নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 12/03/2018
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞগণ বলেন যে, কোনো জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সবার আগে সেই জনগোষ্ঠীর শক্তিশালী উপাদান বা পাওয়ার ফ্যাক্টর চিনে নিতে হয়। আমাদের দেশে উন্নয়নে সৎ রাজনীতিবিদ, সাধু ব্যবসায়ী আর সৎ আমলাদের ধরা হয় সমাজের শক্তিশালী উপাদান বা পাওয়ার ফ্যাক্টর হিসেবে। সুশাসনের জন্য বিচার বিভাগ বা জুডিশিয়ারীকে শক্তিশালী উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হলেও উন্নয়নের জন্য প্রাথমিকভাবে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী আর আমলাদের উপর বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। এঁদের সদিচ্ছা, সততা, নিষ্ঠা ও ঐকান্তিক চেষ্টা যে কোন দেশের উন্নয়নে খুব বড় ফ্যাক্টর। কাউকে বাদ দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে কোন দেশের করা খুব কঠিন। সংশ্লিষ্ট পক্ষের কাউকে বাদ দিলে শুরু হতে পারে ব্লেইম গেম।একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাবেন, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে; উন্নয়ন হয় বিলম্বিত। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি পরিক্ষিত মডেল নিয়ে বলি। এই মডেলটি অনেক দেশেই কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে বা হতে পারে ভেবে তৈরী করেছেন মালয়েশিয়ান উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ জাগাতেসান। আমাদের এই বাংলায় ফলদায়ক হতে পারে ভেবেই জাগাতেসানের মডেলের আলোকে এই লেখা।
আমাদের মতো দেশে রাজনীতিকগন জীবন থেকে রাজনীতির পাঠ নেন, কিন্তু বেশীরভাগেরই প্রাতিষ্ঠানিক বড় ডিগ্রী থাকে না। একদা ব্রিটিশ কলোনির এই দেশের বেশীরভাগ রাজনীতিবিদগণ বাংলা ভাষার বাইরে, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ নন যদিও তাঁরা আইনপ্রণেতা বা মেম্বার অফ পার্লামেন্ট (এমপি)। আমরা ব্রিটিশ আইনের উত্তরাধিকারী তাই আইন প্রণেতাদের জন্য ইংরেজি জানা খুব জরুরি। ভাষা দক্ষতার ঘাটতির কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের পক্ষে আইনের খসড়া করেন আমলারা। উন্নত দেশের প্রায় ৮০ ভাগ সাংসদ আইনে ডিগ্রিধারী হয়ে থাকেন। যাতে আইন প্রণয়নে তাঁদের কারও উপর নির্ভর করতে না হয়। কারণ যিনি আইনের খসড়া করবেন, মনের অজান্তেই ওই আইনের খসড়ায় তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রতিফলিত হবে। এই প্রতিফলিত মত দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক নাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে মুষ্টিমেয় কিছু রাজনীতিক আছেন যারা খুব জ্ঞানী আইন প্রণয়ন সম্পর্কেও যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। বাকীরা পুরোপুরি আমলা নির্ভর। আইন প্রণয়নে আইনী শব্দ চয়ন ও তার প্রয়োগ খুব জটিল বিষয়। স্থান কাল পাত্র ও বাক্যে তার প্রয়োগ ভেদে একই শব্দের অনেকগুলো অর্থ হয়ে থাকে। শব্দ বাক্যের কথায় বসানো হচ্ছে তার উপর অনেক সময় ঐ শব্দের অর্থের ভিন্নতা আসতে পারে। রাজনীতিকগন বেশীরভাগ সময় এলাকার বা দেশের মানুষের সমস্যা আর তার সমাধান নিয়ে কাজ করেন, শব্দের মার প্যাঁচ নিয়ে কাজ করা তাঁদের হয়ে ওঠে না। তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাদা মনে কাজ করতে চান, যাতে তিনি পূনরায় নির্বাচিত হতে পারেন। রাজনীতিবিদগন সবাই ধোয়া তুলসি পাতা নন তার পরেও অধিকাংশ ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান বা রাজনীতিক সালাম পাবার জন্য রাত দিন কাজ করেন, তাঁদের কোন অফিস টাইম নেই, ছুটির দিন নেই। চট্টগ্রাম এলাকারদেশপ্রেমীক এক সাবেক এমপি (সাংসদ) সম্প্রতি টাকার অভাবে ধুকে ধুকে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন যদিও প্রধানমন্ত্রী শেষ মুহূর্তে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। অতি সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে মিতব্যায়ী সরকার প্রধান।
এবার আসি ব্যাবসায়ীদের কথায়। সৎ ব্যাবসায়ীগণ দেশের উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী। তাঁরা তাঁদের মেধা, শ্রম ও অর্থ দিয়ে নিজের তথা সমাজের উন্নয়নে সব থেকে বেশী ভূমিকা রাখেন। উন্নয়নে লাগে টাকা, আর এই টাকার যোগানদাতা দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ। আমাদের দেশের মোট আহরিত রাজস্বের যোগান দেন বৃহৎ করদাতা ইউনিটসমূহ। দেশের ও বিদেশের চাহিদা বিচার করে দেশের মধ্যে উৎপাদন, রপ্তানী বা আমদানী আর বিপণনের মাধ্যমে দেশের চাহিদা মিটিয়ে নিজে ও দেশকে লাভবান করেন। তাঁরা এই করেই দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করেন। আমাদের দেশের গার্মেন্টস, ওষুধ, চামড়া, চা, পাট, ইত্যাদি শিল্পের দিকে তাকালেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার মানসিকতার অসাধু ব্যবসায়ী যেমন আছে, তেমনি আছে অনেক সৎ ব্যবসায়ী। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের চাহিদা, তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে রাজনীতিবিদগণকে তাঁরা পরামর্শ দেন যাতে শিল্পের বিকাশ তথা দেশের উন্নয়ন হয়। এই কাজে তাঁরা আমলাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেন।
বাংলাদেশ সরকারের রুলস অফ বিজনেস ১৯৯৬ (জুলাই ২১২ সালে সংশোধিত) আর সচিবালয় বিধিমালা ২০১৪ দেখলে বুঝা যায় যে, সরকারী কর্মকাণ্ডের গুরুদায়িত্ব আমলাগনের উপর। সরকারের নীতি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য মন্ত্রী, এমপিদের সংসদের বাইরের কোন কাজের দায় নেই, যদি প্রধানমন্ত্রী বিশেষ কোন নির্দেশ না দিয়ে থাকেন। উল্লেখিত আইনে বলা হয়েছে যে, একজন সচিব তাঁর মন্ত্রণালয়ের চীফ একাউন্টিং অফিসার। তাই দেশের উন্নয়নে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সকল পক্ষের মাঝে সেতু বন্ধনের কাজ করেন এই আমলাগণ। প্রতি ৫ বছর পরে বা তার আগেও মন্ত্রী/ প্রধানমন্ত্রী চাকরি চলে যেতে পারে কিন্তু আমলাদের চাকরি যায় না। বড় জোর তাঁদের ওএসডি (কাজ না করিয়ে বেতন দেওয়া) করা হয় বা এক মন্ত্রণালয় থেকে অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। একাবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ঢুকলে তার পরে বড় কোনো অপরাধ না করলে আমলাদের চাকরি একদম পাকা। রাজনীতিবিদগণের মতো ৫ বছর অন্তর অন্তর ভোটের মত কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়না। তাঁরা বিগত ও বর্তমান সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ডের তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণ করেন। তাই দেশ ও জাতির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রতিটি স্তরে সৎ আমালাগণের তথা প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এবার আসি ট্রাইএঙ্গেলের কথায়। প্রথমেই দেশপ্রেমিক সৎ রাজনীতিবিদ, সৎ আমলা আর সৎ ব্যাবসায়ী যারা দেশের সার্বিক উন্নয়ন চান, তাঁদের চিহ্নিত করতে হবে। এসব সৎ রাজনীতিবিদ, সৎ আমলা আর সৎ ব্যাবসায়ীদের নিয়ে মন্ত্রনালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগকে টার্গেট করে তার অধীন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আওতাধীন বিষয়গুলোর উন্নয়নের জন্য গঠিত হবে ভিন্ন ভিন্ন কমিটি। এই কমিটিসমূহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের/ বিভাগের সকল খাত বা উপ-খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়ন বা পরিবর্তন সাধনের সমস্ত দায়ভার গ্রহন করবেন, সরকার প্রধানকে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা দেবেন। দেশের মানুষের নাড়ীর খবর রাখেন রাজনীতিকগণ তাই তাঁরা জনগনের মতামতের প্রতিফলন ঘটাবেন আইন প্রণয়নে, প্রয়োগে বা পরিবর্তন সাধনে। আমলাগণ তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলবেন এই ধরণের আইন প্রণয়নে, প্রয়োগে কী কী সমস্যা আগে হয়েছে বা ভবিষ্যতে হতে পারে যাতে দেশের, জনগণের ক্ষতি হয়। আর ব্যবসায়ীগন এসব কিছুর অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় নেবেন। কমিটির যারা যে যে খাতের সাথে বর্তমানে জড়িত, অভিজ্ঞ, তাঁরা সেই খাতের বা উপ-খাতের সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্য হবেন। যাতে করে কেউ কোন ভাবেই সংশ্লিষ্ট খাতের উন্নয়নের ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যেতে না পারেন। অথবা আইনের ফাঁক গলে কেউ যেন অন্যায় করে পার না পায়, আইনের ফাঁক ফোঁকর গলে রাতারাতি কেউ কোটিপতি বনে যেতে না পারে। দেশের জনগণ যেন চরম ক্ষতির মুখে না পড়ে। সমন্বয়ের অভাবে যেন ফ্লাড টাকার অপচয় না হয়। আন্তঃমন্ত্রনালয়/ বিভাগ সমন্বয়হীনতা যেন জনগনের জানমালের ক্ষতির কারণ না হয়।
ট্রাইএঙ্গেল করতে হবে সমন্বহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে। উন্নয়নে নিজের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর ব্লেইম গেম বন্ধ করতে? বিশ্ববানিজ্য আর বিশ্বঅর্থনীতির খোঁজখবর রাখেন ব্যবসায়ী আর আমলাগণ। তাই এর সাথে সঙ্গতি রেখে সরকারের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব আহরণে প্রতি বছর সরকার বাজেট প্রণয়ন করে থাকে। বাজেটের পরেই এফবিসিসিআইএর বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান তাদের পক্ষ থেকে নানা অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকে। কারণ অনেক সময় এখানে থাকে সংশ্লিষ্ট পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। অনেক সময় এর যৌক্তিক কারণ ও থাকে, যা ধরা পড়তে সময় নেয় কিন্তু তা সংশোধনে সময় লাগে এক বছর মানে পরবরতী বাজেট। কিন্তু কোন কোন সময় এই এক বছরেই ঐ খাতের বিপুল ক্ষতি হয়ে যায় যা পাঁচ বছরেও পুশিয়ে নেওয়া যায় না। বাজেটের আগে পরে তথ্য বিক্রির অনেক অভিযোগ পায়া যায়। আবার বলা হয় শিল্পপতিদের অমুক গ্রুপ প্রভাব খাটিয়ে বাজেটে তাদের জন্য সুবিধা আদায় করে অমুক অমুক শিল্পগ্রুপকে লোকসানের মুখে ফেলেছে। এই বিতর্ক বেশ পুরাতন তাই এখন বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের পক্ষ থেকে এখন এমপি হওয়ার জন্য সম্ভাব্য বিজয়ী দলের টিকেট কেনার প্রতিযোগিতা হয় মোটা অঙ্কের টাকায়। অভিযোগ আছে যে, নিজেদের মধ্যে গ্রুপ তৈরী করে একটা বিশেষ শিল্পখাতের জন্য বাড়তি সুবিধা নিচ্ছেন ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদগণ। এঁদের সাথে যুক্ত হচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত আমলা। যারা কর্মজীবনে সারাটা সময় রাজনিতিকদের গালি দিয়েছেন তাঁদের অনেকেই অবসরে গিয়ে রাতারাতি হয়ে হচ্ছেন রাজনীতিবিদ, হচ্ছেন পার্লামেন্ট মেম্বার (এমপি)। ফলে তিনি যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ছিলেন, তার চাকরীকালীন সময়ের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
আমাদের দেশ উন্নয়নের বুলেট ট্রেনে উঠেছে বলে যারা দাবী করছেন তাঁরা শুধু কি দৃশ্যমান উন্নয়নের পক্ষে কথা বলবেন নাকি অদৃশ্য উন্নয়ন তথা বাংলার মানুষের আত্মিক উন্নয়ন নিয়েও ভাববেন? বাংলার মানুষের আত্মিক উন্নয়ন না হলে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কার্যকর সুফল কি ঘরে আসবে?
লেখক:সায়েদুল আরেফিন
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭