ইনসাইড বাংলাদেশ

আয়, মূল্যস্ফীতি ও বাণিজ্যমন্ত্রীর সিন্ডিকেটের গল্প


প্রকাশ: 11/09/2023


Thumbnail

পাঙ্গাশ মাছ তিতলির প্রিয় মাছের মধ্যে সবার উপরে থাকলেও বাড়ির অন্যান্যদের খুব একটা পছন্দ না হওয়াতে মাঝেমাঝেই বেশ মন খারাপ হতো তার। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে বেশিরভাগ দিনই তিতলির বাবা পাঙ্গাশ মাছ নিয়ে আসেন বাজার থেকে। তিতলিও বেশ খুশি এই ব্যাপারটাতে। ছোট্ট তিতলি হয়তো তার পছন্দের মাছ পেয়ে তৃপ্ত হয় আজকাল কিন্তু সে হয়তো বুঝতে পারে না আগুন বাজারের এই সময়ে যখন ১০০ টাকার পাঙ্গাশ মাছ কিনতে তিতলির বাবার চলে যায় প্রায় ২০০ টাকার মতো, তখন কিছুটা কমদামী শাক আর পাঙ্গাশ মাছেই ভরসা স্বল্প আয়ের তিতিলির বাবার।
  
উপরের গল্পটির চরিত্রেরা কাল্পনিক হলেও এই চিত্রটি মোটেও কাল্পনিক নয়। বাজারের নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে একটা কথা বেশ প্রচলিত আছে, এ দেশে জিনিসপত্রের দাম একবার বেড়ে গেলে সে জিনিসের দাম আর কমে না। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু এবং কয়েকমাস আগেও মূল্যস্ফীতি গোটা বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে আসলেও এই যায়গায় ব্যক্তিক্রম বাংলাদেশ। বেড়ে যাওয়া কোনো দ্রব্যের দাম তো কমেইনি, উল্টো বেঁচে থাকার জন্য মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাবার মতো জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। বেড়েছে পরিবহণ খরচ, বাজারের দামের সাথে হিমশিম খেয়ে বাড়িওয়ালারা বাড়িয়েছেন বাড়িভাড়া। খোলা আটা আগে যেখানে ২৬-২৮ টাকা কেজি ছিল, এখন তা বেড়ে ৫০ ছুঁয়েছে। যে সকল প্যাকেটজাত বেকারি পণ্য ৫০ টাকা বিক্রি হতো এখন তা বিক্রি হয় ৬৫-৭০ টাকায়। গায়ে মাখার সাবান ৪২ টাকা ছেড়ে এখন ৬২ তে। ৩৫০-৪০০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া জিরা হাজার টাকার গন্ডি পেরিয়ে এখন ১২শ টাকায়। ৭৫-৮০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া চিনির দাম বেড়ে ১৩৫ টাকা হয়েছে। ৭০-৮০ টাকা বিক্রি হওয়া টুথপেস্টের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০-১৩৫ টাকা। দাম বাড়লেও আদতে কি সত্যি বেড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের মে মাস থেকে প্রতি মাসে যত মূল্যস্ফীতি হয়েছে, এর চেয়ে কম হারে মজুরি বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য গতকাল ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বিবিএসের হিসাবে, গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত এক দশকের মধ্যে এবারই এত দীর্ঘ সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। বিবিএস এর তথ্য মতে দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এমন কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটির মতো। এ সকল মানুষদের প্রায় সিংহভাগই মজুরিনির্ভর। এই শ্রেণির মানুষের ওপরই মূল্যস্ফীতির এই চাপ তাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বর্তমান সময়ে একটি পরিবার তার আয় থেকে যত অর্থ খরচ করে, তার ৪৮ শতাংশের মতো খরচ হয় খাবার সামগ্রী কিনোতে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁদের আয় বাড়ছে না। ফলে প্রকৃতপক্ষে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, প্রকৃত অর্থে তারা হচ্ছেন আরও দরিদ্র। একদিকে হয়তো কিছু মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে কিন্তু বাড়তি আয় খেয়ে নিচ্ছে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম। উপার্জিত অর্থ চলে যাচ্ছে পকেট থেকে। 

কিন্তু এই সমস্যার পেছনে কি বাজারের কোনো কারসাজি কিংবা সিন্ডিকেটের সম্পর্ক রয়েছে? চলুন একটু খোঁজার চেষ্টা করি। আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ দায়িত্বে থাকেন মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী। সেইসাথে কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় সহ জনগণের কল্যাণে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে মানুষকে স্বস্তি দেয়ার দায়িত্বটাও নিতে হয়।  কিন্তু মাননীয় আজকাল সিন্ডিকেটভীতি এবং আমদানী হুমকিতেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন তার কাজের গন্ডি। এইতো ডিমের বাজার নিয়ে তুলকালামের সময়ে ঠিক কি কারণে ডিমের দাম বৃদ্ধি করে বাজার থেকে টাকা লুটে নেওয়া হলো তার সঠিক কারণ না বের হলেও হুঙ্কার ছিলো আমদানি করা হবে। পেঁয়াজের দাম বাড়লে, তেলের দাম বাড়লে শুধু আমদানি হুঙ্কারেই থেমে থাকেন মাননীয়, কিন্তু একবার বেড়ে যাওয়া দ্রব্যমূল্য আর না কমায় বাড়ে মুল্যস্ফীতি। ভোগে জনগণ। 

গত ১১ আগস্ট ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক ছায়া সংসদে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এভাবে দাম বাড়ানোর কাজ যে সিন্ডিকেট করে, তা তিনি জানেন; কিন্তু পাবলিকের কষ্ট বাড়াতে চান না বলেই তিনি সিন্ডিকেটে হাত দেন না। তিনি বলেছিলেন, ‘ধরুন আমরা সিন্ডিকেট বন্ধ করে দিলাম, সিন্ডিকেট চক্র বাজারে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিল। তখন ভোক্তারা পণ্য পেল না। এ জন্য আমাদের সবদিকে খেয়াল রাখতে হয়। আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রীর শেষ কথায় তিনি সবদিকে খেয়াল রাখেন, তিনি জানেন সিন্ডিকেটের সাথে কারা জড়িত, কিভাবে সিন্ডিকেট হচ্ছে কিন্তু তিনি কি তাহলে ভয় দেখালেন জনগণকে? খেয়াল তিনি রাখেন ঠিকই, তবে জনগণের খেয়াল রাখার যে দায়িত্ব তার উপরে বর্তায় সে খেয়াল না রেখে খেয়াল রাখছেন সিন্ডিকেট যেন না ভাঙ্গে সেদিকে। অসাধু সিন্ডিকেটের পকেটে জনগণের টাকা ঢুকলে মাননীয়ের লাভের জায়গাটা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে। এই গবেষণাকর্মে সুবিধার্থে একটু ক্লু দিয়ে রাখছি। আপনাদের নিশ্চই মনে আছে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেছিলেন “মন্ত্রীদের মধ্যেও সিন্ডিকেট আছে”। মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের প্রতি আনুগত্যের কথা অনেকবার নিজেই বলেছেন। যার মধ্যে তিনবারই বলেছেন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে। সাপ কামড়ে যাচ্ছে জনগণকে কিন্তু বীণ তাহলে কার হাতে। যদি বাণিজ্যমন্ত্রীর হাতেই থাকে বাজার নিয়ন্ত্রণের মন্ত্র তাহলে সিন্ডিকেটে জড়িত কে বা কারা তাদের বোতলবন্দি করতে কিসের ভয় তিনি ছড়ান। কোনো দ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে মাননীয় বলছেন আমদানি করা হবে, কিন্তু আসলেই কি ঐ পণ্যের সংকটের কারণে দাম বাড়লো নাকি সিন্ডিকেটের পকেটে টাকা ঢোকার পরেই মাননীয় হুঙ্কার দেন সেটি স্পষ্ট নয়। পণ্যের দাম যদি চাহিদা আর যোগানের উপরে নির্ভর করে তাহলে কেন আমদানি হুমকির আড়ালে লুকানো হচ্ছে দাহিদা আর যোগানের সঠিক তথ্য। অবশ্য মাননীয় ৫৬ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ৪২ বছরের পুরনো ব্যবসায়ী। 

বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনা করছে ১৫ বছর ধরে। এই ১৫ বছরে সরকারের যত ভালো অর্জন সেগুলো ম্লান হচ্ছে কয়েকজন চাটুকার মাননীয়র হাত ধরেই। সত্য গোপন করে প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করতেও তারা পিছপা হন না। এই যেমন গত ২৯ আগস্ট সিন্ডিকেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরবেন বলার পরদিন ৩০ আগস্ট মন্ত্রী সুর পাল্টে বলছিলেন “বাজার সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই”। তবে প্রধানমন্ত্রীর উপরে জনগণের আস্থা আছে বলেই জনগণ আশ্বস্ত যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সত্যি সত্যি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরতে চাওয়ার মাধ্যমে আসলে বাণিজ্যমন্ত্রীর সিন্ডিকেট গল্পের ভিলেনকেই পাকড়াও করবেন।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭