ইনসাইড পলিটিক্স

মার্কিন দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ?


প্রকাশ: 15/08/2023


Thumbnail

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিলো প্রশ্নবোধক। তারা সব কিছু জানতো। সব জানার পরও খুনীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আগস্ট ট্রাজেডি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারের তারবার্তায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ঢাকার মার্কিন দূতাবাসকে ঘিরে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া প্রশ্নে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ‘আশ্রয় প্রার্থনার অনুরোধ’ শিরোনামে বোস্টার যে তারবার্তাটি পাঠান তা হুবহু এরকম:

১। আমরা মুজিবের ভাগনে প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনির পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আজ সকালের অভ্যুত্থানের পর তাঁদের আশ্রয় দেওয়ার অনুরোধ পেয়েছি। তাঁরা এখন আমাদের পলিটিক্যাল কাউন্সিলরের বাসায় রয়েছেন। তাঁর বাসাটি শেখ মনির বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া বাড়িটির মাত্র তিনটি বাড়ি পরই। এঁদের মধ্যে রয়েছেন শেখ মুজিবের মা, বাবা, এক বোন, এক ভাইয়ের স্ত্রী, দুই সন্তান ও কাজের লোক।

২। যেহেতু তাঁরা গুরুতর সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন, আমরা মনে করি, তাঁরা আমাদের কাছ থেকে এফএএ ২২৮.৩ [সম্ভবত রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদানসংক্রান্ত সরকারি আদেশ] অনুসারে অস্থায়ী আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য। আজ রাতটা কীভাবে কাটবে এটা ভেবে তারা খুবই চিন্তিত, খুবই উদ্বিগ্ন। তাঁরা বলেছেন, কারফিউ প্রত্যাহার হলে তাঁরা চলে যাবেন । আশা করা যায়, কাল কারফিউ প্রত্যাহার হতে পারে, তখন তাঁরা তাঁদের পুরান ঢাকার বাড়িতে চলে যাবেন। তাঁরা যখন যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করবেন, আমরা তখন তাঁদের যেতে দেব। এবং পুনরায় বার্তা পাঠাব যদি তাঁরা কোনো কারণে আরও বেশি সময় ধরে থাকতে চান।

১৬ আগষ্ট ১৯৭৫ বোষ্টার পৃথক এক তারবার্তার উল্লেখ করেন যে, শেখ মনির পরিবারের সদস্যরা আজ সকালে দূতাবাস-কর্মকর্তার বাসভবন ত্যাগ করেছেন। তাঁদের অনুরোধে ঢাকার অন্যত্র তাঁদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে তাঁদের পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

১৮ আগস্ট ১৯৭৫ বোস্টার যে তারবার্তাটি (১৯৭৫ঢাকা০৩৯৭৮) মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠান তার শিরোনাম ‘আশ্রয়ের অনুরোধ করেছেন তোফায়েল আহমেদ’। বোস্টারের এই তারবার্তা হুবহু নিচে তুলে ধরা হলো:

১। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমানের বিশেষ সহকারী তোফায়েল আহমেদ জন এডামসের মাধ্যমে কোনো একটি দূতাবাস ভবনে আশ্রয় লাভের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। জন এডামস হলেন বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন সরকারের সেন্সাস ব্যুরো স্পেশালিষ্ট। মি. এডামস তোফায়েল আহমেদের নিকটতম প্রতিবেশী।

২। এডামসের মতে, তোফায়েল উর্দিধারী ব্যক্তিদের দ্বারা ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে পাঁচটায় অবরুদ্ধ হন। তবে এডামস স্পষ্ট করতে পারেননি যে তারা সেনাবাহিনীর লোক কি না। কিন্তু আমরা অনুমান করি, তারা অবশ্যই সেনাবাহিনীর লোক। ১৬ আগস্ট আড়াইটায় তোফায়েল তাঁর বাড়িতেই ফিরে আসেন। সেখানে তাঁকে প্রহরায় রাখা হয়। ১৬ আগস্ট রাত ১০টায় তোফায়েল এডামসকে তাঁর বাড়িতে যেতে অনুরোধ জানান। তিনি তাঁকে বলেন যে তিনি নিজেকে ‘সংকটাপন্ন ও অনিরাপদ’ মনে করছেন । তাই তিনি কোনো একটি দূতাবাস ভবনে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এডামস বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে তোফায়েলকে আশ্বস্ত করেন এবং এডামস তোফায়েলের অনুরোধ আমাদের জানাতে ১৮ আগস্ট দূতাবাসে আসেন।

৩। আমরা যেহেতু তোফায়েলের সঙ্গে কথা বলিনি, তাই তাঁর ভয়ের কারণ সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। তবে যেহেতু তাঁকে একবার আটক করে নতুন সরকার (যাঁদের অবশ্যই এ কথা জানা আছে যে, শেখ মনির নেতৃত্বাধীন তৎপরতার কারণে তোফায়েল ক্রমশ মুজিবের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন) আবার ছেড়ে দিয়েছে, তাই আমরা মনে করি, অনিশ্চয়তাপূর্ণ এই সময়ে তোফায়েলের নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাঁকে অন্তরীণ করে রাখা হচ্ছে। আমাদের উপসংহার হচ্ছে এই যে তোফায়েল তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত রক্ষীদের সাহস ও নিষ্ঠার ওপর খুব বেশি ভরসা রাখতে পারছেন না। তিনি সন্দেহ করছেন যে এ সময় কেউ যদি তার সঙ্গে পুরোনো শত্রুতার হিসাব চুকাতে চায়, তাহলে তার রক্ষীরা তাঁকে আগলে রাখার পরিবর্তে দ্রুত পালিয়ে যাবে।

৪। শেখ মনির পরিবার-পরিজনদের আশ্রয় প্রার্থনার চেয়ে তোফায়েলের আশ্রয় চাওয়ার বিষয়টি লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন। তোফায়েলের বেলায় :

ক. তাঁর পরিবারের এমনটা ভাবার সংগত কারণ রয়েছে যে নতুন সরকারের দিক থেকে তাঁরা এই মুহূর্তে জীবনের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বোধ করছেন।

খ. তারা যখন আমাদের কাছে অনুরোধ করে, তার আগেই তাঁরা দূতাবাস ভবনে প্রবেশের সুযোগ লাভ করেছেন। এবং

গ. তাঁরা দূতাবাস ভবনে আশ্রয় লাভের সময় আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে পরবর্তী সান্ধ্য আইন প্রত্যাহারের আগেই তাঁরা দূতাবাস ভবন ত্যাগ করবেন (তাঁরা সেটা রক্ষা করেছিলেন)।

তাই বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে—

ক.  তোফায়েলের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর সময় ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত হয়েছে বলে মনে হয়। এবং

খ.  প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় তোফায়েল এখনো তাঁর বাসভবনে রয়েছেন। এই প্রহরীদের দায়িত্ব কেবল তাঁকে অন্তরীণ রাখাই নয়, বরং তাঁকে সুরক্ষা প্রদান করাও বলে মনে হচ্ছে।

এই অবস্থায় আমরা তোফায়েলকে এটা জানিয়ে দিচ্ছি যে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাঁকে কীভাবে সহায়তা   করতে পারি তা বুঝতে পারছি না।’ 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭