লিট ইনসাইড

পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি (পর্ব-১)


প্রকাশ: 01/08/2023


Thumbnail

শুরু হলো শোকাবহ আগস্ট মাস। মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আগস্ট ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে অধ্যাপক . সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সারা জাগানো বইপিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছিএর ধারাবাহিক পর্বের প্রথম পর্ব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।

 

পিতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, এতদনি আমাদের অনেকেরই দৃষ্টি ঝাপসা ছিল। যতদিন যাচ্ছে, ধীরে ধীরে আমাদের দৃষ্টি স্বচ্ছ হচ্ছে। হ্যাঁ পিতা সবকিছুতেই বড় বেশি সময় লাগে। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সঠিক বিষয়গুলোতে সময় বেশি লাগলেও ভুল বোঝার জন্যে, কোনো সময়ের প্রয়োজন হয় না।

বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার প্রায় উনিশ বছর পর, ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ঢাকার একটি পত্রিকা অফিসের নিজ অফিসকক্ষে বসে স্বগতক্তি করলেন পত্রিকার সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাঁর মনে পড়ে গেল। চাকরিকালীন অবস্থার কিছু ঘটনা। তিনি সেই অতীতের কথা রোমন্থন করা শুরু করলেন। ১৯৭৪ সাল। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির সঙ্গে অতিবিপ্লবীরা হাত মিলিয়েছে। তারা বিভিন্ন কায়দায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতি ঘটাতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সাধারণ মানুষকে বাঁচাবার জন্যে, দেশের স্বাধীনতাকে সুসংহত করার জন্যে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্যে তৎপর হওয়ার আদেশ দিলেন সময় পার হতে থাকে। কিন্তু প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে ধরা সম্ভব হল না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রায় সকলেই জাতির পিতার কাছে আবেদন। জানান আরও কঠিন আইন প্রণয়নের। এর পরই বঙ্গবন্ধু বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন অনুমোদন করলেন, যাতে করে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বাঙালিরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে, রাস্তায় স্বচ্ছন্দে হেঁটে বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে। কিন্তু দিনের পর দিন গেল। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এল না। দুষ্কৃতকারীদের স্বর্গরাজ্যে কাজকর্ম কোনো বাধাপ্রাপ্ত হল না। বঙ্গবন্ধু তখন নির্দেশ দিলেন, যারা দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রাক্ষার। কাজে কোনো না কোনোভাবে নিয়োজিত, তাদেরকে অবশ্যই কঠিন হতে হবে। এজন্যে জাতির পিতা প্রতিদিনই চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। উপদেশ দিতে থাকেন। এতে কাজ হল। বঙ্গবন্ধুর চাপের ফলে অনেক দুষ্কৃতকারী ধরা পড়ল। কিন্তু তাদের পরিচয় পাওয়ার। পর বঙ্গবন্ধু তো অবাক। কারণ এসব ধরাপড়া দুষ্কৃতকারী আর কেউ নয়, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা। ধরা পড়া এসব দামাল ছেলেই একাত্তরে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং সকলেই দেশের স্বাধীনতার জন্যে কোনো-না-কোনোভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছে। এই ত্যাগ স্বীকার করতে গিয়ে অনেকের অবস্থা এমন হয়েছে, তাদের ক্ষে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকাও কঠিন। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। তিনি ইলার করে দেখলেন, শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা, যারা তাঁর আদর্শে বিশ্বাসী তারাই দুষ্কৃতকারী হয়ে গেল, অথচ আর কোনো দুষ্কৃতকারী নেই, এটা কেমন করে হয়। বঙ্গবন্ধুর মনে প্রশ্ন দীপল যে, টাইট দিতে বললে শুধুমাত্র তাঁর আদর্শে বিশ্বাসী মুক্তিযোদ্ধারা, কেন টাইট হয়। হলে বাকি দুষ্কৃতকারী কি রাতারাতি ফেরেস্তা হয়ে গেল? এর ফলে বাস্তব অবস্থায় দ্রুতকারীদের টাইট দেয়া বন্ধ হয়ে গেল। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও কোনো উন্নতি চোখে পড়ল না।

অতীত দিনের এসব স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে পত্রিকা সম্পাদক আবীর মনে সংশয় জেগে ওঠেতা হলে এসব কাজ নিশ্চয় বিচ্ছিন্নভাবে হয়নি। তিনি বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালে দেশে ফেরা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে আরে মনোযোগ দিলেন।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সূর্য তা হল। বাঙালি জাতি যেন আসল মুক্তির স্বাদ সেদিনই পেল। অনেকের মনোভাব নে মনে হল তাদের কাছে প্রকৃত বিজয় দিবস হচ্ছে দিনই। কেননা, ১৬ ডিসেম্বর দেখে ভূখণ্ড হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হলেও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মানুষের বে মুক্তির স্বাদ ছিল না। আর মুক্তির স্বাদ না পেলে তো বিজয়ের স্বাদ পাওয়া সম্ভব বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পর তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মাসের বি বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করার চেষ্টা করলেন। এমনি এক পর্যায়ে একদিন সকাল ১০টার দি হঠাৎ করে মুজিবকোট গায়ে দিয়ে গণভবনস্থ বঙ্গবন্ধুর অফিস কক্ষে ঢুকলেন খোন্দক মোশতাক আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করমর্দন করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে একথা সেক বলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী সরকারের কিছু ঘটনার কথা তিনি বর্ণনা করে চললো। বঙ্গবন্ধু নিবিষ্ট মনে সবকিছু শুনতে থাকলেন। সুযোগ বুঝে খোন্দকার মোশতাক বলে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করার জা বঙ্গবন্ধুর মেজো ছেলে শেখ জামাল গিয়েছিল। কিন্তু তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেও জান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়নি। সুচতুর মোশতাক ইনিয়ে বিনিয়ে এমনভা ঘটনা বর্ণনা করলেন, হাত ব্যস্ততার কারণেই তাজউদ্দিন সাহেব জানালের সঙ্গে দে করতে পারেননি। কিন্তু আফটার অল জামাল তো জাতির জনকের ছেলে। এটি যাওয়া কারো জন্যেই বোধহয় উচিত নয়। এরপর মোশতাক বঙ্গবন্ধুর জন্যে যে কত কি করেছেন, তার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে অঝোরে চোখের পানি ফেলতে শুরু করেন। বঙ্গব একদৃষ্টে তাকিয়ে চোখের সেই পানিপড়া দেখতে থাকেন। চোখের পানি আর থামে না কিছু সময় চলে যেতে বঙ্গবন্ধুর মনটাও হাহাকার করে ওঠে। তিনি তাঁর আসন ছেড়ে এলেন এবং মোশতাকের পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, এসব কথা আলোচনার প্রয়োজন নেই।

বঙ্গবন্ধু মোশতাককে জানান যে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অধিকাংশ তথ্য তিনি পেয়েছেন। পিঠে বঙ্গবন্ধুর হাতের স্পর্শ লাগায় সাপের মাথায় তাবিজ পড়লে সা যেমন আপনা-আপনি মাথা নুইয়ে ফেলে, ঠিক তেমনিভাবে খোন্দকার মোশতাক শান্ত গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখের পানি মুছে তিনি বঙ্গবন্ধুর গণভবনের অফিসকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পর বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পেতেন না। জাতির জন্য হিসেবে, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে নানাভাবে ব্যস্ত থাকতে হত। এই বাস্তবতার মাঝেই একদিন তার অফিসকক্ষে জাতীয় স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু ফাইল তিনি দেখতে শুরু করলেন। মাসের যুদ্ধের ফলে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। কিভাবে এই মেরুদণ্ডকে আবার ঠিক করা যায়, সে চিন্তাই তখন বঙ্গবন্ধুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ফাইল দেখতে দেখতে হঠাৎ করে তাঁর মনে পড়ল, সেদিনকার এক বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের কথা। পত্রিকাটি বঙ্গবন্ধু হাতে করেই তার অফিস কক্ষে এসেছিলেন। পত্রিকাটি চোখের সামনে মেলে ধরে রিপোর্টটি আবার পড়লেন। তাতে এই আশয্যা প্রকাশ করা হয়েছে যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বাস্তব অবস্থার কারণেই লক্ষ লক্ষ বাঙালি অনাহারে মৃত্যুবরণ করবে। এদের সংখ্যা মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনি তার সহযোগীদের হাতে নিহত ৩০ লক্ষ বাঙালির চেয়ে বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। খাদ্যের অভাবে সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন অসন্তোষ সৃষ্টি হবে, তেমনি আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যাদের হাতে অস্ত্র রয়েছে, তারা আর সরকারকে অস্ত্র জমা দেবে না। কেননা, এই হাতের অস্ত্র তাদেরকে খাদ্য জোগাড় করে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেবে। স্বভাবতই সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চাইবে না।

বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বঙ্গবন্ধু গভীর মনোনিবেশ সহকারে কয়েকবারই পড়লেন। এরপর গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো আবার দেখতে থাকেন। এরপর ফাইলগুলো জায়গা মতো ফেরত পাঠিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে তলব করলেন। প্রথমে এলেন গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রী। তিনি আসার পর বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে কক্ষে ঢোকার ব্যাপারে নিষেধ করে দেন। এরপর তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে দেশের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে একান্তে আলোচনায় বসলেন। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীটি সমস্যা সম্পর্কে যুক্তি সহকারে একের পর এক তাঁর বক্তব্য দিতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে পাইপ টানতে থাকেন এবং গভীর মন দিয়ে বক্তব্য শুনতে থাকলেন। মনে হল, কোনো কম্পিউটারে কিছু ইনফরমেশন এবং ডাটা ঢোকানো হচ্ছে। এদিকে আবার খাবারের সময় পেরিয়ে তোল। কারো সাহস হল না বঙ্গবন্ধুকে খাবারের কথা মনে করিয়ে দিতে। বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্য শোনার পর বেলা তিনটার দিকে বঙ্গবন্ধু তাঁর অফিসকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। এরপর গণভবনের দোতলায় বিশ্রামকক্ষে গিয়ে তাঁর জন্যে রক্ষিত খাবারের দিকে একবার তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তারপর কি যেন ভাবতে থাকলেন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭