে রুস্তম জং যেমন একা পারেনি। নবাবের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত মীর হাবিব গোপনে বর্গিদের সহায়তা দিয়েছে বলেই বর্গিরা দূর্বীনিত হয়ে উঠেছিল। মীর হাবিব বাংলার গোপন তথ্য জানিয়ে দিতো বর্গিদের কাছে। তেমনি এই সরকারের ভেতরও কিছু বিশ্বাসঘাতক রয়েছে, যারা সরকারের ঘনিষ্ঠ, কিন্তু গোপনে পশ্চিমাদের সাথে আঁতাত করছে। গোপন তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে নব্য বর্গিদের হাতে। সে কারণেই আড়াইশ বছর পর আবার বাংলায় নতুন বর্গিদের হানা।

নব্য বর্গিদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে হলে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। রক্তে কেনা আমাদের স্বাধীনতা। কোন ভাবে কেউ যেন আমাদের প্রভু সাজতে না পারে, তার জন্য রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদেরই। বিষয়টি নির্বাচন কিংবা গণতন্ত্রের নয়। বিরোধটা আওয়ামী লীগ-বিএনপির নয়। ৫২ বছরে বাংলাদেশ যে আত্মনির্ভরতার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেই মর্যাদা এবং সম্মান আমরা বিঁকিয়ে দেবো কিনা, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আমরা নতুন করে বর্গিদের ডেকে এনে কি জনগণকে দূর্বিসহ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবো কিনা, সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদেরকেই।
  
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭