লিট ইনসাইড

পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি (পর্ব-৯)


প্রকাশ: 09/08/2023


Thumbnail

শুরু হলো শোকাবহ আগস্ট মাস। এ মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আগস্ট ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সারা জাগানো বই ‘পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি’ এর ধারাবাহিক পর্বের নবম পর্ব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-

একটি পত্রিকার অফিস। সম্পাদকের কক্ষে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যাদের মধ্যে একজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতাও রয়েছে। পত্রিকার সম্পাদক তাদের উদ্দেশে বলে চলেছেন, কিভাবে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশ চালাতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিদেশি সাহায্য যা পাওয়া যাচ্ছে, সবই চোরাপথে ভারতে চলে যাচ্ছে। তিনি যুক্তিতর্ক সহকারে উপস্থিত শ্রোতাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এমন অরাজক পরিবেশ বজায় রাখা হচ্ছে, যাতে করে এদেশ থেকে লেখাপড়া চিরকালের জন্য উঠে যায়। সম্পাদক সাহেব দাবি করেন, সব কিছুই করা হচ্ছে ভারতের পরামর্শে। এজন্য প্রশাসনের সব গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে একজন করে ভারতীয় উপদেষ্টা রাখা হয়েছে। তবে এ উপদেষ্টাদের জনসমক্ষে আসতে দেয়া হয় না।

সম্পাদকের মুখে এসব কথা শোনার পর ছাত্রনেতাটি আর চুপ থাকতে পারল না। সে জানায় এসব কথা যদি পত্রিকার রিপোর্টের মাধ্যমে জনসাধারণকে জানানো হয়, তা হলে সে অনায়াসে সাধারণ ছাত্রদের সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিতে পারে। ছাত্রনেতার বক্তব্য -শোনার পর সম্পাদক সাহেব জানান, এ কাজগুলো অত্যন্ত সাবধানে করতে হবে এবং তার পত্রিকা এ ব্যাপারে সঠিক দায়িত্বই পালন করে যাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, উত্তর বঙ্গে খরা-বন্যার কারণে খাদ্যভাব দেখা দিয়েছে। সুতরাং সেখান থেকে এমন এক চমকদার রিপোর্ট তৈরি করা হবে, যাতে বর্তমান সরকারের প্রতি জনগণ সহজেই আস্থা হারিয়ে বসে।

বহুল প্রচারিত পত্রিকার সম্পাদকের কক্ষে এ আলাপ-আলোচনার কয়েক দিন পর থেকেই দেখা গেল যে উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে খাদ্যঘাটতির কথা, অনাহার-অনটনের কথা পত্রিকার পাতায় বেশ গুরুত্ব সহকারেই ছাপা হচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অরাজকতার কথা ফলাও করে পত্রিকার পৃষ্ঠায় স্থান পেতে থাকে। আসলে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কয়েকজন সাংবাদিক কখনও –সূক্ষ্ণভাবে কখনও বা সাধারণভাবেই তাদের রিপোর্ট ও কলামের মাধ্যমে এমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অতিরঞ্জিত ঘটনাবলী তুলে ধরেন যে জনগণ সত্যিই বঙ্গবন্ধু ফিচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটাই—যাতে জনগণ ধরে নেয় বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশ এর পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

বেছে নেয়া কিছু সাংবাদিকদের এহেন ভূমিকার পাশাপাশি ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্ন মাধ্যমে অপপ্রচার চালাতে থাকল যে, বঙ্গবন্ধু ও তার প্রতিটি সহকর্মী রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হচ্ছে। তারা বিদেশে টাকা জমাচ্ছে। যারা ইউরোপে টাকা জমানোর পথ জানে না, তারা ভারতে টাকা জমাচ্ছে কিংবা বিশাল সম্পদ গড়ে তুলছে। ভারতের সাথে বর্ডার বলে কিছু নেই। আওয়ামী লীগার মাত্রই চোরাচালানিতে জড়িয়ে পড়ছে। শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বার পর্যন্ত রিলিফের মাল লুটেপুটে খাচ্ছে। 

তখন রেডক্রসের প্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মী গাজী গোলাম মোস্তাফা তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম টার্গেট হলেন। তাঁর নামে সারা দেশে একথা ছড়িয়ে পড়ল যে তিনি রেডক্রসের সব মালামাল বিক্রি করে দিয়ে অগণিত টাকার মালিক হয়েছে অথচ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর গাজী গোলাম মোস্তফাকে জেলখানায় বন্দি করা হলেও কোনো সরকারই তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ বা দুর্নীতির অভিযোগ সামান্যতম প্রমাণ করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ষড়যন্ত্রাকারীরা ঢাকা থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত গাজী গোলাম মোস্তফার নামে রেডক্রসের রিলিফ চুরির এমন গল্প নেই, যা প্রচার করেনি। এই অপপ্রচারের মূল লক্ষ্য অবশ্য রেডক্রস প্রধান নন, বঙ্গবন্ধুই ছিলেন। গাজী গোলাম মোস্তফার নমে বিভিন্ন গল্প মুখে-মুখে চালু করার পাশাপাশি নীলনকশা মাফিক রেডক্রসের রিলিফ অপব্যবহার সংক্রান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বানোয়াট রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশ করা হত।

অপপ্রচার পর্বের এক পর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীরা উত্তর বঙ্গের এক গণ্ডগ্রামে রোকেয়া নামের এক পাগলিকে জোগাড় করল। তাকে মাছ ধরার জাল পরিয়ে ফটো তোলা হল। সেই ফটো যথারীতি পত্রিকায় ছাপানো হলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সাংঘাতিক রকমে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। সাধারণ মানুষ সত্যিই বিশ্বাস করতে লাগল, উত্তর বঙ্গের গ্রামের মানুষ শুধু খাদ্যের অভাবে অনাহারে মারাই যাচ্ছে না, তারা বস্ত্রের অভাবে লজ্জা নিবারণ করতে পারছে না। সামান্য কাপড়ের অভাবে বাসন্তী মাছ ধরার জাল পরে লজ্জা নিবারণ করছে। আসলে সাধারণ মানুষকে নানা কৌশলে তখন এমনভাবে বিভ্রান্ত করে রাখা হয়েছিল, তারা একবারও চিন্তা করতে পারেনি যে সাধারণ মোটা কাপড়ের মশাড়ির চেয়ে মাছ ধরার জালের দাম অনেক বেশি। বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে হাবিবুর রহমান গং দেশব্যাপী এতই তৎপর ছিল। যড়যন্ত্রপ্রসূত ঘটনাবলী জনগণের কাছে বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে হচ্ছিল। একটার সাথে আরেকটার যোগসূত্র আবিষ্কারের মানসিক অবস্থা তাদের ছিলা না। বরং দিন দিন মানুষকে এতটাই প্রভাবতি করা হয় যে তখন যুক্তিতর্ক দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষে কোনো কথা বললে সেটি অধিকাংশ লোকই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করত না। অন্যদিকে ষড়যন্ত্রকারীদের মস্তবড় সুবিধা ছিল এই যে, তারা বঙ্গবন্ধুর লোক নয় কিংবা বঙ্গবন্ধুর জন্য জান দিতে প্রস্তুত নয় একথা কাউকে বিশ্বাস করানো অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল।

দেশের শহর এবং গ্রামে হাবিবুর রহমান গং-এর লোক কোনো-না-কোনো পর্যায়ে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের কাজ আরও সহজ হয়ে গেল এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর অনেক খাঁটি সমর্থক পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। তারা ষড়যন্ত্রকে তো আঁচ করতে পারল না, উপরন্তু নিজেদের কাছে জাতির জনকের যেসকল পদক্ষেপ অপছন্দনীয় ছিল, সেগুলি সম্পর্কে প্রকাশ্যে সমালোচনামূলক বক্তব্য দিতে শুরু করল। বঙ্গবন্ধুর সমর্থক বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে হাটেবাজারে রাস্তাঘাটের চায়ের আড্ডায় যোগ দেখা অনেক সাধারণ কর্মী পর্যন্ত সরকারের সামান্যতম ভুলত্রুটির সমালোচনা করতে কোনোরূপ দ্বিধা করত না। তারা ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারল না, তাদের এই সমালোচনার ফলে আসল ক্ষতি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের। এভাবে নিজেদের অজ্ঞাতসারেই তারা ষড়যন্ত্রকারীদের সহযোগীতে পরিণত হল। 

বঙ্গবন্ধু সরকারের ভালো কাজগুলির চাইতে দেশের জনগণের দৃষ্টি  অভাব-অভিযোগের দিকে ধরে রাখাটাই ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম সাফল্য। বঙ্গবন্ধুর  তরফ থেকে দেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জনগণকে বোঝানোর দায়িত্ব যাদের উপর দেয়া হয়েছিল, তাদের কেউ ছিল ষড়যন্ত্রকারীদেরই অংশ, আবার কেউ-বা নিজের আহাম্মকির কারণেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই কাজ করছিল— আর এমন অপদার্থের অভাব তো পড়ার কথা নয়ই।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭