ইনসাইড থট

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বিতর্ক : স্বাধীনতা ও বাস্তবতা


প্রকাশ: 18/08/2023


Thumbnail

ছোটবেলাতে একটি কবিতা পড়েছিলাম। “স্বাধীনতার সুখ” নামে  রজনীকান্ত সেনের কবিতাটি এই রকম : “কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই, আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোধ, বৃষ্টির, ঝড়ে।”বাবুই হাসিয়া কহে, “সন্দেহ কি তাই ?কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়।পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।”

এ ধরনের একটি কবিতা একটি শিশুর মনে স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার চেতনা জাগ্রত করে বলেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন হতে পেরেছিলাম।  কিন্তু সেই স্বাধীনতা দেশি ও বিদেশী চক্রান্তে সীমিত বা শৃঙ্খলিত হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধুকে আজ আমরা অনেক অনেক বেশি স্মরণ করি কিন্তু স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে একটি মহল নানা ভাবে চেষ্টা করছে। পত্রিকাতে সংবাদ দেখছি- ভারত-যুক্তরাষ্ট্র নাকি ঠিক করবে আমাদের নির্বাচন ব্যাবস্থা! তাহলে কোথায় আমাদের স্বাধীনতার চেতনা? কাদের চক্রান্তে আমাদের স্বাধীনতা সংকুচিত? 

১৯৭১ সালে যারা আমাদের স্বাধীনতা চায়নি যারা তারা কি তবে পুনরায় সক্রিয় ? স্বাধীনতা আর বাঙালি সেতো একই পরিচয় একই চেতনা যার জন্য ৩০ লক্ষ নারী -পুরুষ-শিশু শহীদ হয়েছেন।  সেই বাঙালিত্বকে তবে তারা মুছে ফেলতে চায় ? এমন একটি কবিতা শিশুর মনে স্বাধীনতার বীজ বপন করতে যারা নির্বাচন করে ছিলেন সেই মহাপুরুষদের কাছে  জাতি হাজার বছর ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ঋণ শোধ করতে পারবে বলে মনে হয় না।

আমাদের কাছারি ঘরে ছিল চড়ুই পাখির বাসা।আর আমাদের স্কুলের পাশে ছিল একটি তালগাছ -সেখানে ছিল বাবুই পাখির বাসা।কাছারি ঘরে রাখা বেঞ্চে শুয়ে আর স্কুল এর কাছে যেয়ে কবিতাটি মনে পড়তো- উপলব্ধি করতে চেষ্টা করতাম স্বাধীনতা সুখকে মুক্তির স্বপ্ন বীজ বপন করে- শিক্ষাই একমাত্র মুক্তির পথমনে করে জানার সংগ্রামে শিক্ষকের সামনে বুক ফুলিয়ে  হয়ে হাজির হতাম।এর পর এলো ১৯৭০ সাল। জাতীয় নির্বাচন।এলো ১৯৭১ সাল- আনন্দ আর কষ্টে ভরা স্বাধীনতার বছর।বিজয়ের আনন্দে বাঙালি ভুলে গেলো হারানোর বেদনা।আমরা স্বাধীন হলাম।নিজে হাতে গড়া দেশ পেলো জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে।আমরা বাবুই পাখির সুখ পেতে শুরু করলাম।  

স্বাধীনতা আমাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিলো যে সব পেশা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখেছিলাম। ৯ম বিসিএসে সরকারি চাকরি পেয়েও হাত ছাড়া করলাম।এতবড় একটি ঝুঁকি কিভাবে নিলাম জানিনা। এবং স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দিলো।পাশ করবার তিনবছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে চাকরি পেলাম।সেই আনন্দে ভুলে গিয়েছিলাম অনেক কিছু। স্বপ্ন পূরণ ও স্বাধীনতা যেন এক সঙ্গে হাতে পেয়ে গেলাম।নিজের আয়ে নিজের জীবন পরিচালনার স্বাধীনতা।

নানা ঘাত- প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলছিল জীবন।২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় এসে জারি করলো নির্দেশ বিদেশে যারা ছুটি নিয়ে গেছে তাদের ফিরে যেতে হবে দেশে-বেগম খালেদা জিয়ার হুকুম। সরকারি চাকরিজীবিরা  একান্ত বাধ্যগত কর্মচারীর নিদর্শন স্বরূপ অনেকেই দেশে ফিরলেও আমি ফিরে আসিনি।নেমেছি নতুন এক সংগ্রামে।" সোনার বাংলা " পত্রিকার মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তুলেছি অস্ট্রেলিয়ার শহরগুলোতে।  

কিন্তু লড়াইয়ের যেন শেষ নেই।  ২০০৭ সালে আবার এলো আরেক সরকার।তিনমাসের মধ্যে নির্বাচন না দিয়ে তারা কাটালো ২২ মাস।তাদেরকে নামাতেও আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে।সাইবার যুদ্ধ শুরু সেই সময়ে।  

স্বাধীনতার সুখ যেন আমাদের জন্য নয়।  ২০১১ সালে ৩৮ বছর ধরে ভোগ করা স্বাধীনতাকে কেঁড়ে নেয়া হলো।তিন মাসের বেশি সময়ের জন্য ছুটি নিতে হলে যেতে হবে মন্ত্রণালয়ে।উপাচার্য ছিলেন আচার্যের পরেই।  সেই অধিকারটি কেঁড়ে নেয়া হলো এরকম একটি পরিপত্র জারি করে- সংসদকে যে অবমাননা করা হলো সেই কথাটিও কেউ বললোনা!?।কোন প্রতিবাদ এলোনা কোনো পক্ষ থেকে।আর উপাচার্যরা সে কি উচ্চকিত ওই ক্ষমতাহীন আইন বাস্তবায়নে।    

দিন দিন কেবল উপাচার্যের ক্ষমতায় কেঁড়ে নেয়া হয়নি উপাচার্যকে বানানো হয়েছে একান্ত অনুগত কর্মচারী।এর সর্বশেষ সংস্করণ হলো Annual Performance Agreement বা APA। জবাবদিহিতার নামে উপাচার্যকে বিভিন্ন ফোরামে হাজির করে তিরস্কার করা হয়।"অভিপ্রায়" বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধান্বিত হয় না তারা - স্পষ্ট কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক স্বাধীনতা নেই তাই তাদের হুকুম মানতে হবে।  জনগণের টাকার হিসেব তাদেরকে দিতে হবে।  শিক্ষক কি তবে আর বিবেকবান নন ? তিনি কি অবিবেচকের মতো স্বার্থপর হয় গেছেন? আর অনুগত কর্মচারীকে  রাজনৈতিক চাপে দিয়েছেন মানহীন শিক্ষক, নিম্নমানের কর্মচারী -কর্মকর্তা।যদি সেখানে তিনি থামাতেন তাহলে হয়তো স্বাধীনতার কথা বলা যেত জোরালোভাবে।কিন্তু  না ওনারা পরিবার পরিজন নিয়োগ দিয়ে জাতির কাছে শিক্ষক সমাজকে বন্দি করেছেন। 

আমরা উপাচার্যদের কর্মকান্ড সম্পর্কে নানা সংবাদ পড়ে মর্মাহত হয়েছি।শিক্ষক পরিচয় দিয়ে তাই আজ মাথাটা নিচু করে চলে আসি।দিনের পর দিন ঢাকায় বসে ঢাকার বাইরের উপাচার্য ও তার টীম কাজ করেন। কর্মস্থলে নাম মাত্র থাকেন।আর যারা ঢাকা বা বিভাগীয় শহরে আছেন তারা কেউ কেউ নাকি দুপুর ১২ টার পর অফিস যান।অথচ তাদের কর্মস্থলে থাকা বাঞ্ছনীয়।  

শিক্ষক নিয়োগে যেমন আছে স্বজন প্রীতি তেমনি আছে দুর্নীতি।ক্ষোভে তাই পত্রিকার পাতায়, ফেসবুকের পোস্টিংয়ে শিক্ষকদের নিয়ে চলে বিষাদগার।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর সেই আদর্শ শিক্ষক নেই বলে সমাজের অভিমত।এখন ১৫৬ বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি ১৬ হাজার শিক্ষক আছেন। এবং সেখানে শোনা যায় নিয়োগ বাণিজ্য!  

আর এই দুর্দশা থেকে মুক্তির জন্য চিন্তা করা হচ্ছে শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠনের।ইতিমধ্যে জারি করা হয়েছে অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা।এর পর এসেছে অর্থ ব্যয়ের অভিন্ন নীতিমালা।এবার শিক্ষক নিয়োগ হৰে বাইরে থেকে।বিশ্ববিদ্যালয় হবে উচ্চমানের কলেজ।  

যারা লোভী শিক্ষক তারা আছেন কিভাবে ওই কমিশনের সদস্য হওয়া যাবে স্বপ্নে!এভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষরা পরাধীনতার জিঞ্জির জাতির গলাতে পরিয়েছিলেন কিছু লোভী মানুষ।তাই আর শিক্ষক পরিচয় নিয়ে অনেকেই জীবন ধ্বংস করতে নারাজ।বিদেশ গিয়ে আর ফিরে আসছেন না অনেকে।

বঙ্গবন্ধু আপনার দেয়া স্বাধীনতাকে আমরা কিভাবে অপব্যাবহার করেছি তার হিসেবে দিয়ে শেষ করা যাবে না। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে আমরা কেবল বঙ্গবন্ধুকে হারাইনি, আমার হারিয়েছি আমাদের স্বাধীনতার সুখ পাখিটিকে।আমরা নতুন করে পরাধীনতার জিঞ্জির স্বেচ্ছায় পরেছি।  

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ যেমন চরম বিতর্কিত হয়েছে তেমনি বিতর্কিত উপাচার্য নিয়োগ।সেই বিতর্ক থেকে হয়তো একজন আমলাকে নিয়োগ দেয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে।কারণ তাদের খুশি করতে আমাদের শিক্ষকরাই দিয়েছেন বিতর্কিত পিএইচডি।আজ যেমন বিভিন্ন কমিশন আমলাদের দখলে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ কমিশনের সকল কর্তা ব্যক্তি হবেন আমলা।  আর এভাবেই বঙ্গবন্ধুর দেয়া ১৯৭৩ সালের স্বাধীনতার দলিল হবে একটি কাগজের ফুল।  

সমাজের অভিমত এখন নাকি বিদ্যা চর্চা হয়না বিশ্ববিদ্যালয়ে।  শিক্ষার্থীরা আসেন কিভাবে একটি সনদ পাওয়া যাবে বিসিএস আবেদনের জন্য।  আর সেজন্য বেশি ভালো শিক্ষকের প্রয়োজন নেই বলে অনেকে যুক্তি দেবেন হয়তো - চমৎকার একটি যুক্তি বটে! তারা আরও যুক্তি দেবেন গার্মেন্টস , কলকারখানার শ্রমিক পাওয়া গেলেই দেশ চলবে।  এভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার নীলনক্শায় আমরা যে কখন বন্দি হয়ে গেছি নিজেদের অজান্তে তা ভেবে কেবল শিহরিত হই!  

১৫ আগস্ট কেবল আমরা জাতির পিতাকে ও তার পরিবারকে হারাইনি হারিয়েছি আমাদের স্বাধীনতার পাখিটাকে। সেখান থেকে মুক্তির জন্য আমাদের হয়তো আবার হাজার বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে যদি আমাদের চেতনা জাগরিত না হয়- চারিদিকে মোশতাকের পদধ্বনি শুনতে কি পাও? মোশতাকেরা কেবল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি- হত্যা করেছে আমাদের স্বাধীনতার সুখ পাখিটিকে।  



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭