ইনসাইড থট

ফ্যাসিবাদের আসল চেহারা একুশে আগস্ট


প্রকাশ: 21/08/2023


Thumbnail

প্রতি বছর ২১ আগস্ট এলে একটা প্রশ্ন মাথায় আসে এবং তা হলো ২০০১ এর নির্বাচনের পর যে বাংলাদেশ আমরা দেখছিলাম তার শাসক বিএনপি-জামাত জোট সরকারের রাজনীতির শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? সেই নির্বাচনে জেতার পর দেশব্যাপী ধর্ষণের উৎসব, সংখ্যালঘু নির্যাতন, বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা, সারাদেশে নৈরাজ্য এগুলো ছিল শাসনামালের পুরো সময়টাতেই। কিন্তু রাজনৈতিক খুন এক ভিন্ন বিষয়। একের পর এক ঘটনা ঘটছিলই। তবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রীসহ তার দলের পুরো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বিলীন করে দেওয়ার জন্য যে কাজটি করেছিল, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। 

আমাদের রাজনীতির একটা চরিত্র আছে, বৈশিষ্ট্য আছে সে সারাক্ষণ প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের চেষ্টা করে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টায় প্রকাশ্য হত্যা চলে না, অনেকটা অজান্তে রক্তপাত হয়। হত্যাও হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার দলের পুরো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বসহ যেভাবে গ্রেনেড মেরে হত্যার চেষ্টা করেছিল, সেটি কোনও স্বাভাবিক রাজনৈতিক বিরোধিতা ষড়যন্ত্র ছিল না।

রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিমাপ করতে গেলে বিশ্বে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা কমই পাওয়া যাবে। যে সরকারের আমলে এমন একটি ঘটনা ঘটবে, তার একটি দায় স্বাভাবিকভাবে তাকেই নিতে হবে। কিন্তু এই ঘটনায় যেভাবে তদন্তের নামে ভুয়া জজ মিয়া নাটক প্রদর্শিত হয়েছে, শেখ হাসিনা নিজেই শাড়ির আঁচলে করে গ্রেনেড নিয়ে গেছেন বলে যেভাবে সংসদে দাঁড়িয়ে সরকারদলীয় লোকজন হাস্যরস আর কৌতুক করেছেন, এতে আর কোনও সন্দেহ থাকে না এই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল তৎকালীন সরকারের পরিকল্পনাতেই। উদ্দেশ্য ছিল আরেকটি ১৫ আগস্ট সৃষ্টি করা।

এই ঘটনার সঙ্গে বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব এবং সরকারের মেশিনারিজ জড়িত ছিল বলেই তদন্তের নামে সব আলামত নষ্ট করা হয়েছে। 

একুশে আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিকে চিরস্থায়ীভাবে বিভাজিত করেছে। অবিশ্বাসকে পাকাপোক্ত করেছে আর দল হিসেবে বিএনপি চিরদিনের জন্য একটি সহিংস জঙ্গি চরিত্র পেয়েছে। 

সত্যি বলতে কী, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বাংলার মাটিতে নতুন নয়। রাজনীতির মূল্যবোধের অবক্ষয় পুরোনো কথা। মতাদর্শের রাজনীতি ভুলে যাওয়া হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু ২০০২ সালের নির্বাচনে জিতে তারেক রহমানের প্রভাবে বিএনপি-জামায়াতের যে প্রতিহিংসার রাজনীতি জাতি দেখছিল তা অতুলনীয়। বিভাজনের কৌশল, বিদ্বেষের মেরুকরণ, গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে ভয় দেখানো, সংখ্যালঘু নির্যাতনকে সংস্কৃতিতে পরিণত করা, বদলা নেওয়ার রাজনীতিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উল্লেখ করার মতো কোনও সত্যিকারের কল্যাণকর কাজ মানুষ মনে করতে পারবে না। 

বিএনপি এখন বিরোধী অবস্থানে। তারা গণতন্ত্রের কথা বলছে, সরকারের দমন নিপীড়নের কথা বলছে। কিন্তু এই একটি দিনে দলটি আয়নায় নিজের মুখ দেখে কী? 

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শেখ হাসিনা একটি ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে নির্ধারিত জনসভায় বক্তৃতার শেষ মুহূর্তে হামলাটি হয়। যেসব গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল এগুলো প্রশিক্ষিত সেনা সদস্যরা যুদ্ধে ব্যবহার করে। ওই দিন গেনেড ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় দলের ২৩ জন নেতাকর্মী, পরে হাসপাতালে মারা যান মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভি রহমান। আহত হয়েছেন শত শত নেতাকর্মী। মঞ্চে থাকা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মানববর্ম সৃষ্টি করে শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়েছেন।

কেন বলা হচ্ছে সরকারের এবং তৎকালীন শাসক দলের পরিকল্পনাতেই এই হামলা হয়েছে? কয়েকটি বিষয় তাৎক্ষণিকভাবেই বোঝা গেছে। হামলার পর যে দৃশ্য ছিল তা হলো - রক্তে ভেজা রাজপথ, মানুষের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছড়ানো চারদিকে। আশপাশের দোকানদার, সাধারণ মানুষ সাহায্যের জন্য ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু পুলিশ? তারা কাঁদানো গ্যাস ছুড়েছে, সাধারণ মানুষকে লাঠিপেটা করেছে; যেন আহত নিহতদের হাসপাতালে নেওয়া না যায়। হাসপাতালে দায়িত্বরত জাতীয়তাবাদী চিকিৎসকরা আহতদের চিকিৎসা না দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ফায়ার সার্ভিস ডেকে পানি ছিটিয়ে দ্রুত রক্তের দাগ মুছে ফেলতে চেয়েছে সরকার। আর পুলিশের উপস্থিতিতেই শেখ হাসিনাকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় তার গাড়িতে গুলি করা হয়েছে। এই সবকিছু প্রমাণ করে একটি রাষ্ট্রীয় ও দলীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছিল পুলিশ ও প্রশাসন। 

নানা তথ্য-উপাত্ত এবং আক্রমণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে যে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ বা হুজি নামের জঙ্গি সংগঠনের নেতা মুফতি হান্নান এই হামলার মূল কারিগর। আর তিনি এসব করতে বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতা ও সে সময়ের উপমন্ত্রী আবদুস সালামের সরকারি বাসায়। হান্নানকে আর্জেস গ্রেনেড সরবরাহ করেছে পিন্টুর ভাই মাঔলানা তাজউদ্দিন। আর মদদ দিয়েছে বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। খালেদা জিয়ার সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনএসআই, সিআইডি ও পুলিশের প্রতিটি বিভাগ একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। কোথা থেকে একজন নিরীহ জজ মিয়াকে হাজির করে, রাষ্ট্রীয় অর্থ তার পেছেনে খরচ করে নতুন গল্প বানাবার চেষ্টা করেছে। 

একুশে আগস্ট বিএনপির জন্য কলঙ্ক। এমন কলঙ্ক এই দল কোনোদিন মুছতে পারবে না। কিন্তু কেন এটা করেছিল তারা, সেই প্রশ্নের সুরাহা হওয়া দরকার। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যে ক্ষমতার পালাবাদল ঘটেছিল, তার বড় সুবিধাভোগী বিএনপি আর জামায়াত। বঙ্গবন্ধু কন্যার নিরন্তর লড়াইয়ে মাধ্যমে এই দল আবার ক্ষমতায় আসবে, এটা বুঝতে পেরে তাকেই সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল একুশে আগস্ট হামলা। 

২০০১-এ নির্বাচনে জিতেই দেশজুড়ে হিংসার উল্লাসে মেতেছিল জামায়াত-বিএনপি। সর্বাত্মক হিংসা ছাড়া কোনও রাজনীতি ছিল না এই সময়টায়। মুক্তিযুদ্ধ বিদ্বেষ, সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়াতে ছড়াতে নিজেদের সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান করার তাড়নায় তারা ভেবে দেখেছিল একমাত্র অন্তরায় বঙ্গবন্ধু কন্যা। তাকে সরাতে পারলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি তো বটেই, প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি চিরতরে অস্তিত্বহীন করে ফেলা সম্ভব হবে। ভয়াবহতম হিংসাত্মক রাজনীতির ন্যক্কারকজনক হামলার উদ্দেশ্য ছিল, নিজেদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা। সেটা করতে পারলে, মুক্তিযুদ্ধের অপ্রতিরোধ্য চেতনাকে নস্যাৎ করা সম্ভব হবে। যতদিন একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার দগদগে স্মৃতি থাকবে, ততদিন কোনও ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা সম্ভব নয় এদেশে। চিরস্থায়ীভাবে বিভাজিত পথেই চলবে রাজনীতি। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাংলাদেশ, অন্যদিকে ১৫ আগস্টের বেনিফিশিয়ারি একুশে আগস্টের হত্যাযজ্ঞ ঘটানো বাংলাদেশ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি।

এখন ঘটনার বিচারিক প্রক্রিয়া চলছে। সেই প্রক্রিয়া শেষ হতে আর কতদিন লাগবে, সেটা আমরা জানি না। কিন্তু যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এতগুলো মানুষকে মারা হয়েছে, সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করা হয়েছে তার অনুপুঙ্খ তদন্ত অবশ্যই জরুরি। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে, সেই সময়ের শাসক দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এটি ছিল রাজনীতির এক পরিকল্পিত দুর্বৃত্তায়ন। ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা করে গণহত্যার ঘটনা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ এই ঘটনার মাধ্যমেই ১৯৭৫-এর পর দুষ্কৃতায়নের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশে নতুন করে জন্ম লাভ করেছিল। ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদ বলে অনেক কথা বলা হয়, কিন্তু আমাদের সামনে ফ্যাসিবাদের আসল চেহারা একুশে আগস্ট। 

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭