ইনসাইড বাংলাদেশ

বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম


প্রকাশ: 06/09/2023


Thumbnail

সেপ্টেম্বর মাস বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার জন্ম মাস। এই সেপ্টেম্বর মাসেই দুনিয়ার নজরকাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্জনের উজ্জ্বল নেতৃত্বদানকারী বিশ্বনেতা রাষ্টনায়ক শেখ হাসিনা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ না করলে হয়তো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মুক্তি, আইনের শাসন এবং উন্নত বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের অবস্থান উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভবপর হতো না। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্ম ‘বাংলাদেশের আলোর পথযাত্রা’। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মমাসে ‘শেখ হাসিনা রচনা সমগ্র-১’ থেকে চতুর্থ পর্ব পাঠকদের জন্য তাঁর একটি লেখা তুলে ধরা হলো।

 

বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম

পর্ব -৪

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় বলেন, .... কিন্তু একটি কথা এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি, তাতে গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে জমি নিয়ে যাব। তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের পঁয়ষট্টি হাজার গ্রামে একটি করে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এ কো- অপারেটিভের জমি মালিকের থাকবে। কিন্তু তার ফসলের অংশ সবাই পাবে। প্রত্যেকটি বেকার, প্রত্যেকটি মানুষ – যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকেই কো- অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিলের যারা টাউট আছেন তাদেরকে বিদায় দেওয়া হবে। ...

আজকে আমার একটিমাত্র অনুরোধ আছে আপনাদের কাছে, আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে, জেহাদ করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে শত্রুর বিরুদ্ধে।  আজকে আমি বলব বাংলার -জনগণকে এক নম্বর কাজ হবে, দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। গণ- আন্দোলন করতে হবে, আমি গ্রামে গ্রামে নামব। এমন আন্দোলন করতে হবে যে ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশে চোরাচালান করে দেয় তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।

দ্বিতীয় কথা, আপনারা জানেন আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিন গুণ বেশি ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সে জমিতে ডবল ফলাতে পারব না, করতে পারব না, কেন ভিক্ষা করতে হবে!

আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে, যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্ট পরা কাপড় পরা ভদ্রলোক, তাদের কাছেও বলতে চাই, জমিতে যেতে হবে। ডবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন আজ থেকে ঐ শহীদদের কথা স্মরণ করে ডবল ফসল ফলাতে হবে। ভাইয়েরা আমার, একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে প্রত্যেক বছর আমাদের ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে তাহলে ২৫/৩০ বছরে বাংলার কোনো জমি থাকবে না হালচাষ করার জন্য। বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সে জন্য আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে। এটি হলো তিন নম্বর কাজ। এক নম্বর দুর্নীতিবাজদের খতম করা। দুই নম্বর হলো কলকারখানায়, ক্ষেতে-খামারে প্রোডাকশন বাড়ানো। তিন নম্বর হলো পপুলেশন প্ল্যানিং। চার নম্বর হলো জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য এক দল করা হয়েছে। ...

আমরা তো কলোনি ছিলাম। দুই'শ বছর ইংরেজদের কলোনি ছিলাম। পঁচিশ বছর পাকিস্তানিদের কলোনি ছিলাম। আমাদের তো সব কিছুই বিদেশ থেকে কিনতে হয়। কিন্তু তারপর বাংলার জনগণ কষ্ট করে কাজ করতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু তারা তাদের এগোতে, কাজ করতে দেয় না। আরেক বিদেশি সুযোগ পেল তারা বিদেশ থেকে অর্থ এনে বাংলার মাটিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করল। স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করল। আজ এ দিনে কেন বলছি একথা অনেক বলেছি, এত বলার দরকার ছিল না। কিন্তু আমার চোখের সামনে মানুষের মুখ ভাসে। আমার দেশের মানুষের রক্ত ভাসে। আমার চোখের সামনে আমারই মানুষের আত্মা। আমার চোখের সম্মুখে সে সমস্ত শহীদ ভাইয়েরা ভাসে, যারা ফুলের মতো ঝরে গেল, শহীদ হলো। রোজ কেয়ামতে তারা যখন বলবে – আমরা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম, তোমরা স্বাধীনতা নস্যাৎ করেছ। তোমরা রক্ষা করতে পারো নি, তখন তাদের আমি কী জবাব দেব?

আরেকটি কথা, কেন সিস্টেম পরিবর্তন? সিস্টেম পরিবর্তন করেছি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবার জন্য। সিস্টেম পরিবর্তন করেছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য। কথা হলো, এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, অফিসে যেয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যায়, সাইন করিয়ে নেয়, ফ্রি স্টাইল। ফ্যাক্টরিতে যেয়ে কাজ না করে টাকা দাবি করে, সাইন করিয়ে নেয়, যেন দেশে সরকার নেই। দেখলাম, অনুরোধ করলাম, কামনা করলাম, কেউ কথা শোনে না, চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।

ভাইয়েরা-বোনেরা আমার, আজকে যে সিস্টেম করেছি তার আগেও ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর কম ছিল না। আমি বিশ্বাস করি না ক্ষমতা বন্দুকের নলে। আমি বিশ্বাস করি ক্ষমতা বাংলার জনগণের কাছে। জনগণ যেদিন বলবে 'বঙ্গবন্ধু ছেড়ে দাও, বঙ্গবন্ধু তারপর একদিনও রাষ্ট্রপতি, একদিনও প্রধানমন্ত্রী থাকবে না। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার রাজনীতি করে নি। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষণহীন সমাজ কায়েম করার জন্য। দুঃখের বিষয়, তারা রাতের অন্ধকারে পাঁচজন পার্লামেন্ট সদস্যকে হত্যা করেছে, ৩/৪ হাজারের মতো কর্মীকে হত্যা করেছে। আর একদল দুর্নীতিবাজ টাকা-টাকা পয়সা-পয়সা করে। তবে যেখানে খালি দুর্নীতি ছিল সেখানে গত দুই মাসের মধ্যে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য আজকে কিছু করা হয়েছে।

শিক্ষিত সমাজের কাছে আমার একটি কথা, শতকরা কতজন শিক্ষিত লোক। তার মধ্যে শতকরা পাঁচজন আসল শিক্ষিত। শিক্ষিতদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন, আমি এই যে কথা বলছি, আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাক মার্কেটিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান করে কারা? হোর্ড করে কারা? এই আমরা, যারা শতকরা পাঁচজন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যে আছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্র সংশোধন করতে হবে, আত্মশুদ্ধি করতে হবে। দুর্নীতিবাজ শতকরা পাঁচজনের মধ্যে, এর বাইরে নয়।

বঙ্গবন্ধু শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছিলেন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। স্পষ্ট মনে আছে একবার আমি নিজে আলাপ করেছিলাম, তখন তিনি বলেছিলেন যে, এদেশে গণতন্ত্রের চর্চা হয় নি। বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার কীভাবে ভোগ করতে হয়, কীভাবে চর্চা করতে হয় তাও মানুষকে বুঝতে হবে, মানুষকে বোঝাতে হবে অধিকার অর্জন করলে তা কীভাবে ভোগ করতে হয়। আর অধিকার ভোগ করা মানে অপরের প্রতি কর্তব্য পালন করা। অপরের অধিকার রক্ষা করা কর্তব্য। এদেশে একটি বিপ্লব হয়েছে, গেরিলা যুদ্ধ হয়েছেবিরাট সামাজিক বিবর্তন আসবে। এ বিবর্তন সমাজে বিরাট পরিবর্তন আনবে। এ পরিবর্তন যাতে মানুষের অধিকার সংরক্ষণের কাজে লাগে, জনগণের কল্যাণসাধন হয় সেদিকে খেয়াল রাখা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য ।

শাসনতন্ত্রের এ পরিবর্তনে নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সামাজিক বিবর্তনে যে পরিবর্তন আসবে তাতে অনেক মানুষ অর্থশালী হয়ে পড়বে। নির্বাচন অর্থ ও লাঠির জোরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যারা সমাজসেবা করে, দেশসেবা করে, আত্মত্যাগ করে তাদের লাঠি ও টাকার জোর থাকবে না। যে নির্বাচন টাকা ও লাঠির জোরে হবে, সেখানে এ ধরনের আদর্শবান ত্যাগী মানুষের কোনো অবস্থান থাকবে না। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সত্যিকার দেশের সেবক যারা তারা যাতে নির্বাচিত হতে পারে তারই জন্য এ পরিবর্তন করা হলো। অন্তত একটি নির্বাচন যদি হয় তার পরই মানুষ শিখে যাবে কাকে ভোট দিতে হবে ও নির্বাচিত করতে হবে। মানুষকে কেউ আর টাকা ও শক্তি দিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। মাত্র তিন বছরের জন্য তিনি শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন এনেছিলেন। নির্বাচনের পর আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাবেন এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তা।

সে সময় কয়েকটি উপনির্বাচন হয় যে নির্বাচনে ৪/৫/৬ জন প্রার্থী মনোনীত হন। সরকার প্রচার ও প্রকাশনার দায়িত্ব নেয়। সমানভাবে প্রচারকার্য চলে, সরকার থেকে খরচ দেওয়া হয় সমানভাবে। যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সে- ই নির্বাচনে জয়ী হয়। কিশোরগঞ্জের এক উপনির্বাচনে উপরাষ্ট্রপতির ভাই প্রার্থী হয়েও কোনোরকম ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারেন নি। একজন সমাজসেবক সে নির্বাচনে জয়ী হয়যার ব্যক্তিগত টাকা-পয়সা কিছুই ছিল না, শুধুমাত্র জনগণের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগ ছিল।

বর্তমান নির্বাচনগুলোর অবস্থা কী? কালো টাকা ও অস্ত্রশক্তির প্রাধান্য। নির্বাচনগুলো দেখলে বার বার বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী আমার স্মরণে আসে, আর মনে পড়ে দেশ ও জনগণকে তিনি কী ভালোবাসতেন, কত গভীরভাবে চিনতেন।

(সূত্র: শেখ হাসিনা রচনা সমগ্র-১।। পৃষ্টা: ৮৮-৯১)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭