ইনসাইড থট

স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইনে কার সুরক্ষা হচ্ছে?


প্রকাশ: 26/07/2023


Thumbnail

'স্বাস্থ্য সেবা সুরক্ষা আইন ২০২৩' এর খসড়াটি বার বার পড়লাম। কিন্তু কাকে সেবা দেয়া হচ্ছে আর কার সুরক্ষা করা হচ্ছে, তা ঠিকমত বুঝতে পারলাম না। প্রত্যেক আইনের একটা লক্ষ্য উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু এই আইনের শুরুতে লক্ষ্য উদ্দেশ্যের কোন বিশদ বিবরণ না থাকায় শিরোনাম দেখে যা বোঝার তাই বুঝতে হচ্ছে। প্রস্তাবিত এই আইনের খসড়ার শিরোনামে ব্যবহৃতস্বাস্থ্য সেবাশব্দদ্বয় বিভ্রান্তিকর। স্বাস্থ্য সেবার পরিধি অনেক বড়। সেখানে যেমন রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারটা অন্তর্ভুক্ত, তেমনি রয়েছে চিকিৎসা সেবাসহ আরো অনেককিছু। অথচ আইনটিতে 'স্বাস্থ্য সেবা' সংজ্ঞাতে বলা হয়েছে, 'রোগীর রোগ নিরাময়ের লক্ষ্যে চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত সকল ধরণের সেবা' স্বাস্থ্য সেবার নামে এই আইনে সম্ভবত চিকিৎসা সেবার কথা বলা হয়েছে, যেটাও অসম্পূর্ণ। চিকিৎসা সেবা বলতে বুঝি জনগণের স্বাস্থ্য খারাপ হলে যোগ্য কারো দ্বারা প্রদত্ত সেবা কারা সেবা দেয় ? তিনি চিকিৎসক হতে পারেন। হতে পারেন মেডিকেল এসিট্যান্ট, প্যারামেডিক বা মিডওয়াইফ বা নার্স। অথচ এই আইনে সব দায় কেবলমাত্র চিকিৎসকের। 

উন্নত দেশে যখন কোন মহিলা গর্ভবতী হয়, তখন প্রথমদিন তাঁকে দেখেন একজন মিড্ ওয়াইফ। ডায়াবেটিস হলে প্রথমদিন তাঁকে দেখেন নার্স এডুকেটর। তার মানে ওই প্রসূতি প্রথমদিন কোন স্বাস্থ্য সেবা পেলেন না ? ওই ডায়াবেটিসের রোগী প্রথমদিন কোন স্বাস্থ্য (চিকিৎসা) সেবা পেলেন না? 'স্বাস্থ্য সেবা গ্রহীতা' সংজ্ঞায় বলে হয়েছে, স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন ব্যক্তি। তার মানে দাঁড়ালো, চিকিৎসক ছাড়া কেউ স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারে না। এখানে তো গোড়াতেই গলদ। যিনি বা যাঁরা খসড়াটি লিখেছেন, তারা হয়তো বিষয়টা এভাবে বিবেচনা করেন নি।

কার সুরক্ষা হয়েছে এই খসড়া আইনে? রোগীর সুরক্ষা হয়েছে কি? হাসপাতালে গেলেই একজন রোগী যে একটি বিছানা পাবেই, সে সুরক্ষা কি এই আইনে আছে? সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হবার পর ওষুধ কিনতে সামনের ফার্মাসিতে যেতে হবে না, সেকথা আইনের কোথাও বলা হয়েছে? একজন চিকিৎসকের কাছে গেলে রোগী তাঁর সাথে ন্যূনতম দশ মিনিট বা পনেরো মিনিট রোগ নিয়ে কথা বলতে পারবে, সে সুরক্ষা আইনে কোথায় রয়েছে? রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রোগী প্রতি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে ন্যূনতম পনেরো মিনিট জেনারেল প্রাক্টিশনার পর্যায়ে ন্যূনতম দশ মিনিট নির্ধারণ করলে রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত হত, সুরক্ষা নিশ্চিত হত। ঘন্টায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সর্বোচ্চ চারজন রোগী দেখতে পারবেন। বিশজন রোগী দেখতে হলে উক্ত চিকিৎসককে পাঁচ ঘন্টা রোগী দেখতে হবে। ধরণের আইন করা গেলে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে রোগীদের সময় প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়, রোগীদের অধিকার সুরক্ষা হয়। 

স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা হয়েছে? এক কথায়, না হয়নি। স্বাস্থ্য কর্মীদের আবাসন, পরিবহনের উল্লেখ নেই কোথাও। কর্মস্থলের সুরক্ষা নেই। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আবাসন পরিবহনের অপরিহার্যতা উপেক্ষা করার কোন অবকাশ নেই। স্বাস্থ্য কর্মী কর্মস্থলে নিগৃত হলে সে অপরাধকে জামিনযোগ্য আপসযোগ্য করা হয়েছে। স্বাস্থ্য কর্মী  নিগৃত হলে এতদিন এলাকার 'বড় ভাই'রা 'হ্যান্ডশেকের' ব্যবস্থা করে দিতেন।  এখন সেটা আইনি ভিত্তি পাচ্ছে। আইনের মাধ্যমে 'বড় ভাই' দের অধিকার সুরক্ষা পাবে। সন্ত্রাসীরা সুরক্ষা পাবে। অথচ আমরা তো চাই, চিকিৎসা সেবা প্রদানের প্রতিটি স্থানে, হোক তা হাসপাতাল-ক্লিনিক বা চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বার, সবখানেই সন্ত্রাসের প্রতি শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করা হোক। সে কথা চিকিৎসা সেবাদান কেন্দ্রে স্পষ্টাক্ষরে লেখা থাক। যারা সন্ত্রাস করবে, তাকে আইনত শাস্তি পেতে হবে। আইনে অপরাধের মাত্রানুযায়ী শাস্তির বিধান থাকতে হবে। প্রস্তাবিত আইনে যেভাবে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। এটি আরো কঠোর সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত হতে হবে। 

খসড়া আইনটির অবতরণিকায় একটি যুগপোযোগী আইন প্রণয়নের অত্যাবশ্যকীয়তার কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার এই আইনটি যুগপোযোগী হয়েছে কিনা সেটি জানতে বর্তমান যুগে আমাদের আশেপাশের দেশের দিকে তাকানো প্রয়োজন। কারণে অকারণে আমরা মেডিকেল ট্যুরিজমের নামে সিঙ্গাপুর বা নিদেনপক্ষে ভারত যাচ্ছি। যাঁরা সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যান, তাঁরা দেখে থাকবেন সেদেশের হাসপাতালের সকল ওয়ার্ডে একটি বড় পোস্টার টাঙানো রয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে, "আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে অসদাচরণ করবেন না। রোগিকে উত্তম সেবা প্রদানের জন্য আমাদের একটি নিরাপদ পরিবেশ দিন। হয়রানি থেকে সুরক্ষা আইন ২০১৪ এর ধারার অধীনে, স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের নির্যাতন করা একটি অপরাধ।" হয়রানি থেকে সুরক্ষা আইনের ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোন অশ্লীলতা, হুমকি, আপত্তিজনক বা অপমানজনক শব্দ বা আচরণ করলে বা যোগাযোগ তৈরী করলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শাস্তির পরিমান বাংলাদেশী টাকায় চার লক্ষাধিক। সেখানে কিন্তু কোন আপস বা হ্যান্ডশেক করে কোমল পানীয় বা চা মিষ্টি খাওয়ানো হয় না। গেল বছর সেদেশে এক রোগী একজন নার্সকে লাথি মারে।  উক্ত রোগীকে সপ্তাহের জেল খাটতে হয়েছিল। স্বাস্থ্যকর্মী মার খেলে আপস হবার সুযোগ থাকাবস্থায় কার সুরক্ষা হচ্ছে সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। 

মেডিকেল ট্যুরিজমে আমাদের আরেকটি দেশ হচ্ছে ভারত। সেদেশের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের চিকিৎসা আমাদের পছন্দ। দক্ষিণ ভারতের কেরালার কথাই ধরা যাক।  সেখানে কথার মাধ্যমে আক্রমণ করলে সেটি -জামিনযোগ্য -আপসযোগ্য অপরাধ। অপরাধীকে ন্যূনতম ৫০ হাজার রুপি জরিমানা গুনতে হয়, অথবা সর্বোচ্চ দু বছরের জেল। আর যদি স্বাস্থ্য কর্মীকে মারাত্মকভাবে জখম করা হয়, তার শাস্তি এক থেকে পাঁচ লক্ষ রুপি জরিমানা অথবা সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল। থানায় এফ আই আর করার জন্য গেলে এক ঘন্টার মধ্যে সেটি গ্রহণ করতে হবে। যদি কোন পুলিশ অফিসার সেটি না করেন তবে তিনি শাস্তি পাবেন। ধরণের অপরাধে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে বিচার পর্ব শেষ করার জন্য কেরালার প্রাদেশিক সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে গত মে মাসে। ওই অধ্যাদেশে এও বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য কর্মী নিগৃত হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মামলা রুজু করবেন। 

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপের কথাই ধরা যাক। স্বাস্থ্য কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সেখানে একটি ফৌজদারি অপরাধ। ভারত সরকার ২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সংক্রান্ত আইনটির সংশোধনী এনেছে। স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এখন সেখানে আমলযোগ্য এবং -জামিনযোগ্য অপরাধ। এই ধরনের সহিংস কাজ করার জন্য বা প্ররোচনা দিলে তিন মাস থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার থেকে দু লক্ষ রুপি জরিমানা হবে   গুরুতর আঘাতের ক্ষেত্রে, ছয় মাস থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং এক লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ রুপি জরিমানা হবে   উপরন্তু, অপরাধী ক্ষতিপূরণ এবং সম্পত্তির ক্ষতির জন্য ন্যায্য বাজার মূল্যের দ্বিগুণ দায়বদ্ধ থাকবে।

পার্শবর্তী দেশ নেপালে গতবছর একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সেদেশে ফৌজদারি -জামিনযোগ্য অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। লঘু অপরাধে ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার রুপি মারাত্মক অপরাধে লক্ষ থেকে লক্ষ রুপি জরিমানা দুই থেকে পাঁচ বছর জেল এর বিধান রাখা হয়েছে। 

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর সহিংসতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে পার্শবর্তী দেশ থেকে শুরু করে বিশ্বের অন্যান্য দেশ স্বাস্থ্য কর্মী সুরক্ষার আইনগুলো যুগপোযোগী করেছে গত তিন থেকে চার বছরে। প্রস্তাবিত আইনটি আদৌ যুগপোযোগী তো নয়ই, বরং আইনটি পাঠকালে আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটি নিদেনপক্ষে পাঁচ থেকে দশ বছর আগে প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমান যুগের কোন ছাপ এখানে পড়েনি, যুগোপযোগী নয়। 

রোগীর সুরক্ষা নেই। স্বাস্থ্য কর্মীর সুরক্ষা নেই। তবে কি সরকারের সুরক্ষা রয়েছে? বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে। স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছে। কোথাও নেই এসব কথাবার্তা। পুরো খসড়াটি তন্ন তন্ন করে একটি মাত্র 'ডিজিটাল' শব্দ খুঁজে পেয়েছি। ডিজিটাল রেজিস্টার এর কথা বলা হয়েছে। ব্যাস। শেষ। স্বাস্থ্য সেবায় একটি ডিজিটাল রেজিস্টারই কি ডিজিটাল বাংলাদেশএকটি ডিজিটাল রেজিস্টারই কি স্মার্ট বাংলাদেশ? পেপারলেস হাসপাতাল, এপ্স ভিত্তিক স্বাস্থ্য সেবা, টেলিমেডিসিন, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, কলমবিহীন চিকিৎসক - এসবের কোন বালাই নেই প্রস্তাবনায়। এসব ধ্যান ধারণা আগামীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করার সক্ষমতা রাখে, সেটিও চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে প্রস্তাবনায়। আপনাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে, বর্তমানে আমরা বিদেশে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকালে আমাদের কোন কলম ব্যবহার করতে হয় না।  এটির ব্যবহার শুধু ব্যক্তিগত  আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করতে প্রয়োজন হয়, সেটিও অদূর ভবিষ্যতে আর লাগবে না। বর্তমান সরকার বারবার অটিস্টিক বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের চিকিৎসা বা সামাজিকরণের কথা বলছে। তাদের কথা কোথাও নেই এই প্রস্তাবনায়???   

খসড়া আইনটিতে সরকারকে বিপাকে ফেলার উপকরণও রয়েছে। উদাহরনস্বরূপ একজন রোগীর জন্য  ন্যূনতম ১০০ বর্গফুট জায়গা নিশ্চিতকরনের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।  এই আইন পাসের সাথে সাথে দেশের প্রায় সকল হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হবে বা আইন অমান্য করে পরিচালিত হতে হবে। একজন রোগীর জন্য কত বর্গফুট জায়গা বরাদ্ধ করতে হবে সেটির কোন বিশ্ব স্বীকৃত বিধান নেই।  তবে 'রুল অফ থাম্ব' (প্রচিলত নিয়ম) বলে একটা কথা রয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, ৭৫ থেকে ১০০ বর্গফুট। ঢালাওভাবে ১০০ বর্গফুটের বিধান না করে অঞ্চল ভিত্তিক বিন্যাস করা যায়। একটি থানা পর্যায়ে ১০০ বর্গফুট স্থান সহ হাসপাতাল করলে সেখানে চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাবে। এখানেও রোগীর সুরক্ষা নেই। 

তাহলে, স্বাস্থ্য সেবা সুরক্ষা আইনে সুরক্ষা হচ্ছে কার? ইতিমধ্যে চিকিৎসকদের অনলাইন ভিত্তিক সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস এ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর) প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য সেবা সুরক্ষা আইন, ২০২৩ (খসড়া) বাতিলপূর্বক জনবান্ধব আধুনিক যুগোপযোগী আইন দাবি করেছে।এফডিএসআরের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত এই আইনটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে ইতিমধ্যে দেখানো হয়েছেএই আইনটা কতটা গণবিরোধী এর মাধ্যমে চিকিৎসক দমনের অবকাশ রয়েছে। এখানে মফস্বল শহরে গড়ে ওঠা ক্লিনিকসমূহের বাস্তবতা আদৌ বিবেচনায় নেওয়া হয় নি। এই আইনের বাস্তবায়ন হলে দেশের বড় হাসপাতালগুলোও  আইন মেনে টিকে থাকবে কি না সন্দেহ! এর মধ্য দিয়ে বেসরকারী স্বাস্থ্যখাতকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নবীন চিকিৎসকদের জন্য চেম্বার প্রাক্টিস দুরূহ করে তোলা হয়েছে। 

অনেক গুরুত্বহীন, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ও এই প্রস্তাবিত খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন অফিস চলাকালিন কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি কিংবা সরকারী হাসপাতালে ডিউটিরত অবস্থায় বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা করতে যাওয়া। এটা তো নিঃসন্দেহে অনাকাঙ্খিত এবং অনুচিত কাজ। কিন্তু এর জন্য তো নতুন করে আলাদা আইন করবার দরকার নাই। বিদ্যমান চাকুরির আইনেই এটা অন্যায়। তারপরেও যদি এটা ঘটে এবং এর বিরূদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, সেটা তো ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। সামগ্রিকভাবেই স্বাস্থ্যখাতে ব্যবস্থাপনার সংকট রয়েছে, সেটি যথাযথভাবেই সমাধান করা উচিত। 

 

প্রস্তাবিত এই আইনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে বিদেশি চিকিৎসকরা বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারবে। এর মাধ্যমে বিদেশের যে কোন মানের চিকিৎসকদের অবাধ অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হবে। অথচ বাংলাদেশের কোন ডাক্তার চাইলেই কি বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে পারবে? সেসব দেশে রোগী দেখতে হলে সুনির্দিষ্ট পরীক্ষায় পাশ করতে হয়, কিংবা স্বীকৃত ডিগ্রীধারীরা বিশেষ বিবেচনায় সীমিত পরিসরে রোগী দেখতে পারে। বিদেশি ডাক্তারের চিকিৎসা প্রদানের অনুমোদন দেবে বিএমডিসি, এটা তো মন্ত্রণালয়ের কোন কাজ হতে পারে না। 

চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমে কোন ডাক্তারই ইচ্ছাকৃতভাবে রোগীর ক্ষতিসাধন করতে চায় না। অনেক সময় চিকিৎসকের চেষ্টা সত্বেও রোগীর অসুখের কাঙ্খিত নিরাময় হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকের অবহেলা থাকতে পারে, অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে পারে। কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো কারো ক্ষেত্রে আবার পেশাগত অসদাচরণও লক্ষ্য করা যায়। বিএমডিসির মাধ্যমেই এসবেরই প্রতিকার পাওয়া যায়। বিএমডিসিই নির্ধারণ করবে কোনটা অনিচ্ছাকৃত ভুল, কোনটা অবহেলা আর কোনটা পেশাগত অসদাচরণ। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনে মামলা হতে পারে। 

চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগীর মৃত্যু হলে ওমনি ভুল চিকিৎসা বলে চিকিৎসককে গ্রেফতার করা তো প্রত্যাশিত নয়।  চিকিৎসা করা তো ফৌজদারি অপরাধ হতে পারে না। এই আইনে মোবাইলে কোর্টকেও শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, যা মেনে নেওয়া যায় না। কোন বেসরকারী ক্লিনিক বা হাসপাতাল ঠিকমত কাজ করছে কি না তার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং সিভিল সার্জনদের কার্যালয় রয়েছে। তারাই এসব দেখভাল করবে। প্রয়োজনে বিএমডিসিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটি দেখে একজন আইনজীবী বললেন, ‘এই আইনে জনগণ এবং ডাক্তাররা ছাড়া বাকি সবাই উপকৃত হবে। ডাক্তার পিটানো আপসযোগ্য হওয়ায় এলাকার সন্ত্রাসীদের পোয়া বারো। এটা আদৌ সুলিখিত কোন আইন নয়।বাস্তবতা হলো, স্বাস্থ্য সেবা আইনের সাথে স্বাস্থ্যকর্মী সুরক্ষা আইন গুলিয়ে ফেলে লাভ নাই। এতে বরং একটা হযবরল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। বরং জনগণের চিকিৎসার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে আলাদাভাবে স্বাস্থ্যকর্মী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হোক। স্বাস্থ্য সেবা, চিকিৎসা সেবা এবং বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিচালনার জন্য  বরং স্বতন্ত্র আইন হোক। আর যোগ্য, অভিজ্ঞ লোকদের দিয়েই এই আইনটি প্রণয়ন করা হোক। এতে দেশ, জাতি এবং সরকারই লাভবান হবে। 

দেড় থেকে দুই দশকের প্রবাস জীবনে আমরা এর আগে নবীন চিকিৎসকদের কাছ থেকে বিদেশে চলে যাবার ব্যাপারে এত আগ্রহ কখনো দেখি নি। দেশের বর্তমান অবস্থায় তরুণ ডাক্তাররা নিরাপদ বোধ করছেন না। তারা যে কোন উপায়েই দেশ ছাড়তে চায়। এটা ভালো লক্ষণ নয়। এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন এক নবীন চিকিৎসক ফোন করে বললেন, ‘ভাই, চিকিৎসক দমনের লক্ষ্যে তৈরি করা প্রস্তাবিত এই আইনটা পারলে ঠেকান।আমরা রসিকতা করে বললাম, ‘কেন, ভালই তো হইছে, আইন পাশ হলে আপনারা সুরক্ষা পাবেন।উত্তরে ছোট ভাইটি বললো, ‘ভাই, ভিক্ষা চাই না কুত্তা ঠেকান।

 

লেখকঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন, চেয়ারম্যান, এফডিএসআর, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী চিকিৎসক

বি এম কামরুল হাসান, ব্রুনাই প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭