প্রকাশ: 17/08/2023
চলছে শোকাবহ আগস্ট মাস। এ মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আগস্ট ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সারা জাগানো বই ‘পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি’ এর ধারাবাহিক পর্বের সপ্তদশ পর্ব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
ইসলামাবাদে পাকিস্তানি শাসক ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করার জন্যে লন্ডন থেকে এক বাঙালি ভদ্রলোক যায়। ব্রিটিশ পার্সপোর্টধারী এই লোকটি ছিল হাবিবুর রহমান গং-এর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। লোকটি বাঙালি হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল না এবং মনেপ্রাণে যাকে বলে একশত ভাগ পাকিস্তানের সেবাদাস। স্বাভাবিকভাবেই লোকটি হাবিবুর রহমানের খুবই বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের একজন হয়ে উঠেছিল। এই ভদ্রলোকের নাম বারেক বিন জাহেদ। ভুট্টোর কাছে এ লোকটি যে বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে গিয়েছিল, সেটি ছিল—যেভাবেই হোক বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি সম্মেলনে আনতে হবে। লোকটি ভূট্টোর কাছে হাবিবুর রহমানদের এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল যে বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ সহকর্মী পাকিস্তানে গিয়ে ইসলামি সম্মেলনে যোগদান করতে দেয়ার ব্যাপারে নারাজ। কাজেই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে নিতে হলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের নেতাদেরকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ইসলামি সম্মলনে যোগদানের ব্যাপারে প্রভাবিত করতে হবে।
জুলফিকার আলি ভুট্টো ঝানু রাজনীতিবিদ। কূটনৈতিক বুদ্ধি তাঁর কম ছিল না। ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারলেন এবং হাবিবুর রহমান গং দের পাঠানো ম্যাসেজকে খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে থাকলেন। এক পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন মুসলিম দেশের রাজধানীতে বিশেষ দূত পাঠাতে শুরু করলেন। এই বিশেষ দূতেরা মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানদের একথা বোঝাতে থাকে যে ভুট্টো স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন, যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই হচ্ছে মুসলমান। সুতরাং মুসলিম উম্মার স্বাথেই ভুট্টো চান যে বাংলাদেশ ওআইসিতে তার নিজস্ব ভূমিকা পালন করুক। ওআইসিতে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ভুট্টোর জন্যে কোনো বাধা হয়েই দাঁড়াবে না, বরং মুসলমানদের স্বার্থে তিনি চান বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঙালিরা অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সম্ভবত এ কারণেই তাদের নেতা শেখ মুজিব ভুট্টোর সদিচ্ছাকে সঠিকভাবে অনুধাবন নাও করতে পারেন। কাজেই মুসলিম দেশগুলোর নেতাদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে শেখ মুজিবকে বোঝাবার। তাকে জানাতে হবে, ভুট্টো নিজ থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে তার সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে চান।
মুসলিম বিশ্বের নেতারা ভুট্টোর এই মনোভাবকে সাদরে গ্রহণ করেন। তারা এ ব্যাপারে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের অনেকে আঁচ করতে পারলেন না যে, বাংলাদেশের প্রতি ভুট্টোর হঠাৎ এই নমনীয় মনোভাবে পেছনে বিশেষ রাজনৈতিক চাল রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের নেতারা যথারীতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকলেন, যাতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করতে রাজি হন। তাদের কেউ কেউ সরাসরি টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে থাকেন যে, ইসলামি সম্মেলনে যোগ দিলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ভাল হবে। এর ফলে প্রায় সব মুসলিম দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপিত হবে। এতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। তবে ইসলামি সম্মেলনে যোগদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জন্যে অসুবিধা হল এই যে, তা পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু এটা কোনো অসুবিধাই নয়, যেহেতু ইসলামি সম্মেলনের জন্যে স্থানটি আগে থেকেই নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এখন আর স্থান পরিবর্তন করা চলে না। তা ছাড়া ভুট্টো নিজেই একাত্তরের ভুলের অবসান ঘটাতে চান। একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বরতাকে ভুট্টো প্রকাশ্যে স্বীকার করতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে এর জন্যে অনুতপ্ত। এখন তিনি বাংলাদেশের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে স্থায়ীভাবে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান। বঙ্গবন্ধুকে মুসলিম দেশসমূহের নেতারা আরও বোঝান যে বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আলোচিত নেতা। এ কারণে তাঁর উচিত বড় মনের পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানে গিয়ে ইসলামি সম্মেলনে যোগদান করা। বঙ্গবন্ধু ইসলামি সম্মেলনে যোগ দিলে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রতি তাদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে। তাদের মধ্যে যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল, সেটা কেটে যাবে। তারা বুঝতে পারবে যে বঙ্গবন্ধু কোনো একরোখা নেতা নন, বরং তিনি হচ্ছেন সত্যিকার অর্থেই শান্তির পূজারি যিনি এখন যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশকে সঠিকভাবে পুনর্গঠন করার জন্যে ব্যক্তিগতভাবে সকলকে ক্ষমার চোখে দেখতে আগ্রহী। মুসলিম বিশ্বের নেতারা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুললেন না যে, তিনি এই সুযোগ হারালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এরকম একটি সুযোগ সহজে পাবেন না। যেহেতু রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাই জাতীয় স্বার্থেই বঙ্গবন্ধুর উচিত ইসলামি সম্মেলনে যোগদান করা।
বঙ্গবন্ধুকে যেমন মুসলিম বিশ্বের নেতারা বোঝালেন, তেমনি দেশে হাবিবুর রহমান গং বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সহকর্মীকেও আলাদা আলাদাভাবে একই বিষয়কে বোঝাতে থাকল। বাস্তবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ সহকর্মী বিশ্বাস করতে থাকন যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে গিয়ে ইসলামি সম্মেলনে যোগদান করলেই দেশের জন্যে কল্যাণকর হবে। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদসহ বঙ্গবন্ধুর কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগী এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলেন। বেগম মুজিবও পাকিস্তানে যাওয়ার সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিলেন। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে আমলারা পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবেই বন্ধবন্ধুর ইসলামি সম্মেলনে যোগদানের জন্যে সমস্ত ব্যবস্থা করে দেয়। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু ইসলামি সম্মেলনে যোগদান করায় আসল লাভবান হল ষড়যন্ত্রকারীরা। তারা হিসেব করে দেখেছিল যে বঙ্গবন্ধুকে কোনো-না কোনোভাবে লাহোরের ইসলামি সম্মেলনে নিতে পারলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি যোগাযোগের সূত্রপাত হবে। আর এই যোগাযোগের ফলে তারাও এগিয়ে যেতে পারবে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭