ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

কেন সিঙ্গাপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অর্থ পাচারকারীরা


প্রকাশ: 20/08/2023


Thumbnail

পাচার করা টাকা লুকিয়ে রাখার জন্য সিঙ্গাপুর অনেকেরই পছন্দের জায়গা। সিঙ্গাপুরকে একারণেই এশিয়ার ‘বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট বলা হয়। আবার কর ফাঁকির ‘অভয়ারণ্য বলেও এর কুখ্যাতি আছে। কিন্তু, এখন আর সিঙ্গাপুরকে কর ফাঁকির অভয়ারণ্য মনে করা যাচ্ছে না। অনেক অর্থ পাচারকারীই এখন সিঙ্গাপুর থেকে অন্য কোথাও চলে চাচ্ছেন। অনেকে চলেও গেছেন। অর্থ পাচারকারীদের নতুন গন্তব্য দুবাই ও সাইপ্রাসের মতো এলাকা, যেখানে অর্থ লুকিয়ে রাখা সম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই অর্থ পাচারকারীরা চলে যাচ্ছেন সিঙ্গাপুর থেকে।

 সিঙ্গাপুরে ২০১৬ সালে গঠন করা হয় দ্য ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স। ২০১৮ সালে পাস করা হয় অ্যান্টিমানি লন্ডারিং অ্যান্ড টেররিজম ফাইন্যান্সিং আইন। তাতেও কাজ হচ্ছিল না। ফলে আরও কঠোর আইনের দিকে যায় দেশটি। এরপর ২০২৩ সালে সিঙ্গাপুর আরও কঠোরভাবে ‘নিউ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং অ্যান্ড টেররিজম ফাইন্যান্সিং আইনটি পাস করে। এটি ২০২৩ সালের ২৮ জুন থেকে কার্যকর করা হয়েছে। আর এরপরই ভয় পেয়েছেন সিঙ্গাপুরে থাকা বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচারকারীরা, যাঁরা দেশটিতে নামেবেনামে কোম্পানি খুলেছিলেন বা কিনেছিলেন হোটেল, গাড়ি, বাড়িসহ নানা ধরনের সম্পত্তি।

 নতুন আইন অনুযায়ী গত ২৮ জুন থেকে দেশটির রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের নতুন কিছু বিধিমালা মানতে হচ্ছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারকে গ্রাহকের যথাযথ পর্যালোচনা (কাস্টমার ডিউ ডিজিলেন্স-সিডিডি) করতে হবে, সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য জানাতে হবে এবং লেনদেনের রেকর্ড পাঁচ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে। অর্থাৎ অবশ্যই ক্রেতা কে, কোন দেশের নাগরিক এবং অর্থের উৎস যাচাই করতে হবে। যিনি কিনবেন তাঁর প্রকৃত পরিচয় থাকতে হবে। অজ্ঞাত, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বা ছদ্মনামের কারও কাছে কোনো সম্পত্তি বিক্রি করা যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে জরিমানার পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ এক লাখ সিঙ্গাপুর ডলার। আর যদি কেউ স্বেচ্ছায় বা জেনেশুনে এসব কাজে সম্পৃক্ত থাকেন, তাহলে জেল তো হবেই, ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল থাকবে সর্বোচ্চ ১২ মাস পর্যন্ত।

সব মিলিয়ে কাজটি কীভাবে হবে, তার একটি গাইডলাইনও প্রকাশ করা হয়েছে। ৫৩ পৃষ্ঠার গাইডলাইনের নাম হচ্ছে ‘গাইডলাইনস ফর ডেভেলপার অন অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কাউন্টার টেররিজম ফাইন্যান্সিং’। এমনকি এই আইন পাস হওয়ার আগে লেনদেন হলে সে ক্ষেত্রেও নতুন এই বিধিমালা প্রযোজ্য হবে।

 এদিকে, দ্য মনেটরি অথরিটি অব সিঙ্গাপুর (এমএএস) হচ্ছে মূলত দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা আরও ছয়টি বড় ও প্রধান ব্যাংকের সঙ্গে মিলে কসমিক নামে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। কসমিকের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, ব্যাংকের আর্থিক অপরাধের ঝুঁকি কমানো। মূলত তিনটি কাজ করবে তারা। যেমন বৈধ ব্যক্তির অপব্যবহার বা শেল কোম্পানির অপব্যবহার, অবৈধ কাজে বাণিজ্য অর্থায়নের অপব্যবহার এবং যেকোনো ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র (পারমাণবিক, রাসায়নিক) তৈরির উপাদান উৎপাদন, মজুত বা সরবরাহ বন্ধ করতে এর অর্থায়ন বন্ধ করা।

কসমিকের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পরের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করবে এবং আর্থিক অপরাধ ঘটার সুযোগ আছে, এমন বিষয়গুলো চিহ্নিত করবে। কোনো ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন দেখলে তা তারা জানাবে।

সিঙ্গাপুরের সংসদ গত ৯ মে এ বিষয়ে একটি আইন পাস করে। আইনের নাম ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অ্যান্ড মার্কেটস (সংশোধন) বিল ২০২৩। নতুন আইনে যাঁরা অফশোর বা শেল কোম্পানির আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন, তাঁদের চিহ্নিত করা হবে।

২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এই কসমিক চালু হবে। সুতরাং যাঁরা অন্যের নামে সেখানে সম্পত্তি করেছেন এবং পাচার করা অর্থ নামে-বেনামে ব্যাংকে লেনদেন করছেন, তাঁরা বড় বিপাকে পড়বেন কসমিক চালু হলে।

 প্রসঙ্গগত, গত মঙ্গলবার বিদেশ থেকে পাচার করে আনা প্রায় ১০০ কোটি ডলারের অর্থসম্পদ জব্দ করেছে সিঙ্গাপুর পুলিশ। সিঙ্গাপুর পুলিশ ফোর্স (এসপিএফ) পরিচালিত এই অভিযানকে দেশটির ইতিহাসে মানি লন্ডারিংবিরোধী সবচেয়ে বড় অভিযানগুলোর একটি বলা হচ্ছে।

 এ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নারীসহ ১০ জনকে। এ ছাড়া আরও ১২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। আর আটজন সন্দেহভাজন পলাতক। এই ব্যক্তিরা ধনী এলাকার বাসিন্দা। তাঁরা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। বিলাসী জীবন যাপন করতেন। সিঙ্গাপুরের পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবারের অভিযানে ৯৪টি জমি এবং ৫০টি গাড়ির নামে নিষেধাজ্ঞা আদেশ জারি করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, মালিকেরা এসব জমি ও গাড়ি বিক্রি করতে পারবেন না। এসব জমি ও গাড়ির মোট মূল্য ৮১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বেশি। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ মদের বোতল জব্দ করা হয়েছে। অভিযানে ৩৫টির বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। এসব অ্যাকাউন্টে ১১ কোটি ডলারের বেশি অর্থ জমা রয়েছে। এ ছাড়া জব্দের তালিকায় রয়েছে অনলাইনে সম্পদ থাকার ১১টি নথি, ২টি সোনার বার, ২৫০টির বেশি দামি ব্যাগ ও ঘড়ি, ১২০টির বেশি মুঠোফোন ও কম্পিউটার, ২৭০টির বেশি দামি অলংকার। জব্দ করা অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের বেশি।

 এমএএস এই ঘটনার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দিয়েছে। সেখানে তারা বলেছে, অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য সিঙ্গাপুরের আর্থিক খাতের অপব্যবহার তারা আর সহ্য করবে না। অভিযানটি পরিচালনা করেছে দেশটির কমার্শিয়াল অ্যাফেয়ার্স বিভাগ। মূলত তাদের অর্থের লেনদেন যে সন্দেহজনক সেই তথ্য এমএসকে সরবরাহ করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি গোয়েন্দা তথ্যও ছিল। মিথ্যা তথ্য ও জাল কাগজ ব্যবহার করে ব্যাংক হিসাব খুলে লেনদেন করা হয়েছিল।

 যেহেতু, অবস্থা এমন বেগতিক তাতে সিঙ্গাপুর থেকে যে অনেকেই পালাতে চাইবেন, সেটিই স্বাভাবিক।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭