ইনসাইড থট

রাষ্ট্রদূত সানাউল হক দেন তাড়িয়ে, শেখ হাসিনা-রেহানাকে আশ্রয় দিয়ে ওএসডি হন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী


প্রকাশ: 10/08/2023


Thumbnail

বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে শেখ হাসিনা-রেহানাকে নিজের সরকারি বাসা থেকে কিভাবে তাড়াবেন, সে চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন, বেলজিয়ামস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক। আর ঠিক তখনি ব্যতিক্রমী এক মানবিক চরিত্রে রূপদান করেছিলেন পশ্চিম জার্মানীস্থ বাংলাদেশেরই রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয়কে তাঁর সরকারি বাসায় আশ্রয় দিতে যেন এক মরণপণ তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি সফলও হয়েছিলেন, বেলজিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধুর দু'কন্যাকে পশ্চিম জার্মানিতে নিয়ে এসে নিজের সরকারি বাসাতেই উঠালেন। এমনকি  তাদের জানে বাঁচানোর জন্য ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়লাভেরও সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি ওএসডি হন। এরকম শাস্তি যে, অপেক্ষা করছিল, তা তিনি জানতেন। পুরো লেখাটির পরোতে পরোতে সে কথাই ফুটে উঠেছে।

পনের আগস্ট ভোরবেলা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসার টেলিফোন ক্রিংক্রিং শব্দে বেজে উঠল। ঘুম হতে জেগে উঠলেন মিঃ চৌধুরী, (পশ্চিম জার্মানীস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত)- রিসিভার কানে তুলে নিলেন। ওমনি ওপাস থেকে তাঁর কর্ণগোচরিত হল,  একটি ভারাক্রান্ত কন্ঠে- স্যার, আমি ফারুক আহমেদ চৌধুরী বলছি, লন্ডন থেকে (লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার)- খবর শুনেছেন স্যার? ঢাকার খবর। কী হয়েছে ঢাকার আবার? হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর প্রশ্ন।

স্যার, ঢাকায় অভ্যুত্থান হয়ে গেছে। শেখ সাহেবের ভাগ্যে কী ঘটেছে, এখনও অনিশ্চিত স্যার।

বলো কী?

স্যার সম্ভবত শেখ সাহেব মারা গেছেন। ফোন রেখে স্তম্ভিত রাষ্ট্রদূত স্ত্রী মাহজাবিনকে ডেকে বললেন। কিন্তু মাহজাবিন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, এমনকি রাষ্ট্রদূত নিজেও না।

তারপরও বিচলিত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

ব্রাসেলসে ফোন করলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হককে। জানতে চাইলেন, ঢাকার খবর কী? নীরব রাষ্ট্রদূত - কথা বলছেন না। রিসিভার রেখে দিলেন ফোনের ওপর।

দিকবিদিকশুন্য রাষ্ট্রদূত আবার ফোন করলেন সানাউল হককে। বললেন হাসিনা এবং রেহানাকে যেন কিছু না জানানো হয়। তাদের যে কোন সাহায্য করতে তিনি তাঁর মানসিক প্রস্তুতির কথাও জানিয়ে দিলেন।

চৌধুরী ফোন রেখে এবার রেডিও অন করলেন। বিবিসি অভ্যুত্থান হওয়ার খবর প্রচার করলেও সূত্রটিকে বলছিল অসমর্থিত।

চৌধুরীর স্মৃতিপটে ভেসে উঠল শেখ সাহেবের তাকে বলা কিছু কথা। শেখ সাহেব কী তাঁর মৃত্যুর আগাম বার্তা পেয়ে গিয়েই বলেছিলেন, ঘটনাবলী ভাল যাচ্ছে না? 

কয়েকঘন্টা পর ব্রাসেলস থেকে রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের ফোন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী কথার হাবভাব শুনে বুঝতে পারলেন এবং মনে হল, সানাউল হক খুব অস্থির, হাসিনা-রেহানাকে নিয়ে যেন খুব ঝামেলায় আছেন। ওদের তাড়িয়ে দিলেন বাঁচেন।

বললেন, জানো হুমায়ুন, প্যারিস থেকে আবুল ফতেহ গাড়ি পাঠায়নি। কথা ছিল গাড়ি পাঠাবে, ওদের নিয়ে যাবে। কিন্তু ফতেহর বাসায় কেউ টেলিফোন ধরছে না।

এবার প্যারিসে শফি সামিকে ফোন করলেন চৌধুরী। তখন তিনি অসুস্থ, হাসপাতালে। শফিকে বললেন, রাষ্ট্রদূত ফতেহকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেখ সাহেবের মেয়েদের প্যারিসে যাওয়ার কথা। ওরা যদি যায় তাহলে, ওদেরকে দেখ। শফি সামি বললেন, ঠিকআছে আমার বাড়িতে রাখব। শফি সামির স্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

আবারও চৌধুরী ব্রাসেলসে সানাউল হককে ফোন করে বলেন, শেখ সাহেবের দুই কন্যাকে গাড়ি দিয়ে অন্তত জার্মান সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন। সানাউল হক রাজি হলেন না। চৌধুরী বিস্মিত হয়ে সানাউল হককে বলেন, কী বলছেন আপনি, এতটুকু মমত্ববোধ নেই? আপনাকে তো শেখ সাহেব খুব স্নেহ করতেন, অনেকের অমতে আপনাকে রাষ্ট্রদূতও বানিয়েছেন। সামান্যতম কৃতজ্ঞতাবোধও তো থাকা উচিত।

চৌধুরী ক্ষুব্ধ হন সানাউল হকের আচরণে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, এই ভদ্রলোক বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের গাড়ি দিতে রাজি হননি, তো বাড়িতে ঠাঁই দেয়া তো দূরের কথা। যাহোক সানাউল হককে টেলিফোনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জানিয়ে দেন যে, ওরা আমার জার্মানির বাড়িতে আসবে। আমি তাদের আশ্রয় দেব। আমি অকৃতজ্ঞ নই। আমার চাকুরির কোন মায়া নেই। মানবতা আমার কাছে মুখ্য। আমার বাবা-মা মানুষের সেবা করতে শিখিয়েছেন। বলেছেন, মানুষের বিপদেআপদে যেন ছুটে যাই।

সত্যিই পরিণতি কী হবে জেনেও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের জার্মানিতে নিয়ে যান। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় তারা পৌঁছল। ওদিনই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.  কামাল হোসেনের জার্মানিতে পৌঁছার কথা। সঙ্গে পররাষ্ট্র দফতরের মহাপরিচালক রেজাউল করিমেরও। বেলগ্রেডে অবস্থানরত ড. কামাল তখনও ঢাকার খবর জানেন না। চৌধুরীর ভাষ্যমতে বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের আগেই ড. কামাল জার্মানিতে পৌঁছে গেছেন এবং সবকিছু জানতে পেরে খুবই অস্থির কথা বলতে পারছিলেন না। শেখ সাহেবের মেয়েরা যখন আমার বাসায় পৌঁছল তখন কী দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়- চৌধুরীর ভাষ্যমতে, জীবনে অনেক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। এমন হইনি কখনও। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। হিমশীতল পরিবেশ। কান্নায় বাড়ির নিস্তব্ধতা কেটে গেল।

চৌধুরী ঢাকায় ফোন করছেন কিন্তু কাজ করছে না। ঢাকার সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এর মধ্যে হাসিনা-রেহানা চৌধুরীর বাসার রেডিও মারফত সব জেনে গেছেন। সয়ং শেখ হাসিনা কেঁদে কেঁদে চৌধুরীকে বলেন, বাবার সঙ্গে কামাল-জামালও চলে গেছে। এখন আমার মা, রাসেল ও চাচাকে আমাদের কাছে এনে দিন।

রাত তখন দশটা। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জানতেন বেগম মুজিবও নেই। তবুও তিনি দুই কন্যাকে বললেন, ঠিক আছে তাই হবে, আমি দেখছি, কী করা যায়।

এর কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই জানাজানি হয়ে গেল যে, বেগম মুজিবও মারা গেছেন। শেখ হাসিনার অনুরোধে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ঢাকায় টেলিগ্রাম পাঠালেন, শেখ রাসেলকে যেন জার্মানিতে পাঠানো হয়। তখনও সবার ধারণা ছিল শিশু রাসেল বেঁচে আছে। ঢাকার পররাষ্ট্র দফতর থেকে কোন জবাব এল না।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেদেশের সরকারের সানুগ্রহ  কামনা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এতে খুশি হয়ে প্রতিত্তোরে বললো, মিঃ চৌধুরী, আমরা আপনার সাহসী ভুমিকাকে উৎসাহিত করছি তবে নিজে যে কোনোপ্রকার ঝামেলায় পড়া থেকে সর্তক থাকবেন।

জার্মান সরকার কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন চৌধুরীর বাসভবনে। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা জানতে চাইলো হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কাছে - কে এই ঘটনার নায়ক? 

চৌধুরী বলেন, খন্দকার মোশতাক। বিশ্বাস করতে পারছিলেন শেখ হাসিনা। আব্বার সঙ্গে চাচা কতো ঘনিষ্ঠ, পরিবারের সদস্যের মত, তিনি এ হত্যাকান্ডে জড়িত থাকতে পারেন না।

চৌধুরী বলেন, অবিশ্বাস করলে কী হবে, মোশতাকই ঘটনার নায়ক এবং রাষ্ট্রপতি।

চৌধুরীর ভাষ্যমতে, এক জার্মান মহিলা মিশনে প্রবেশ করে বললেন, তোমরা কেমন জাতি, তোমাদের নেতাকে হত্যা করতে পার। রাষ্ট্রদূত হিসেবে পরিচয় দিতে তখন লজ্জা লাগছিল - এমনটিই বলেছেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। 

এরই মধ্যে ভারতীয় হাইকমিশনার রহমান ফোন করে শেখ সাহেবের মেয়েদের খোঁজখবর নিলেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিলেন। ২৫ আগস্ট মোশতাক সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী টেলিফোনে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে জানালেন যে, রাষ্ট্রপতি মোশতাক খুবই ক্ষিপ্ত - কেন আপনি হাসিনা-রেহানাদের আশ্রয় দিয়েছেন। প্লিজ, ঢাকায়  আসবেন না, আসলে বিপদ হবে। এর দুদিন পরই ওএসডি করা হয় চৌধুরীকে। তখন জার্মান বন্ধুরা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে জার্মান সেক্রেটারি এইচ আর ডিঙ্গেলস বলেন, কোন চিন্তা নেই, আমরা আছি।

ইতিহাসের কী বিস্ময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সেই নির্বাসিত কন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘসংগ্রামশেষে

১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করেন এবং ইতিপূর্বেই জাতিসংঘসহ বিশ্ববরেণ্য কুটনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য  হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে সপ্তম জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত করেন। যদিও সংসদের মেয়াদ পূর্ণের মাত্র কদিন আগে বর্ষীয়ান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭