লিট ইনসাইড

পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি (পর্ব-৩)


প্রকাশ: 03/08/2023


Thumbnail

শুরু হলো শোকাবহ আগস্ট মাস। এ মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আগস্ট ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সারা জাগানো বই ‘পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি’ এর ধারাবাহিক পর্বের  তৃতীয় পর্ব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।


১৯৭৩ সাল। ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের একটি কক্ষ। দুজন ছাত্র নিজেদের মধ্যে দেশের রাজনীতি—বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে। এ দুজন ছাত্রই মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করেছে এবং তারা কোনো পক্ষই অবলম্বন করেনি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ বহুবার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুবাদে তারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে বেশ গুরুত্ব সহকারে পরিচিতি লাভ করল। শুধু তাই নয়, তখনকার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে দ্বিধা-বিভক্তির সুযোগে ঐ সংগঠনের বিশিষ্ট নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে তাদের কোনো অসুবিধা হল না। তারা মুজিববাদী ছাত্র লীগের উপরের পর্যায়ের নেতা হওয়ার সুবাদে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বেডরুম পর্যন্ত অবাধে যাওয়া-আসার সুযোগ পেল। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে ছাত্র লীগের বিপথগামী অংশটি এমন সব হঠকারী পদক্ষেপ নিচ্ছিল যে দেশের স্বার্থেই তা ঠেকানোর জন্যে এই ছাত্রনেতাদ্বয়, অর্থাৎ শফিকুল হক ও আব্দুল করিম এত গুরুত্ব লাভ করল যে শুধুমাত্র সাধারণ ছাত্ররাই নয়, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও তাদেরকে সমীহ করে চলত।

সূর্য সেন হলের কক্ষে বসে শফিকুল হক তার সঙ্গীকে বলে যাচ্ছিল যে স্বাধীন দেশের সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী আবদুর রহমানের সঙ্গে তার কি কি কথা হয়েছে এবং ছাত্র লীগের অভ্যন্তরে অবস্থান করে তাদেরকে কিভাবে কাজ করতে হবে, সে বিষয়ে একটা দিকনির্দেশনাও পেয়েছে। শফিকুল হকের এখন প্রধান দায়িত্ব হল, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা, যাতে দেশের নাগরিকেরা বর্তমান সরকারকে, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে একজন অপদার্থ শাসক হিসেবে ভাবতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর অনেক নিকটের লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে শফিক নিশ্চিত হয়েছে যে তাদের গোপনে গোপনে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও অনেক কাজই প্রকাশ্যে চালিয়ে যেতে পারবে। শুধু লক্ষ রাখতে হবে যে বঙ্গবন্ধুর নিকটজনেরা যাতে শফিকুল হকদের আসল উদ্দেশ্য ধরতে না পারে। অন্যদিকে আবদুর রহমানও শফিককে নিশ্চিত করেছে যে তারা যদি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ মাত্র দু-একজন লোকের আস্থাভাজন হতে পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনায়াসে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। আর এ কাজ করতে গিয়ে তারা বেগতিক অবস্থায় পড়লে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ লোকেরাই তখন তাদেরকে বাচানোর জন্যে পাগল হয়ে যাবে। শফিকুল হকের মুখে এসব কথাবার্তা শুনে তারই বিশ্বস্ত সহযোগী আবদুল করিম খুবই আশ্বস্ত হল।

ষড়যন্ত্রকারীদের দাবার জুটি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিববাদী ছাত্র লীগের ব্যানারে অবস্থানকারী শফিকুল হক ও তার সহযোগীরা নিজেদের মধ্যে গোপন শলাপরামর্শের পর মুহসীন হলের কয়েকজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করল। এ ধরনের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর শফিকের বিরুদ্ধে আইনগত সঠিক ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হল এক পর্যায়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা শফিককে তাদের জিম্মায় নিতে সক্ষ হল ঠিকই, কিন্তু এরই মধ্যে সাধারণ জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধু সরকারের ভাবমূর্তি যেভাবে ক্ষুণ্ণ হল, তা ছিল অপূরণীয়।

ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যাকাণ্ডের জন্য এমন সময়কে বেছে নিয়েছিল, যখন ঝাকা চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশের বাইরে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ষড়যন্ত্রকারীদের কাজের সবচে সুবিধা হয়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে কোনো সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তার অনেক সহকর্মীই পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাকে খুবই জরুরি মনে করলেও নির্দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর অপেক্ষায় থাকে। এর বিপরীতে আবার দেখা যায়, নিজস্ব প্রয়োজনের সময় বঙ্গবন্ধুর অনেক সহকর্মীই নেতার নির্দেশ বা অনুমতির অপেক্ষায় থাকত না। তখনকার অবস্থা দেখে মনে হত যেন কোনো ভালো কাজ করতে দেরি হয়ওার প্রধান কারণ হল বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সময়মতো নির্দেশ না পাওয়া।

আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনের অফিসে বসে দুজন প্রথম সারির নেতা রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে গিয়ে খুব গলা উচিয়ে ঝগড়া শুরু করলেন। এত বড় মাপের দুই নেতাকে এভাবে প্রকাশ্যে ঝগড়া করতে দেখে অফিসে উপস্থিত সাধারণ কর্মীরা বিস্মিত হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু কোন নেতার পরামর্শকে বেশি গুরুত্ব দেন এ নিয়েই দুজনের ঝগড়ার সূত্রপাত। সাধারণ কর্মীরা এই ঝগড়া দেখে ভুলেই গেল যে তারা পার্টির অফিসে এসেছিল বিশেষ বিশেষ দরকারে। যেমন একটি জেলা শহর থেকে এসেছিলেন আবুল হাশেম। জেলা পর্যায়ে সংগঠনের জন্য কি কি অসুবিধা বা সমস্যা রয়েছে সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতেই ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু আবুল হাশেম দুই কেন্দ্রীয় নেতার ঝগড়া দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি ঠিকই আছ রাখবেন, কিন্তু সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকবেন না। অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন গ্রহণ করাটাকেই তিনি শ্রেয় মনে করলেন। আবুল হাশেম তাঁর জেলা শহরে ফিরে গিয়ে ঠিকই রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়লেন। এর ফলে তাঁর এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ৭১-এর খুনী নারী ধর্ষণকারী আবদুল মোতালেব ধীরে ধীরে সক্রিয় হয় ওঠে এবং নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করার সুযোগ পায়।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭