প্রকাশ: 06/08/2023
শুরু হলো শোকাবহ আগস্ট মাস। এ মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আগস্ট ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সারা জাগানো বই ‘পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি’এর ধারাবাহিক পর্বের ষষ্ঠ পর্ব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
ঢাকার
একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। এই ব্যক্তি স্বাধীনতার
আগে এক অবাঙালি। ব্যবসায়ীর
অফিসে কেরানি ছিলেন। তবে এ চাকরির
সুবাদে তিনি ব্যবসার বিভিন্ন
খুঁটিনাটি বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করেন। যেমন
তিনি জানতে পারেন যে এলসি মার্কিন
বলতে কি বোঝায়, ব্যাংকের
বড় সাহেবদের কিভাবে খুশি রাখতে হয়
এবং তাদের খুশি। রাখতে পারলে ব্যাংক থেকে কি কি
সুবিধা পাওয়া যায়।
কলিমুল্লাহ
নামের এই ব্যবসায়ী মুক্তিযুদ্ধের
সময় সরাসরি পাকিস্তাীদের সহযোগিতা না। করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের
কোনোপ্রকার সাহায্য করেননি। জীবনের অনেক ঝুঁকি আছে
একথা জানা সত্ত্বেও তিনি
পাকিস্তানি মালিকেরর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তাঁর চাকরি চালিয়ে
গেছেন। মালিকের একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী
হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। তবে কলিমুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের
চূড়ান্ত পর্যায়ে, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১০
ডিসেম্বর হঠাৎ করে ঢাকা
ছেড়ে চলে যান এক
গ্রামে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন
যে কারণে তাঁর তখন সাংসারিক
জামেলা ছিল না। ১৬
ডিসেম্বরে ঢাকায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর রাস্তাঘাটের
অবস্থা খারাপ থাকায় শেষ পর্যন্ত কলিমুল্লাহ
১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় এসে পৌঁছেন। ধানমণ্ডি
এলাকায় গিয়ে তিনি তাঁর মালিকের
বাড়ি খুঁজে বের করেন এবং
সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেন। দুএকদিনের
মধ্যে কলিমুল্লাহ তাঁর কিছু বন্ধুবান্ধব
জুটিয়ে ফেলেন, যারা ১৬ ডিসেম্বর
ঢাকায় থাকার সুবাদে কিছু অস্ত্র হাতে
পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা বা ষোড়শ বাহিনীর
সদস্য সেজে বসেছে। তাদের
কয়েকজনকে তিনি ধানমণ্ডিতে তাঁর
কাছে এনে রাখেন। পাড়া-প্রতিবেশীরা জানতে পারে যে, কলিমুল্লাহ
ও তার বন্ধু-বান্ধবেরা
হল বীর মুক্তিযোদ্ধা। তারা
গালগল্পের মাধ্যমে পাকিস্তানি মিলিটারির বিরুদ্ধে কলিমুল্লাহর বহু বীরোচিত অ্যাকশনের
কথা শুনতে পায়। এমনকি একথাও প্রচারিত হতে থাকে যে
অবাঙালি বাড়িওয়ালা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোতাদের সহযোগিতা
করেছেন এবং কলিমুল্লাহ তাঁর
জামাই।
আসলে
কলিমুল্লাহ ঢাকায় এসে তাঁর মালিকের
বাড়িতে ওঠার দিন দশেক
পর মালিকের
একুশ বছরের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে
যায়। এরপর অবাঙালি ব্যবসায়ী।
মেয়েকে কলিমুল্লাহর সঙ্গে ঢাকায় রেখে নতুন জামাইয়ের
সাহায্যে সপরিবারে ভারত হয়ে পাকিস্তানের
উদ্দেশে পাড়ি জমান। অবশ্য কলিমুল্লাহ তাঁর শ্বশুরের দেশত্যাগের
আগে সমস্ত সম্পত্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
নিজের এবং তাঁর স্ত্রীর
নামে লিখিয়ে নিতে সক্ষম হন।
শুধুমাত্র কিছুটা ঝামেলা হয় স্টেডিয়ামের দোতলায়
তার শ্বশুরের অফিসটা দখল নিতে। তবে,
বন্ধুদের সহযোগিতা এবং টাকার জোরে
শেষ পর্যন্ত অফিসটির দখল নিতে তিনি
সিক্ষম হন। যদিও অফিস
দখলের এক পর্যায়ে তাঁর
বাঁ পায়ে এসে একটা গুলি
লাগে। পরে স্থানীয় মোসাহেব
বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে বেশ কায়দা করে
প্রচার করা হয় যে
হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি অপারেশনের সময়
একটি গুলি 'মুক্তিযোদ্ধা' কলিমুল্লাহা বাঁ পায়ে, লাগে।
এই প্রচারণার ফলে সমাজে কলিমুল্লাহর
দাম আর বেড়ে যায়।
স্বাধীনতালাভের
কয়েক বছর পর কলিমুল্লাহর
অফিসকক্ষ। সেখানে বাস কয়েকজন আড্ডা
দিচ্ছিলেন, এঁরা প্রত্যেকেই সমাজে
প্রভাবশালী। এমন সময় সেখানে
একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ এসে হাজির হলেন।
এদের প্রত্যেকেই জানেন যে দেশ স্বাধীন
হওয়ার পর কলিমুল্লাহ মনেপ্রাণে
পাকিস্তানি ভাবাপন্ন হয়ে গেছেন। এজন্যে
তারা অবশ্য কলিমুল্লাহকে দোষ দেন না।
আর যাই হোক, তাকে
অকৃতজ্ঞ বলা চলে না।
কেননা, তাঁর এই বড়লোক
হওয়া থেকে শুরু করে
সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় তার পেছনে
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির অবদানই সবচেয়ে বেশি, কেননা, তারা যদি বাংলাদেশকে
কুক্ষিগত করার চেষ্টা না
চালাত, তা হলে কলিমুল্লাহ
কি এভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ
হতে পারত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসকক্ষে যে রাজনীতিবিদ এসে
প্রবেশ করলেন, তিনি হলেন জনাব
আবদুল বারেক। তিনি একজন ছোট
মাপের মন্ত্রী হলেও তাঁর মন্ত্রণালয়
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানিদের একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি
তিনি, যে কারণে বঙ্গবন্ধু
সরকারকে শেষ করে দেয়ার
ষড়যন্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। কলিমুল্লাহ
স্বেচ্ছায় জনাব বারেককে তাঁর
সহযোগীদের নিয়ে নিভৃতে আলাপ-আলোচনা করার
জন্যে তাঁর অফিসের একটি
কক্ষ ছেড়ে দিয়েছেন এবং বিভিন্ন প্রকার
আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
জনাব
আবদুল বারেকের আগমনের পর যে বৈঠকটি
হয়, তাতে কলিমুল্লাহ নিজেও
উপস্থিত থাকেন। শুধু তাই নয়,
তাকে এই দায়িত্ব দেয়া
হল যে ব্যবসায়ী মহলে
তাঁকে একথা ছড়াতে হবে,
ভারত থেকে আমদানি করা
জিনিসপত্র অত্যন্ত নিম্নমানের। আর এ সকল
জিনিসপত্র তারা বেশি দামে
কিনে আনতে বাধ্য হচ্ছে
এ কারণে যে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর
স্ত্রী বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে আমদানিকারকদের উপর চাপ সৃষ্টি
করছেন। প্রস্তাটি শোনার পর কলিমুল্লাহ নিজেই
আবদুল বারেকের কাছে জানতে চান,
যেহেতু বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ব্যবসা কিংবা ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নন, কাজেই তাঁর
নাম ব্যবহার করলে কোনো অসুবিধা
হবে কিনা। তখন জনাব বারেক
কলিমুল্লাহকে বোঝালেন, ইতিমধ্যে সমগ্র দেশে বঙ্গবন্ধুর পরিবার
সম্পর্কে এমন অপপ্রচার শুরু
হয়ে গেছে যে, বেগম
মুজিবের নামে এ ধরনের
মিথ্যা অপবাদকে সত্য বলে চালানো
মোটেই কঠিন কাজ হবে
না। জনাব বারেক আর
জানান, বর্তমানে জনগণের দুঃখ-দুর্দশার জন্যে
বঙ্গবন্ধু পরিবারই দায়ী এ ধারণাকে অবশ্যই
জনগণের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করতে
হবে। এ কাজের জন্যে
যত অর্থের প্রয়োজন হোক না কেন,
তা জোগান দেয়া সম্ভব হবে। কলিমুল্লাহ একথা
শোনারা পর কেবল সন্তুষ্টই
হলেন না, বরং প্রস্তাব
দিলেন যে এ ধরনের
অপপ্রচারের জন্য যত টাকার
প্রয়োজন, সেটা তাঁর পক্ষে
একাই জোগান দেয়া সম্ভব। অর্থের জন্য কোনোপ্রকার ঝামেলা
যাতে না হয়, সেজন্য
ইতিমধ্যে তাঁর শ্বশুরের ফেলে
যাওয়া গুলশানের বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছেন। এই
বাড়ি বিক্রির কিছু টাকা শ্বশুরের
উদ্দেশ্যে পাচার করেছেন, কিছু টাকা নিজের
কাছে রেখেছেন। এ ছাড়া ব্যবসা
বাণিজ্যের মাধ্যমে কলিমুল্লাহর আয় তো আছেই।
সেদিনকার
বৈঠকে কলিমুল্লাহর সঙ্গে জনাব আবদুল বারেকের
বেশ সন্তোষজন আলাপ-আলোচনা হল।
সন্তুষ্ট চিত্তেই জনাব বারেক তাঁর
দুজন বিশ্বস্ত সহযোগীতে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭