এডিটর’স মাইন্ড

‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’


প্রকাশ: 11/08/2023


Thumbnail

বিএনপি পদযাত্রা কর্মসূচী পালন করলো। গত কিছুদিন ধরে বিএনপি ‘এক দফা’ আন্দোলনে ব্যস্ত। থেমে থেমে বিএনপি নানা রকম কর্মসূচী পালন করছে। ‘এক দফা’ আসলে কি তা বুঝতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। একদিকে বিএনপি একদফা ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে সরকারের কাছে বেগম জিয়ার মুক্তি সহ এক গুচ্ছ দাবী দাওয়া উত্থাপন করেছে। কদিন আগে তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা এবং দণ্ড প্রত্যাহারের দাবীও করলেন বিএনপির নেতারা। বিএনপির পক্ষ থেকে ১০ দফা দাবী উত্থাপন করা হয়েছে। ৩১ দফার রাষ্ট্র মেরামত প্রস্তাবও আছে টেবিলে। এসব নানা কিসিমের দাবীর কোনটা আসল আর কোনটা নকল, বুঝবো কিভাবে? এই সব দাবী দাওয়া এক সাথে নিয়ে পর্যালোচনা করলে আঁতকে উঠতে হয়। কিছু কিছু দাবী যেন বাংলাদেশকেই পাল্টে ফেলার জন্য। বিএনপির নানা দাবী নামা নিয়ে যখন বিভ্রান্তির চোরাবালিতে আটকে গেছি, তখন চোখ খুলে দিলো দলটির টাইটেল শ্লোগান। ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’। বিএনপির নেতাদের মুখে এই শ্লোগান সারাক্ষণ। বিএনপির সব কর্মসূচীর সামনে পিছনে এখন ট্যাগ লাইনের মতো লেখা ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’। একমাত্র জার্মানীর নাৎসী পার্টি ছাড়া বিশ্বের কোন রাজনৈতিকি দল, তার দেশকে পিছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি। ১৯২০ সালে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা নিয়ে হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট এই রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটে। তখন তারাও শ্লোগান দিয়েছিল ‘টেক ব্যাক জার্মানী।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানীতে কমিউনিস্ট উত্থান ঠেকাতে কট্টর জাতীয়তাবাদের বিষবাম্প ছড়িয়ে দিয়েছিল নাৎসীরা। তারা জার্মানীর হারানো গৌরব, অহংকার ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল নাগরিকদের। ‘টেক ব্যাক জার্মানীর’ পরিণাম কি হয়েছিল আমরা সবাই জানি। ঠিক একশো বছর পর হিটলারের শ্লোগান ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। বিএনপির হাত ধরে। অবশ্য নাৎসী পার্টির পুরো নামের সঙ্গে বিএনপির পুরো নামের মিল আছে। হিটলারের দলের পুরো নাম ‘ন্যাশনাল সোশালিস্ট জার্মান ওয়ার্কাস পার্টি।’ রাজনৈতিক দল বা নেতারা জনগণকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান, আগামীর পরিকল্পনার কথা বলেন। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শ্লোগান দিয়েছিলেন ‘চেঞ্জ’ পরিবর্তনের ডাক দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে  নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পেয়ে বলেছিলেন ‘লুক ফরোয়ার্ড।’ বিএনপি বলছে ‘টেক ব্যাক।’ বাংলাদেশকে টেনে হিচড়েঁ বিএনপি কোথায় নিয়ে যেতে চায়? কোন আমলে?

বছর খানেক আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পকিস্তানের জন্য হা পিত্যেশ করেছিলেন। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন। ‘পাকিস্তান আমল ভালো ছিলো।’ বিএনপি কি তাহলে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানাতে চায়? অবশ্য স্বাধীনতার পর থেকে কেউ কেউ বাংলাদেশে আবার পাকিস্তান বানাতে জান-কোরবান করছেন। খুনী মোশতাক তো মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ই ‘পাকিস্তানি কনফেডারেশন’ তত্ত্ব হাজির করেছিলেন। ৭৫ এর নারকীয় ঘটনার আসল উদ্দেশ্য ছিলো বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানো। সামরিক এক নায়ক জিয়াউর রহমান এই লক্ষ্যে বেশ সফল হয়েছিলেন। ৭ নভেম্বর ক্ষমতা দখল করে তিনি পাকিস্তান অভিমুখে নিয়ে যেতে থাকেন বাংলাদেশকে। ‘জয় বাংলা’ হয়ে যায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’ ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয় ‘রেডিও বাংলাদেশ’। সংবিধান থেকে উপড়ে ফেলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ৭১ এর নরঘাতক যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পূন:প্রবর্তন করেন। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত কে নতুন জীবন দেন। এটাই ছিলো প্রথম ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’ উদ্যোগ। বাংলাদেশকে নতুন পাকিস্তান বানাতেই জিয়া পাকিস্তান পন্থী রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করেন। রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী ভ্রষ্ট চৈনিক বামদের ককটেল বানিয়ে বিএনপি গঠন করেন। জিয়ার পাকিস্তান বাস্তবায়ন মিশনে সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিলো মুক্তিযোদ্ধা নিধন অভিযান। সেনাবাহিনীতে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক এবং সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেন জিয়া। ৭৫ এর খুনীদের দায়মুক্ত দিয়ে তাদের বিদেশে লোভনীয় কূটনৈতিক চাকরী দেন। প্রশাসন থেকে শিল্প সাহিত্য-সর্বত্র পাকিস্তান প্রেমীদের পূনর্বাসন করেন। ‘বাংলাদেশ’ নামটাই থাকে, কিন্তু এটি বাস্তবে পরিণত হয় পাকিস্তানে। জিয়ার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের পাকিস্তান রূপান্তর হোঁচট খায় বটে। কিন্তু এরশাদ এবং বেগম জিয়া ‘পেয়ারে পাকিস্তানের’ মহব্বত অটুট রাখেন। 

১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। তখনই ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’ অভিযাত্রা হোঁচট খায়। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে ‘পাকিস্তান’ আবার জয়ী হয়। এবার বেগম জিয়া, তার স্বামীর স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। পাকিস্তানী দুইজনকে মন্ত্রী বানিয়ে দেন। যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদ কেবল ঘৃণিত ধর্ষক, লুণ্ঠনকারী এবং মানবতা বিরোধী অপরাধীই ছিলেন না, তারা বাংলাদেশকেই অস্বীকার করতেন। এই দুজনকে মন্ত্রী বানিয়ে, জামায়াতকে ক্ষমতার হিস্যা দেন বেগম জিয়া। এভাবেই বাংলাদেশকে আধা পাকিস্তান বানিয়ে ফেলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। পাকিস্তানের প্রধান লক্ষ্য কি? এই প্রশ্ন করা হয়েছিল পাকিস্তানে সামরিক একনায়ক জিয়াউল হক কে। সামরিক জান্তা উত্তর দিয়েছিলেন ‘ভারতকে পরাজিত করা।’ এই রাষ্ট্রটি তার নিজের দেশের উন্নয়নের জন্য যতো না সচেষ্ট থাকে, তার চেয়ে বেশি সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করেছে ভারতের ক্ষতি করতে। এজন্যই ‘বাংলাদেশ’ দরকার পাকিস্তানের। আর তাই ‘বিএনপি’ সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা ল্যাবরেটরিতে। ২০০১ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণ ভূমি। কাগজে কলমে বাংলাদেশ, ভেতরে পাকিস্তান। বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর অভিযাত্রা থমকে যায় ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর। আবার ৭২ এর সংবিধানে ফিরে গেছে বাংলাদেশ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। বাংলাদেশের ভূখন্ড এখন আর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্য নয়। এজন্যই কি টেক ব্যাক বাংলাদেশ? বিএনপি কি বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানাতে চায়? আমি জানি, বিএনপির প্রায় সবাই এই প্রশ্নে সমন্বয়ে ‘না’ ধ্বনি দেবেন। তাহলে প্রশ্ন, বিএনপি বাংলাদেশকে কোন আমলে নিয়ে যেতে চায়?

৭৬ থেকে ৮১ সালে? যে সময় সংবিধান ছিলো বন্দী। মানবাধিকার, গণতন্ত্র ছিলো বুটের তলায় পিষ্ট। বিচারের নামে হতো নিত্য প্রহসন।আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কারাগারে ফাঁসিতে ঝোলানো হতো হাজার হাজার নাগরিককে। রাতের অন্ধকারে। বিএনপি কি আবার সেই বাংলাদেশ চায়, যেখানে কথা বলার অধিকার ছিলো না। রাত নামার সাথে সাথে কারফিউ জারি হতো। যেখানে স্বাধীনতা বিরোধীরা বুক ফুলিয়ে চলতো আর মুক্তিযোদ্ধাদের জায়গা হতো কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। নাকি, বিএনপি ৯১ থেকে ৯৫ এর বাংলাদেশ চায়। যেখানে সারের দাবিতে কৃষককে প্রাণ দিতে হতো। প্রেসক্লাবে ঢুকে সাংবাদিকদের পেটানো হতো। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। বিএনপি না করলে যখন চাকরী, ব্যবসা কিছুই পাওয়া যেত না।

কিংবা বিএনপি বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চায় ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে। হাওয়া ভবনের যুগে। যে সময় দ্বৈতশাসনের চাপে ‘স্যান্ড উইচ’ হয়েছিল বাংলাদেশ। হাওয়া ভবনের দূর্নীতি এবং লুণ্ঠন ছিলো ওপেন সিক্রেট। খাম্বা প্রকল্প, সিএনজি প্রকল্পের হাজার কোটি টাকার দূর্নীতি হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মদদে এবং পৃষ্ঠপোষকতায়। বিএনপি কি বাংলাদেশকে আবার সেই সময়ে ফেরত নিতে চায় যখন দূর্নীতিবাজরা উল্লাসের নৃত্য করতো। সরকারী চাকরী, পোস্টিং, পদোন্নতি সবকিছু হতো টাকার বিনিময়ে। হাওয়া ভবনে টাকা দেয়া ছাড়া কোন ব্যবসা বাণিজ্য কিছুই করা যেত না। বাংলাদেশ কি আবার সেই সময়ে ফেরত যাবে যখন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে গ্রেনেড হামলার মতো বিভৎসতা ঘটানো হয়। আমরা কি আবার সেই সময়ে ফিরে যাবো, যখন পূর্ণিমা, শেফালী, ফাহিমা’রা ধর্ষিতা হবে ছাত্রদল-যুবদলের ক্যাডারদের হাতে। এসব ধর্ষনের কোন বিচার হবে না। ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’ মানে কি আবার সংখ্যালঘু নিধণ, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া। মসজিদে ঢুকে নামাজরত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করা। বিএনপি কোন বাংলাদেশ চায়? যেখানে শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাই’রা দাপিয়ে বেড়াবে দেশ জুড়ে। সারাদেশে এক যোগে জঙ্গিরা গ্রেনেড হামলা করবে। বিএনপির ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’ আসলে কি? বড় জানতে ইচ্ছে করছে।

বিএনপির ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ মানে কি এক-এগারোর অনির্বাচিত রাজত্বে ফিরে যাওয়া। যেখানে কিছু সুশীলের ক্ষমতার দাপটে জাতি আবার অস্থির হবে। রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র হননের খেলা চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোমড়ে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে। 

বিএনপি আসলে কি চায়, তা খোলা মেলা করতে হবে দলটির নেতাদেরই। বিএনপি নতুন সংবিধানের কথা বলছে। জাতীয় ঐক্যমতের কথা বলছে। বর্তমান সংবিধান বাতিল করে বিএনপি কি পাকিস্তানের সংবিধান চালু করতে চায়। জাতীয় ঐক্যমতের কথা বলে কি তারা স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের জাতীয় বীরের মর্যাদা দিতে চায়?

আমার মনে হয়, ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’ এক ভয়ংকর ভাইরাস। এই শ্লোগান বাংলাদেশের অস্তীত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বাংলাদেশ আর সেই অন্ধকার যুগে ফিরে যাবে না কখনো। টেক ব্যাকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ।

 

 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭