প্রকাশ: 13/09/2023
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দৈনিক জন্ম নিচ্ছে ১২০/১৩০ শিশু।
এরই মধ্যে গেল ছয় বছরে জন্ম নিয়েছে প্রায় দুই লাখ ৮০ হাজার শিশু।
ক্যাম্পে দায়িত্বরত স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, রেশন বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্যাম্প জীবনে
অন্য কোন কাজে ব্যস্ত না থাকায় এবং অল্প বয়সে বিয়ে ও একাধিক বিয়েতে বিনা বাঁধায়
আবদ্ধ হওয়ায় রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বাধিক । একদিকে
রোহিঙ্গাদের ঊর্ধ্বমুখী জন্মহার অন্যদিকে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে সংযুক্ত হওয়া আর
একেরপর এক বনভূমি ধংস হওয়াতে চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠায় আছেন স্থানীয়রা। ফলে রোহিঙ্গা
সংকট দিনদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তবে ঊর্ধ্বমুখী জন্মহার নিয়ন্ত্রণে নানা
উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।এদিকে কিছু
সংখ্যক এনজিওর বিরুদ্ধে জন্ম নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলে
অভিযোগ উঠেছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নিপীড়নের
মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন নতুন পুরাতন মিলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। এদের
মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা ছিল বেশী।যে সব রোহিঙ্গা শিশু ৮/১০ বয়সে দেশ ছেড়ে
বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা বর্তমানে তারা আজ ২/৩ সন্তানের জনক বা মা
হয়েছেন । এর আগে ’৯০-এর দশকেও অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়
নিয়েছিল। সবমিলিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বসবাস
করছে ১৫ লাখের কাছাকাছি।
জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রকাশিত তথ্য
অনুযায়ী, আশ্রয়শিবিরগুলোতে মোট পরিবার রয়েছে প্রায় আড়াই লাখের মতো। এর
মধ্যে ২৫ শতাংশ পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১০ জনের বেশি। ২০ শতাংশ পরিবারের সদস্যসংখ্যা
৮ থেকে ৯ জন। ২৩ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয় থেকে সাতজন। ২৮ শতাংশ পরিবারে
সদস্যসংখ্যা ২ থেকে তিনজন। গড়ে প্রতি পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৮। আশ্রয়শিবিরে
নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫২ শতাংশই শিশু। তাদের বয়স শূন্য থেকে ১৭ বছর।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোর বেশির ভাগ উখিয়ার কুতুপালংয়ে। যেটিকে বলা
হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ আশ্রয়শিবির। যেখানে ছোট একটি এলাকার মধ্যে সাত লাখের
বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা আমান উল্লাহ । সাত
সন্তান ও স্ত্রীসহ ১৪ জনের পরিবার নিয়ে গত ছয় বছর ধরে বসবাস করছেন ক্যাম্পের ডি-৫
ব্লকে। বড় ছেলের বয়স ১৮ বছর আর ছোট মেয়ের বয়স তিন মাস। তার রয়েছে আরো দুই স্ত্রী ।
ওই দুই স্ত্রীর মধ্যে একজনের নাম রাবেয়া অন্যজনের নাম কুলসুম। তাদের ঘরে আছে
২ টি করে শিশু সন্তান।অবশ্যই কুলসুম আবারো ৬ মাসের গর্ভবতী হয়েছেন।
এ দিকে বালুখালী ৯ নং ক্যাম্পের নুর আহমদ বলেন, সাতজন
সন্তানের মধ্যে চারজন ছেলে ও তিনজন মেয়ে। এখন যদি সামনে আল্লাহ আরো দেয় তাহলে
সন্তান আরো নেবো। শুধু নুর আহমদ নন, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি
আশ্রয় শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে বেশির ভাগের সন্তান সংখ্যা ৭/৮ জনের
বেশি। এমনকি যাদের পরিবারে পাঁচ থেকে ছয়জনের বেশি সন্তান রয়েছে তারা আরো সন্তান
নিতে আগ্রহী। কুতুপালংয়ের ক্যাম্প-২ ইস্টের বাসিন্দা খায়রুল আমিন বলেন, মিয়ানমারের
ওপারে আমার কোনো সন্তান ছিল না। বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে ছয় বছরের বেশি হচ্ছে।
এই ক্যাম্পে জন্ম নিয়েছে ৫ টি সন্তান। আর সন্তান দেয়া না দেয়া এটা আল্লাহর ওপর। মন
চাইলে নিবো, মন না চাইলে আর নিবো না। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়
জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে প্রায় ১২০/১৩০ শিশু। এরই
মধ্যে গেল ছয় বছরে জন্ম নিয়েছে তিন লাখের কাছাকাছি। ক্যাম্পে দায়িত্বরত
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে অনাগ্রহ, রেশন
বৃদ্ধি ও ক্যাম্প জীবনে তেমন কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় বেশি সন্তান
জন্মদানের মূল কারণ।
উখিয়ার কুতুপালংয়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মিডওয়াইফ সুপারভাইজার
আসমা আকতার বলেন, আরটিএমআই ইউএনএফপিএর অধীনে পরিচালিত প্রজেক্টে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে
মাঠ পর্যায়ে কাজ করি। রোহিঙ্গারা দীর্ঘমেয়াদি যে পদ্ধতি রয়েছে এটা নিতে একদম আগ্রহ
নেই। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে স্ত্রী-স্বামী ও শাশুড়িকে এনে কাউন্সেলিং করি।
রোহিঙ্গারা পিল, কনডম ও ডিপুগুলো নিতে চায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ৩, ৫ বা ১০ বছরের
যে পদ্ধতিগুলো একদম নিতে চায় না। কারণ রোহিঙ্গারা মনে করে, সন্তান যত বেশি জন্ম
নেবে মাথাপিছু রেশন তত বেশি হবে। এ জন্য রোহিঙ্গারা জন্মদানে বেশি আগ্রহী। এ ছাড়াও
তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার কাজ করে।অনেকে মনে করেন তাদের জনসংখ্যা দ্রুত
বৃদ্ধি পেলে নিজ দেশ তথা মায়ানমার জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে
পারবে।
একই ক্যাম্পের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার ডা:
ফাতেমা আকতার বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা অনেক বেশি। কারণ
তাদের কোনো কাজ নেই। যেহেতু কোনো কাজ নেই সেহেতু তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা হচ্ছে
সন্তান নেয়া।
ডা: ফাতেমা আরো বলেন, মূলত আমরা ক্যাম্পে প্রসূতি মায়েদের
স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকি। আমরা বেশি জোর লাগাচ্ছি, কাজ করছি মাঠ পর্যায়েও।
আমরা মাঠ পর্যায়ে প্রতিটি পরিবারের কাছে গিয়ে পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে
বুঝাচ্ছি এবং ডেমো প্রদর্শন করছি।
এ দিকে কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৬ লাখের মতো। এখন
ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বেশী। যা
নতুন করে ভয়াবহ সংকট হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা। উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন
পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের যদি কন্ট্রোল করা না
যায়, তাহলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া তো হয়েছে, কিছুদিন পরে এ সমস্যা
আরো বড় আকার ধারণ করবে। এ ছাড়াও রোহিঙ্গাদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর
পাশাপাশি তাদেরকে নিজদেশ মিয়ানমারে দ্রুত প্রত্যাবাসন করা যায় তার ব্যবস্থা করতে
হবে বিশ্ববাসীকে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হামিদুল হক
চৌধুরী বলেন, ‘যেভাবে রোহিঙ্গারা এসেছিল হাজার হাজার একসাথে, লাখে লাখে একসাথে;
একই রকম করে এ রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে দেখা যাবে,
একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রোহিঙ্গা এখান থেকে যাচ্ছে; কিন্তু তার চেয়ে বেশি রোহিঙ্গা
শিশু ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে যে সব শিশু বাংলাদেশে
জন্ম নিয়েছে তাদের তালিকা নেয়নি মায়ানমার সরকার।অন্য দিকে ৮০ দশক থেকে যেসব
রোহিঙ্গা এ দেশে জন্ম নিয়েছে এখানে বেড়ে উঠেছে। তাদের অনেকে পিতামাতা দাদা-দাদি
হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্তঃ হবে তা এখনো অস্পষ্ট।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো: মিজানুর রহমান বলেন,
রোহিঙ্গাদের জন্মহার বাংলাদেশীদের চেয়ে অনেক গুন বেশি।এটি আমাদের জন্য বড়
একটি চ্যালেঞ্জ যে, ঘনবসতি ক্যাম্পে রয়েছে; এখানে জায়গার সঙ্কট রয়েছে। মাত্র ১২
হাজার একর জায়গার মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ লোক বাস করে। এখন নতুন নতুন শিশু জন্মগ্রহণ
করছে, তাদের জন্য আমরা জায়গা কোথায় থেকে দিবো। এটা একটা বড় সঙ্কট। কমিশনার মো:
মিজানুর রহমান আরো বলেন, পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক
বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ও ইমামদেরকে সম্পৃক্ত
করে সচেতনতার কাজ করে যাচ্ছি।
প্রতি বছর আশ্রয়শিবিরে যে হারে বাড়ছে জনসংখ্যা
অন্যদিকে কমছে খাদ্যসহায়তা। সবমিলিয়ে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হলে
নানামুখী সঙ্কট যুক্ত হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এ দিকে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা
বলেন, আগামী ১০/১২ বছরে রোহিঙ্গাদের জন্মহার এ ভাবে বাড়তে থাকলে পুরো কক্সবাজার
জেলার জনসংখ্যার সমান হয়ে যাবে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধান না হলে
কক্সবাজারবাসীকে চরম মূল্য দিতে হবে।কারণ জঙ্গিবাদ উত্থান থেকে শুরু করে
সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭