ইনসাইড বাংলাদেশ

পুলিশের দাবি ব্যক্তিগত শত্রুতা, আ. লীগ বলছে পথচারী, বিএনপির দাবি হত্যা


প্রকাশ: 19/07/2023


Thumbnail

লক্ষ্মীপুরে বিএনপির পদযাত্রা ও আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষের সময় নিহত যুবক সজীবের হত্যার ঘটনাকে অস্বীকার করেছে পুলিশ। নিহতের এ ঘটনাটি পৃথক হামলা এবং ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে তিন থেকে চারজন যুবক সজীবকে কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে দাবি পুলিশের। 

বুধবার (১৯ জুলাই) বেলা সাড়ে এগারোটায় পুলিশ সুপার কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করে এ কথা জানান পুলিশ সুপার মো: মাহফুজ্জামান আশরাফ। পুলিশের দাবি নিহত ব্যক্তি কৃষকদলের সদস্য বা নেতা নয়।

এদিকে, এ ঘটনায় বুধবার বিকেল পর্যন্ত থানায় কোন মামলা হয়নি।

এর আগে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বিএনপির পদযাত্রা ও আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে মারা যায় সজীব (৩০)। নিহত সজীব (৩০) চরশাহী ইউনিয়নের নুরুল্লাহপুর গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে। বুধবার দুপুরে পুলিশ ও র‌্যাবের যৌথ নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নিহতের মরদেহ লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল মর্গ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মরদেহ তার গ্রামের বাড়িতে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। 

বিএনপির অভিযোগ, ছাত্রলীগের কর্মীরা কৃষকদল কর্মী সজীবকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আওয়ামী লীগ বলছে, সজীব ছিল একজন পথচারী। এ হত্যার সাথে আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত নন। আবার ঘটনার পর নিহত সজীবের পকেটে কৃষকদলের একটি ব্যাজ এবং ক্যাপ পেয়েছে হাসপাতালের চিকিৎসকরা। পরিবারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে, সজীব বিএনপির পদযাত্রায় অংশ নিতে জেলা শহরে যায়। বুধবার (১৯ জুলাই) দুপুরের দিকে সজীবের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়।

সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) আনোয়ার হোসেন বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, বেলা ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে সজীবের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। তার বাম হাতের বাহুতে দুটি জখম আছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। 

বুধবার (১৯জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিএনপির পক্ষ থেকে জেলা শহরের গো-হাটা সড়কের জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানির বাসভবনের সামনে সজীবের জানাজা নামাজের আয়োজন করা হয়। সেখানে সজীবের মরদেহ আনতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু পুলিশ সজীবের মরদেহ দেয়নি বলে অভিযোগ করেছে জেলা বিএনপির নেতারা। 

কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, সজীব কৃষকদলের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। তার দাদা হানিফ মিয়া ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। সে বাড়ি থেকে পরিবারকে জানিয়ে বিএনপির পদযাত্রায় এসেছে। এখানে এসে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে তাকে খুন হতে হলো। 

সজীবের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধন্যপুর গ্রামের কফিল মেম্বার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সজীবকে হারিয়ে তার মা নাজমা বেগম ও বোন কাজল আক্তার আহাজারি করছেন। বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন বাবা আবু তাহের। 

নিহতের বাবা আবু তাহের জানান, তিন ছেলের মধ্যে সজীব পেশায় টাইলস মিস্ত্রি ছিল। সে তার মেজো ভাই সুজনের সঙ্গে কাজ করত। বড় ছেলে মিজান সৌদি আরব প্রবাসী। কয়েকদিন পর সজীবেরও সৌদি যাওয়ার কথা ছিল। মঙ্গলবার (১৮জুলাই) যখন সজীব বিএনপির পদযাত্রায় যাওয়ার সময় সে আমাকে বলে যায়, বাবা আমি একটু লক্ষ্মীপুর থেকে আসি। সন্ত্রাসীরা তারা ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করছে।

চরশাহী ইউনিয়ন বিএনপি সাধারণ সম্পাদক সাফায়ত হোসেন স্বপন বলেন, সজীব আমাদের দলের একজন সক্রিয় কর্মী। তার বাড়ি চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নে হলেও তিনি সব সময় চরশাহী ইউনিয়ন বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে মিছিল-মিটিংয়ে যেতেন। 

কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি মঙ্গলবার রাতে তার বাসভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে এ হত্যার ঘটনায় লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দায়ী করেছেন। এ ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে বলেও জানান তিনি। 

এদিকে, লক্ষ্মীপুর শহরের মদিন উল্ল্যাহ হাউজিংয়ের পাশের ফিরোজা টাওয়ারে যে স্থানে সজীবের মৃতদেহ পাওয়া যায় তার একটি সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে। সে ফুটেজে দেখা যায়, ১৮ জুলাই তারিখ ৪টা ২১ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের দিকে ২ জন নারী, ৫ জন পুরুষ বাহিরের দিকে কিছু একটা দেখতে ছিলেন। কয়েক সেকেন্ড পর পাশের একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে ৩ যুবককে বাহিরের দিকে দৌড়ে যেতে দেখা যায়। এর কিছু সময় পর আরেকটা বাস ভবন সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত অপর আরেকজন এসে তাদের সাথে এসে বাহিরের হৈচৈ দেখতে ছিল। কিছুক্ষণ পর সবাই মিলে গেটের দিকে যাচ্ছিল। এ সময় বাহির থেকে সাদা গেঞ্জি পরা একজন যুবক দৌড়ে এসে পাশের একটি ভবনে প্রবেশ করেই গেট আটকে দেয়। তারপর ওই ভবনের সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। এরপর ভবনের ২য় তলার রুমের গলিতে গিয়ে প্রথমে বসে পড়ে। এরপর ওঠে পকেট থেকে ফোন বের করে কিছু বলতে চায়। তখন তার গেঞ্জিতে প্রচুর রক্ত দেখা যায়। এরপর সে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার ওঠে বসে। এরপর মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পর পাশের একটি বাসা থেকে একজন লোক বের হয়ে পাশের আরেকটি রুমের কলিং বেল টিপে। এ সময় তার পিছনে একজন নারীও দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর নারী-পুরুষ ২ জন মিলে ওই যুবককে কিছু একটা দিয়ে সহযোগীতা করতে চায়। ততক্ষণে সিসিটিভির ফুটেজ দেখে তাকে মৃত মনে হয়।

অন্যদিকে বুধবার (১৯ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ বলেন, সজীব সংঘর্ষে মারা যাননি। বিএনপি নেতাকর্মীরা যে স্থানে পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে, সজীবের মৃত্যুর স্থল ওই স্থান থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে। তার মৃত্যুর পর ৯৯৯-এ একটি কল আসে। পুলিশ বিএনপির নৈরাজ্য ঠেকাতে ব্যস্ত ছিল। পরে সেখানে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) রাতে লক্ষ্মীপুরের গোডাউনরোড এলাকার নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। কৃষকদল নেতা সজীব হোসেন নিহতের ঘটনায় বিএনপি দেশব্যাপী কর্মসূচি দেবে বলে জানান তিনি।

বুধবার লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট হাছিবুর রহমান জানায়, বিএনপির সহযোগী সংগঠন কৃষকদলের কর্মী মোঃ সজীব হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার জেলা বিএনপি কালো ব্যাচ ধারণ কর্মসূচী ঘোষণা করেছে এবং বিকেলে কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির বাস ভবনে প্রতিবাদ সভা করবে। 

তিনি আরও জানান, জাতীয় কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে সজীব হত্যার শিকার হয়েছে। এখন জাতীয়ভাবে যে নির্দেশনা আসবে জেলা বিএনপি সেটা পালন করবে।

স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) বিকেলে বিএনপির পদযাত্রা চলাকালে শহরের সামাদ মোড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় সজীবকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়। তিনি দৌড়ে কলেজ সড়কের মদিনউল্যা হাউজিংয়ের পাশের ফিরোজা টাওয়ারের একটি ভবনে আশ্রয় নেন। সেখানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। অন্য দিকে শহরের রামগতি সড়কের আধুনিক হাসপাতালের সামনে, ঝুমুর সিনেমা হল, মটকা মসজিদ এলাকায় সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশসহ শতাধিক লোক আহত হন। 

লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন তার বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, নিহত সজীব একজন সাধারণ পথচারী ছিল। সে কোন রাজনৈতিক স্পটে ছিল না এবং সে কোন রাজনৈতিক কর্মী নন। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত না।

লক্ষ্মীপুরের এসপি মাহফুজ্জামান আশরাফ বলেন, চিকিৎসকের দেওয়া তথ্য মতে, তার বাম হাতে দুটি কোপের দাগ ছিল। রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। ব্যক্তিগত কাজে সজিব শহরে এসে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে মারা যান।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭